রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর

রণক ইকরাম

ভয়ঙ্কর

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’, এটা যেমন সত্য ঠিক তেমনি মানুষেরও কিছু দুর্বলতা আছে। আর সেই দুর্বলতার গর্ভেই ভয়ের জন্ম। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ যেমন অনবরত নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে ব্যস্ত, ঠিক তেমনি অনেকগুলো বিষয়ই মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দ্বিধাগ্রস্ত করে। আর এমন সব বিষয়ই মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর হিসেবে আখ্যা লাভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর ঘটনা, স্থান বিষয়বস্তুর কোনো কমতি নেই। এর মাঝখান থেকে ভয়ঙ্কর অথচ মজার কতগুলো বিষয় নিয়ে আজকের আয়োজন-

 

পুতুল দ্বীপ

সচরাচর পুতুলকে খুব মিষ্টি এবং মায়াবী করে তৈরি করা হয়। শিশুদের খেলার উপকরণ হিসেবে পুতুল সেই আদ্যিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এই পুতুলও কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠতে পারে। এর আগে রকমারি পাতার আরেকটি আয়োজনে আমরা অ্যানাবেল নামের এক পৈশাচিক পুতুলের ভয়ঙ্কর গল্প জেনেছিলাম। তবে আজকের গল্প একটা দ্বীপের। যে দ্বীপটি সবার কাছে ভয়ঙ্কর পুতুলের দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। একটা সাধারণ ঘটনা থেকেই এই দ্বীপের রহস্যমন্ডিত অগ্রযাত্রার শুরু। আর এ ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ৮০ বছরেরও বেশি সময় আগের। তিন মেক্সিকান শিশু শীতল অন্ধকার দ্বীপটিতে খেলাচ্ছলে পুতুলের বিয়ে দিচ্ছিল। আর পুতুল বিয়ে খেলতে গিয়ে তিন শিশুর একজন নিখোঁজ হয়ে যায়! অনেক খোঁজাখুঁজির পর দ্বীপের পাশের একটি খালে শিশুটির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল। সেই শুরু। এরপর থেকে ভয়ে কেউ আর ওই পথ মাড়াতো না। ভয়ঙ্কর এই পুতুলের দ্বীপটি মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ মাইল দক্ষিণে জোকিমিলকো জেলায় অবস্থিত। এই দ্বীপে ঢুকলে অসীম সাহসী মানুষেরও বুক কেঁপে কেঁপে উঠবে। দ্বীপজুড়ে শুধু পুতুল আর পুতুল। ভয়ঙ্কর এই দ্বীপকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে নানা কাহিনি।

এত সব রহস্যের কারণেই ১৯৯০ সালে মেক্সিকান সরকার জোকিমিলকো জেলার এই দ্বীপটিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা করে। মেক্সিকান সরকার এই দ্বীপকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পর্যটন অঞ্চল বানানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পর্যটকরা কদাকার পুতুল দেখে বোধহয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে চান না। তাই তারা কখনো আসেন না। এই দ্বীপে একেক মৌসুমে ২০-৩০ জনের বেশি পর্যটক কখনই আসেননি।

১৯৫০ সালের দিকে ডন জুলিয়ান সানতানা নামের এক যাজক এই দ্বীপে এসেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এখানে তিনি নির্জনে তপস্যা করবেন। সেই যাজকের ভাষ্য অনুসারে, দ্বীপটিতে আশ্রম গড়ে তোলার পর থেকে তিনি প্রায়ই ওই মৃত শিশুটির আত্মার দেখা পেতেন। তার সঙ্গে মৃত শিশুটির আত্মার নাকি কথাও হতো। একদিন ওই শিশুর আত্মা জুলিয়ানের কাছে পুতুলের বায়না ধরে। আবার এক্ষেত্রে একটি শর্তও জুড়ে দেয়। সাধারণ কোনো পুতুল হলে চলবে না। পুতুল অবশ্যই বীভৎস হতে হবে। অর্থাৎ শিশুটির আত্মা-যেগুলো দেখলে মনে হবে তারা মানুষের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে। ওই আত্মার অনুরোধেই জুলিয়ান তার আশ্রমে চাষ করা সবজির বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে নষ্ট পুতুল সংগ্রহ করতে থাকেন। জঙ্গলে এনে গাছের ডালের সঙ্গে এগুলো বেঁধে রাখলেই খুশি হতো শিশুটির আত্মা। এমনিভাবে কুড়িয়ে পাওয়া কিংবা কিনে আনা হাজার হাজার পুতুল দিয়েই জুলিয়ান গড়ে তোলেন মৃত পুতুলের দ্বীপ। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, দ্বীপটিতে এখনো মৃত শিশুটির আত্মা ঘোরাঘুরি করে। মাঝে মাঝে শোনা যায় ভুতুড়ে আওয়াজ।  বিশ্ববাসীর কাছে মৃত পুতুলের দ্বীপ আসলেই বড়সড় আতঙ্কের নাম।

