রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

এখনো জনবহুল প্রাচীন যত নগরী

সাইফ ইমন

এখনো জনবহুল প্রাচীন যত নগরী

বৈরুত

৫০০০ বছর পুরনো অতিপ্রাচীন সমুদ্রবন্দর

মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ

বৈরুত লেবাননের রাজধানী ও প্রধান শহর, যার জনসংখ্যা মাত্র ১৯ লাখ। লেবাননের এ প্রাচীন শহরটি ভূমধ্যসাগরের একটি উপদ্বীপে গড়ে ওঠেছিল। এ শহরটি লেবাননের সর্ববৃহৎ এবং প্রধান সমুদ্রবন্দর। তাই এটি দেশটির গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বৈরুতের অধীনে রয়েছে বেশ কিছু উপশহর। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম (১৫১২-১৫১৫) এর অধীনে অটোমানরা বর্তমান লেবাননসহ সিরিয়া জয় করেছিল। বৈরুত অটোমান সময়কালে স্থানীয় ড্রুজ ইমির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন, দ্বিতীয় ফখর-আল-দীন সতেরো শতকের গোড়ার দিকে এটি অটোমানদের কাছ থেকে সুরক্ষিত করেছিলেন, কিন্তু অটোমানরা ১৭৬৩ সালে এটি পুনরায় দখল করেছিল। জিজার পাশা এবং আবদুল্লাহ পাশার অধীনে অটোমান আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উত্তর যুগে বৈরুত প্রায় ১০ হাজার জনসংখ্যার একটি ছোট্ট শহর ছিল।

 

আর্বিল

৪৩০০ বছর পুরনো দীর্ঘস্থায়ী মানববসতি

মোট জনসংখ্যা ৯ লাখ

আর্বিল উত্তর ইরাকের অতি প্রাচীন একটি শহর যা আর্বিল প্রদেশের রাজধানী। মসুল শহরের কাছে অবস্থিত আর্বিল প্রায় ৪ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। সুমেরীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে শহরটি প্রতিষ্ঠা করে। এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মনুষ্যবসতি। সুমেরীয়রা শহরটিকে উর্বিলুম নামে ডাকত। শহরটি ইতিহাসের শুরু থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আর্বিলের কাছে গাউগামেলা নামের এক গ্রামে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে মহাবীর আলেকজান্ডার পারস্যের রাজা তৃতীয় দারিউসকে পরাজিত করেন। বর্তমানে এটি ইরাকের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ কুর্দি অধ্যুষিত শহর হিসেবে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে শহরটিতে গৃহযুদ্ধ বাঁধে। এখানে কুর্দিয় বিভিন্ন গোত্র পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৯৬ সালে কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (কেডিপি) নেতারা সাদ্দাম হোসেনকে এ গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানালে সাদ্দাম এখানে ৩০ হাজার সৈন্যের বহর পাঠান এবং কেডিপিকে এখানকার শাসনভার দিয়েছিলেন। এখানে প্রায় ৯ লাখ লোকের বাস।

 

আলেপ্পো

৬৩০০ বছর পুরনো অন্যতম প্রাচীন শহর

মোট জনসংখ্যা ৪৪ লাখ

সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর এবং আলেপ্পো মুহাফাযার (সিরিয়ার প্রদেশ) রাজধানী। এটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং রাজধানী দামেস্ক থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আলেপ্পোর জনসংখ্যা ৪৪ লাখ। এটি পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যেও অন্যতম বড় শহর। শতাব্দীকাল ধরে আলেপ্পো সিরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল এবং ইস্তানবুল ও কায়রোর পরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ছিল। আলেপ্পো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। অনেকে দাবি করেন ১০০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে মানুষ আলেপ্পোতে বসবাস করছে। তবে সিরিয়ার তেল-আস-সাওদা এবং তেল-আল-আনসারি শহরে খননকাজের মাধ্যমে অনেকে দাবি করেছেন আলেপ্পোতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে মানুষ বসবাস করছে। তখনকার সময়ে আলেপ্পো বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন করেছিল। আলেপ্পোর এমন দীর্ঘ ইতিহাসের পেছনে রয়েছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। শহরটি ভূমধ্যসাগর ও মেসোপটেমিয়ার মাঝে বৈদেশিক বাণিজ্যের সহায়ক।

 

দামেস্ক

১২০০০ বছর পুরনো পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর

মোট জনসংখ্যা ১৭ লাখ

দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী। প্রায় ১২ হাজার বছর ধরে মানুষের বসতির চিহ্ন মেলে এখানে। তাই অনেকেই দাবি করেন দামেস্কই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। তবে এখনো এ দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলেনি। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পম্পেই থেকে শুরু করে খালেদ ইবনে ওয়ালীদের মতো অসাধারণ সব বিশ্ববিজেতার ইতিহাসসমৃদ্ধ দামেস্কের মাটি। আর তাই সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নাম ওঠে আসবে না এটা কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। আলেপ্পোর মতো দামেস্কেও একই সময়ে জনবসতি গড়ে ওঠে। তবে অনেকে মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ সালে এ শহরে মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। শহরটি  ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে বিশেষত্ব বহন করে। প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) দামেস্ক থেকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র ইয়াজিদের কাছে শাসনভার অর্পণ করে খেলাফত ব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্রের সূচনা করেন। দামেস্কের মোট জনসংখ্যা ১৭ লাখ।

 

কায়রো

৪০০০ বছর পুরনো নীল নদের তীরে সূচনা

মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি

বিশ্বের দশম জনবহুল শহর কায়রো, মিসরের রাজধানী। প্রাচীনকাল থেকেই এ শহরে মানুষ বসবাস শুরু করে। নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা এ শহরের সূচনা হয় একেবারে প্রস্তর যুগে। জলপথে যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধার্থে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে এ অঞ্চলটি। কিন্তু এটি সত্যিকারের উন্নতির মুখ দেখে প্রথম ফারাও মেনেস-এর সময়ে। বিংশ শতাব্দীতে এসে সেতু এবং বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় কায়রোতে। এত সব উন্নতির কারণে এ নগরীর জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৯২৭ সালের মাথায় এক মিলিয়ন হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে ১ কোটি ৮৪ লাখ ১৯ হাজার মানুষ বাস করে। ১৯৫২ সালে মিসরীয় বিপ্লবের সময়ে কায়রো এবং পুরো মিসরেই ঔপনিবেশিক শক্তির পতন ঘটে। এরপর থেকেই মিসরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মিসরীয়রা কায়রোতে চলে আসতে শুরু করে। এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতেই কায়রোকে আরও বড় করে তোলা হয়। এতে পুরনো কায়রো এবং নতুন কায়রো দুই অংশের সূচনা হয়।

 

এথেন্স

৩৫০০ বছর পুরনো গণতন্ত্রের জন্মশহর

মোট জনসংখ্যা ৩২ লাখ

গ্রিক সভ্যতার সূচনালগ্নে অনেক পাহাড়ের কারণে গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে অনেকগুলো নগররাষ্ট্র তৈরি হয়। গ্রিসের মূল ভূখন্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা এবং পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা ও কোরিন্থ। এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস।

এদের নেতৃত্বে ছিল গ্রিসের খ্যাতনামা শহর এথেন্স। পর্যটকদের আকর্ষণের শীর্ষে থাকা শহরটি প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরনো। এই শহরকেই বলা হয় গণতন্ত্রের জন্মশহর। এই শহরের পরতে পরতে মেখে আছে মহাবীর ও জ্ঞানীদের পদচারণা। রয়েছে নানা মিথ। আছে নানা কালের ঐতিহাসিক স্থাপনা। মনোরম ভাস্কর্যগুলো যেন হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই বছর জুড়ে এখানে থাকে পর্যটকদের ভিড়। এই শহর সম্পর্কে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলেন, ‘How great are the dangers I face to win a good name in Athens.’

 

সাংহাই

১১০০ বছর পুরনো শীর্ষ জনবহুল শহর

মোট জনসংখ্যা ২.৭ কোটি

বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল শহরের তালিকায় নাম রয়েছে চীনের সাংহাইয়ের।

এটি ৯০০ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করা হলেও এর রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ৬০০০ বছর আগে এখানে জনবসতি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে শহরটিতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সাংহাইয়ের জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩০ লাখের মতো। এর আগে  ১৯৯০ সালে এর জনসংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ২৩ হাজারের কিছু বেশি। চীনের সবচেয়ে বড় শহর সাংহাই গ্লোবাল ফাইন্যানশিয়াল হাব হিসেবেও পরিচিত। গ্লোবাল ফাইন্যানশিয়াল সেন্টার সূচিতে ২০১৬ সালে সাংহাইয়ের অবস্থান ছিল ১৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর এটি। বৃহৎ প্রশাসনিক, বন্দর নগরী এবং ব্যবসায়িক শহর হিসেবে সাংহাইয়ের গুরুত্ব বাড়তে থাকে ১৯ শতকের প্রথম দিকেই। এরপর ১৯ শতকের মাঝামাঝি এখানে সমাজতান্ত্রিকতা বিস্তার লাভ করে।

 

ইস্তাম্বুল

২৫০০ বছর পুরনো দুই মহাদেশের শহর

মোট জনসংখ্যা ১.৫ কোটি

প্রাচীনকাল থেকেই তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুল দুই মহাদেশের শহর হিসেবে পরিচিত। আড়াই হাজার বছরের পুরনো এই শহরটিকে বলা চলে একটি কিংবদন্তি। এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো বসফরাস, আর এই বসফরাস প্রণালির অবস্থান প্রাচীন এই শহরে। শহরটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি শহর। ইস্তাম্বুল ইউনেস্কোর তালিকায় ইউরোপের রাজধানী শহরের মর্যাদা পেয়েছিল ২০১০ সালে। এটাই একমাত্র শহর যার ভৌগোলিক অবস্থান দুই মহাদেশে। পরিকল্পিত শহরটি  দেখতে স্বপ্নের জগতের মতো। একসময় ইস্তাম্বুলই ছিল পৃথিবী শাসনকারী অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্তি বলেন, ‘গোটা পৃথিবীকে যদি একটি রাজ্য ভাবা হয়, ইস্তাম্বুল হবে তার রাজধানী।’

 

জেরুজালেম

৫০০০ বছর পুরনো সমুদ্রবন্দর

মোট জনসংখ্যা ৯ লাখ

ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় গুরুত্ব মিশে রয়েছে এই শহরের সঙ্গে। মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র ভূমি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে জেরুজালেম। ধর্মীয়ভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জেরুজালেমে রয়েছে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস। ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা এই অঞ্চলকে টেম্পল মাউন্ট নামেও ডাকে। জেরুজালেমে মুসলমানদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত, যা মুসলমানদের স্মৃতিবিজড়িত এবং সেখানে অনেক নবী এবং সাহাবার কবর রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছেও জেরুজালেমের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। বেথেলহামে যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেন বলেই তারা বিশ্বাস করেন। বাইবেলে বর্ণিত এই বেথেলহাম রয়েছে জেরুজালেম শহরের দক্ষিণাংশে। এই জায়গাটি খ্রিস্টানদের কাছে তাই ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া জেরুজালেমে ইহুদিদের পবিত্র ওয়েলিং ওয়াল অবস্থিত।

সর্বশেষ খবর