 

কঙ্কাল হ্রদ

এ হ্রদটি অন্য আট-দশটি হ্রদের মতো নয় একদমই। এ হ্রদটির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ঠিক যে সময় থেকে এ হ্রদটি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হলো- তখন থেকেই এর সঙ্গে রহস্যের ব্যাপারটি একেবারে মিলেমিশে গেছে। ভারতে অবস্থিত এ হ্রদটিকে লোকজন রূপকুন্ডের রহস্যময় অভিশপ্ত কঙ্কাল হ্রদ হিসেবেই চেনে।

হ্রদের মূল ইতিহাস হয়তো পুরনো। কিন্তু পৃথিবীবাসীর সামনে এর আবির্ভাব খুব বেশি দিন আগের নয়। ১৯৪২ সালের ঘটনা। অবিভক্ত ভারতের ব্রিটিশ গার্ডরা ভারতের রূপকুন্ডে ঠান্ডায় জমে যাওয়া একটি হ্রদের সন্ধান পায়। এ হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই মাইল উঁচুতে অবস্থিত। এর আশপাশের এলাকাও ছিল অতিরিক্ত ঠান্ডা। এতদিন পর্যন্ত কেউই এখানকার এ হ্রদটির কথা জানত না। কারও বর্ণনাতেই এ হ্রদের কথা পাওয়া যায়নি। এরকম একটি স্থানে অনাবিষ্কৃত এ হ্রদের অবস্থান ব্রিটিশ গার্ডদের অবাক করে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের অবাক হওয়ার পালা তখনো বাকি ছিল। হ্রদের আশপাশে ঘুরতে গিয়ে তারা যা দেখল তাতে চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার জোগাড়। চারদিকে শত শত মানুষের কঙ্কাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে গার্ডদেরই জমে যাওয়ার অবস্থা। তখন শীতকাল ছিল বলে খুব বেশি বীভৎসতা চোখে পড়েনি। কিন্তু গ্রীষ্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে আরও ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। হ্রদের জমে যাওয়া পানি গলে হ্রদ যত স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগল, ততই হ্রদের পানির নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের কঙ্কালগুলো ভেসে উঠতে লাগল। আর সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্রদের তীরে এসে সেসব কঙ্কাল জমতে শুরু করল। ১৯৪২ সালে বিশ্বজুড়ে বাজছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এমন সময় এতগুলো কঙ্কাল একসঙ্গে দেখে অনেকেই ভাবল এগুলো হয়তো মৃত জাপানি সৈন্যদের, যারা লুকিয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিল। এই কঙ্কালের রহস্য উন্মোচনের জন্য ব্রিটিশ সরকার অবিলম্বে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় ভারতে। কিন্তু কঙ্কালগুলো আসলে জাপানি সৈন্যদের ছিল না। কারণ এসব কঙ্কালের বয়স আরও বেশি বলে মনে হলো। তাহলে কোথা থেকে এলো এত এত মানব কঙ্কাল। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলল না। তবে তখন থেকেই এ হ্রদের নাম দেওয়া হয় ‘কঙ্কাল হ্রদ’।

একই জায়গায় এতগুলো কঙ্কাল কীভাবে এলো তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা কম হয়নি।  কারও মতে, ভূমিধস, কেউ বলেছেন মহামারী আবার অনেকের কাছে ধর্মীয় রীতির মাধ্যমে আত্মাহুতি বা উৎসর্গের ফলে এই বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। 

 

ভয়াল ন্যাট্রোন

তাঞ্জানিয়ার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি লবণাক্ত হ্রদের নাম ন্যাট্রোন। কেনিয়া আর তাঞ্জানিয়া সীমান্তে এ জায়গাটি দেখলে একে পৃথিবীর স্বর্গ বলেই মনে হবে। কিন্তু স্বর্গতুল্য এ স্থানটিকে এড়িয়ে চলে আশপাশের বেশির ভাগ প্রাণী। হ্রদটি ১০ ফুট গভীর, আর প্রশস্ততা পানির তলের উচ্চতা অনুযায়ী হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। লেকটির ভয়াবহ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ইতিহাসে ভয়াল লেক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। হ্রদটি দেখতে আর ১০টি সাধারণ হ্রদের মতো হলেও এ হ্রদের পানির তাপমাত্রা প্রচুর রকমের বেশি। এ হ্রদের পানির তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। মাঝে মাঝে এটি ১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করে। এ ছাড়া এ হ্রদের পানির ঢ়ঐ এর মাত্রা ৯ থেকে ১০.৫। এটি সমুদ্রের পানির ঢ়ঐ থেকেও বেশি। এ ছাড়াও এ লেকের পানির ক্ষারত্ব এমোনিয়ার কাছাকাছি। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে হ্রদের পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে থাকে। এর ফলে পানিতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। এরকম লবণাক্ত পরিবেশে জন্ম নেয় এমন কিছু অণুজীব, যাদের পুষ্টির উৎস হচ্ছে লবণ। খুবই উত্তপ্ত বলে এখানে কোনো বন্যপ্রাণীর বসবাস নেই। তবে কিছু বিশেষ প্রজাতির শৈবাল আর ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হচ্ছে এ হ্রদ। হ্রদের তলদেশের মাটিতে রয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট আর সোডিয়াম বাইকার্বনেট। এ হ্রদের অতিরিক্ত তাপমাত্রা আর লবণাক্ততা এ হ্রদকে পরিণত করেছে ভয়াবহ এক হ্রদে।  এ হ্রদ নিয়ে স্থানীয়রা অনেক গল্প ফাঁদলেও বিজ্ঞানীরা একে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল ছাড়া আর কিছুই ভাবছেন না।

 

গাছ

গাছ মানুষের বন্ধু। কিন্তু সব গাছই যে এক রকম হবে তা কিন্তু নয়। এমনই ভয়ঙ্কর এক গাছের নাম স্যান্ডবক্স ট্রি। সাধারণত বিষুবীয় অঞ্চলের যেসব জায়গায় মানুষের পা পড়ে না, সেসব স্থানে এই গাছ জন্মায়। তবে আফ্রিকার কিছু কিছু স্থানেও এমন গাছের দেখা মেলে। এর বিস্তার কম, কারণ ভয়ঙ্কর এই গাছকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার সাহস নেই মানুষের।

এই গাছটি প্রায় ২০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। স্যান্ডবক্স ট্রি ছাড়াও এর আরও কিছু নাম হলো পসামউড, জাবিলো, মাংকি-নো-ক্লাইম্ব এবং ডায়নামাইট ট্রি। এর একেকটি নামের পেছনে রয়েছে এর বিভিন্ন সব বৈশিষ্ট্য। এই গাছের বাঁকল বেশ মসৃণ হলেও এর ওপরে রয়েছে সারি সারি কাঁটা। এই কাঁটা থাকার ফলেই গাছের চেহারা একেবারে ভয়ঙ্কর। শুধু কাঁটাই নয়, এই গাছ বিষাক্ত হওয়ার কারণে এর ধারেকাছে কোনো প্রাণী পারতপক্ষে আসে না। বিষাক্ত এবং ঘন এক ধরনের রস নিঃসৃত হয় এই গাছ থেকে। আয়াহুয়াস্কা নামের এক ধরনের হ্যালুসিনোজেনের মূল উপাদান হলো এই বিষ। গাছের সংস্পর্শে এলে এবং গাছ কাটলে খারাপ ধরনের ত্বক এবং চোখের প্রদাহ হতে দেখা যায়। আর এই গাছের বীজেও রয়েছে অনেকটা বিষ। বীজ খেতে ভালো বলে এটা আরও বেশি ক্ষতি করে। লোভে পড়ে দুইয়ের বেশি বীজ খেয়ে ফেললেই শরীরে চরম বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ক্রমাগত বমি এবং ডায়রিয়ার মতো উপসর্গের পাশাপাশি দৃষ্টিবিভ্রম শুরু হয়ে যাবে।

 

বৃহত্তম গুহা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং ভয়ঙ্কর গুহা হচ্ছে ভিয়েতনামের হ্যাংসন ডুং। এটি মূলত একাধিক গুহার সমন্বয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি গুহা নেটওয়ার্ক। ভিয়েতনামের কোং বিন প্রদেশের বো টাচ জেলায় এটি অবস্থিত। এটিকে আবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা নেটওয়ার্ক বলা হয়ে থাকে। অত্যন্ত প্রাচীন এই গুহাটি দীর্ঘদিন মানুষের কাছে অনাবিষ্কৃত ছিল। এটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯১ সালে। গুহাটি প্রথম আবিষ্কার করেন সেখানের স্থানীয় এক ব্যক্তি, যার নাম হো-খানহ। এ গুহার সবচেয়ে বড় কক্ষটির পরিমাপ ২০০ মিটার উচ্চ এবং ১৫০ মিটার চওড়া, যা মোট ৫.৬ কিলোমিটার। ভিয়েতনামের জাতীয় উদ্যান ফুং না কিং ব্যাংয়ের পাশেই হ্যাংসন ডুংয়ের অবস্থান। রহস্যময় গুহাটি প্রায় ১৫০টি গুহার সমন্বয়ে গঠিত। মজার ব্যাপার হলো গবেষক দল গুহাটির আয়তন পরিমাপ করতে পারলেও এর শেষ খুঁজে বের করতে পারেননি। আর এ গুহাটি বিপজ্জনক হওয়ার কারণ হলো, গবেষণা দল গুহা আবিষ্কারের সময় সম্মুখীন হন নানা বিপদ-আপদের। তারা গুহার মধ্যে পান বিষধর সাপ, বড় মাকড়সা, অদ্ভুত সব প্রাণী ও অজানা-অচেনা বৃক্ষরাজি। তারা গুহার মধ্যে দেখতে পান ছোট ছোট পানির ফোয়ারা। গুহার মধ্যে রয়েছে অনেক সুড়ঙ্গপথ, যেসব পথ দিয়ে অতি সহজেই ভিয়েতনামের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করা যায়। গুহার মধ্যে পানির ফোয়ারা ছাড়াও রয়েছে একাধিক জঙ্গল।  দূর থেকে দেখতে হ্যাংসন ডুংকে দোতলা বাসের মতো মনে হয়। যে কারণে হ্যাংসন ডুং অতি আকর্ষণীয় গুহা হিসেবে বিবেচিত।

 

প্রবেশ নিষেধ

‘নো এন্ট্রি’ বা ‘প্রবেশ নিষেধ’ কথাগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু অভিশাপ কিংবা ভুতুড়ে কর্মকান্ডের জন্য যদি কোনো স্থানের সামনে এমন সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কেমন লাগার কথা? অবশ্যই ভীতিকর এবং বিস্ময়কর একটি বিষয়। এমনই একটি ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ জায়গা ভারতের ভানগড় দুর্গ। অভিশাপ, ভূতদের উৎপাতের কারণে জায়গাটি এত বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে যে, সরকারিভাবেই রাতের আঁধারে এখানে প্রবেশের ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ভানগড় দুর্গটি অবস্থিত ভারতের রাজস্থানের আলোয়ার জেলায় জয়পুর আর দিল্লির মাঝমাঝিতে। ভয়ঙ্কর ইমেজের কারণে সন্ধ্যা নামার আগেই ভানগড় থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরে যাওয়া নিরাপদ মনে করে এলাকার লোকজন। তাদের বিশ্বাস এখানে থাকলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটবেই। এখানে থাকলে মানুষের মনের অস্থিরতা বেড়ে যায়। আর মনের মধ্যে ভর করে অজানা অচেনা আতঙ্ক কিংবা ভয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে স্থানীয় লোকজন দুর্গের আশপাশের এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে পারে না। আবার সাহস করে কেউ যদি বাড়ি নির্মাণও করে ফেলেন, তাহলে সেই বাড়ির ছাদ রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, কেউ যদি ছাদ নির্মাণও করেন তাহলে সেটি আপনাআপনি ধসে যায়।

ভানগড় দুর্গের প্রকৃত ইতিহাস আজও অজানা। তবে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ধারণার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে একটি অনুসারে সতের শতকে রাজা মান সিংয়ের ছোট ভাই মাধো সিং এ দুর্গের নির্মাতা। মুঘল শাসনের প্রতাপ প্রতিপত্তি কমার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্গটির দুর্দশা শুরু হয়। নগরীর শুরু দিকে ভানগড়ের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। সীমানা প্রাচীরের মাঝে মাঝে পাঁচটি তোরণ তৈরি করে শহরটিকে আশপাশের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- ভানগড় দুর্গ নগরীর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখনো টিকে আছে মসজিদ আর মন্দির। টিকে আছে হুনুমান, শিব, নারায়ণ এবং গোপীনাথের মন্দির। এ নগরকে অভিশপ্ত মনে করার পেছনে ইতিহাসের বেশকটি শক্ত কারণ রয়েছে। ভানগড়ের সঙ্গেই ছিল গুরু বালুনাথের আশ্রম। গুরু বালুনাথ রাজা ভানু সিংকে নগর তৈরি করার সময় বলেছিলেন যেন তাকে বিরক্ত না করা হয়। এ বিষয়ে গুরু রাজাকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। একবার সতর্কবার্তা পাঠান গুরু। আর সেই বার্তাটি ছিল প্রাসাদের ছায়া তার আশ্রম ছোঁয়া মাত্রই শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু রাজা ভানুসিংহ বালুনাথের কথা মানেননি। পরবর্তী সময়ে গুরু বালুনাথের কথাই সত্যি হয়। প্রাসাদের উচ্চতার কারণে ছায়া পড়ে তার আশ্রমে। এর পরেই ধ্বংস হয়ে যায় এ শহর। প্রচলিত বিশ্বাসের সেই গুরু বালুনাথের সমাধিও রয়েছে ভানগড়ে। নগরী ধ্বংসের পেছনে আরও একটি কারণ প্রচলিত রয়েছে। ভানগড়ের রাজকুমারী রত্নাবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। সে সময় ভানগড় এলাকায় সিংহিয়া নামে এক তান্ত্রিক বাস করত।

সিংহিয়া রাজকুমারী রত্নাবতীকে ভালোবাসত। কিন্তু তান্ত্রিক সিংহিয়া তন্ত্রবলে জানতে পেরেছিলেন রত্নাবতী তার প্রেমে সাড়া দেবে না। এরপরও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না সিংহিয়া। তিনি সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদিন রাজকুমারী সহচরীদের সঙ্গে নিয়ে কাছের বাজারে পছন্দের সুগন্ধি তেল কেনার জন্য আসেন। সুযোগটা ব্যবহার করে তান্ত্রিক সুগন্ধির ওপর জাদুর প্রভাব বিস্তার করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল- এ সুগন্ধির প্রভাবে রাজকুমারীকে নিজের বশে নিয়ে আসা। কিন্তু রাজকুমারী ছিলেন দারুণ বুদ্ধিমতী। তিনি তান্ত্রিকের কুমতলব আঁচ করতে পারলেন। বুঝতে পেরে রাজকুমারী বাজার থেকে কেনা সুগন্ধি তেল মাটিতে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রাজকুমারীর ফেলে দেওয়া তেল থেকে তৈরি হয় বিশাল এক অগ্নিকুন্ড। অগ্নিকুন্ডের লকলকে জিব তাড়া করে জাদুকরকে। আগ্নেয়লাভা জাদুকরকে দ্রুত ধরে ফেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। তান্ত্রিক মারা যাওয়ার আগে ভানগড় নগরী ধ্বংসের অভিশাপ দিয়ে যায়। পরের বছর এক যুদ্ধে প্রাণ হারান রাজকুমারী। যুদ্ধের ক্ষতে ধ্বংস হয়ে যায় নগরী। এরপর থেকে এ নগরী অভিশপ্ত নগরী হিসেবে পরিচিতি পায়  ভারতজুড়ে। ভানগড় নগরীকে কেন্দ্র করে এমন উপকথা আর এ সময়ে মানুষের ভয়ের গল্প শুনলে যে কারোর কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা। মনের ভিতর প্রশ্ন আসবে সত্যি আবার এমন হতে পারে নাকি। কিন্তু ভারতজুড়ে তো বটেই বিশ্বজুড়েও ভানগড়ের অদ্ভুতুড়ে কীর্তিকলাপ ফলাও করে প্রচার হয়েছে। শুধু কি তাই? অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভানগড় নগরের সামনে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক দফতর একটা সাইনর্বোড টাঙিয়ে দিয়েছে। যাতে লেখা আছে- ‘ভানগড় এলাকায় সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ।’

 

ভিলেজ অব ডেড

আজনিকুনি হ্রদের পাশেই একটি গ্রাম। এই হ্রদটি উত্তর-পশ্চিম কানাডায় অবস্থিত। নিভৃত এই গ্রামটি পশুর লোম উৎপাদনের জন্য খ্যাত ছিল। পশম কেনার জন্য সেখানে ব্যবসায়ীদের ভালো যাতায়াত ছিল। ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী জো লাবেল নামের একজন পশম ব্যবসায়ী।

লাবেলের ভাষ্য মতে, তিনি একদিন পশম সংগ্রহের উদ্দেশে গ্রামে যান। আর গ্রামের ভিতর গিয়ে দেখেন সেখানে একটা মানুষও নেই। গ্রামের সব মানুষ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তারা যে শার্টগুলো বুনছিল সেগুলো অসমাপ্ত অবস্থায় পড়েছিল। খাবারগুলো তখনো চুলোতে গরম হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেও এখানে অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিল। একটির পর একটি বাড়ি ঘুরেও কোনো মানুষের দেখা পাওয়া গেল না। এর মধ্যেই সাতটি কুকুরকে অনাহারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। এ ছাড়া গ্রামের একমাত্র কবরস্থানের সব কবর পাওয়া গেল খোদিত অবস্থায়! কিন্তু কবরস্থানের ভিতরে কোনো লাশের দেখা মিলল না। ভিতরের সব লাশ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। এটা কোনো প্রাণীর কাজ নয়, কারণ কবরের সঙ্গে যে পাথরের ফলক ছিল সেগুলো যথাস্থানেই ছিল। দ্য রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। মেজর থিওডোর লিস্টোর্টের নেতৃত্বে দ্য রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ পুরো গ্রাম ও আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কোনো গ্রামবাসীকে পাওয়া গেল না। লেখক জর্জ সাভারভিও, যিনি এই অভিযানে উপস্থিত ছিলেন ১৯৩১ সালের জানুয়ারিতে নর্থওয়েস্ট জার্নালে এ সংক্রান্ত ৫ পর্বের একটি নিবন্ধ লেখেন। তার ভাষ্য মতে পুলিশ দেখল, ওই গ্রামের এস্কিমোদের পূর্ব পুরুষদের সব কবর খোদিত অবস্থায় আছে আর সেগুলোর ভিতর থেকে লাশগুলো গায়েব! এই গ্রামে আজনিকুনি উপজাতীয় গোত্রের ২০০০ মানুষের বসবাস ছিল। এদের আর কখনো দেখা যায়নি।  এখনো আজনিকুনি হ্রদ আর এর পাশেই অবস্থিত গ্রামটি ‘দ্য ভিলেজ অব দ্য ডেড’ নামে পরিচিত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর