বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য-স্থাপত্যে জমিদারবাড়ি

রেজা মুজাম্মেল

ঐতিহ্য-স্থাপত্যে জমিদারবাড়ি

জমিদাররা ছিলেন শৌখিন, বিলাসী, আটপৌরে, আড়ম্বরপূর্ণ। অনেকের পছন্দ ছিল জাঁকজমক ও জৌলুসপূর্ণ পরিবেশ। তাই তারা বসবাসের জন্য নির্মাণ করতেন সময়ের সেরা কারুকাজ ও শৈল্পিকতায় ভরা স্থাপনা। বাড়ির নির্মাণশৈলীর প্রতিটি পরতে পরতে রাখতেন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। এসব জমিদারবাড়িকে ঘিরেই পরিচালিত হতো স্থানীয় যত কর্মকান্ড। চট্টগ্রামেও ছিল এমন অনেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। জৌলুসপূর্ণ ছয়টি জমিদারবাড়ি নিয়ে আজকের আয়োজন

 

রাজা শ্যাম রায়ের  মিয়াবাড়ি

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী জমিদার মিয়াবাড়ি। বসবাসের জন্য নির্মিত দ্বিতল ভবন। নিচ তলায় তিনটি ও দ্বিতীয় তলায় তিনটি কক্ষ। ভবনটি তৈরি ইট, সুরকি ও রড দিয়ে। এতে ব্যবহৃত হয় চারকোণাকৃতি ইট। ইটগুলো তৈরি দেয়াঙ পাহাড়ের মাটি দিয়ে। সঙ্গে চুন-সুরকির মিশেলে নির্মিত হয় স্থাপনাটি। জমিদারবাড়ির প্রবেশপথে ছিল একটি কাচারিঘর। পাশেই বিনোদনের জলসা ঘর। ছিল ধান রাখার জন্য বিশাল গোলা। বাড়ির প্রবেশমুখে বড় একটি পুকুর। পুকুরে দুটি ঘাট। জমিদারবাড়ির পাশেই আছে পারিবারিক মসজিদ ও কবরস্থান। সেকালে নির্মিত মসজিদটির কারুকাজ এখনো দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কাড়ে। মসজিদটির পাশের কবরস্থানে শুয়ে আছেন জমিদারের বংশধররা। এখন আর জমিদারবাড়ির সেই জৌলুস নেই। এটি এখন কেবলই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। ভবনের গায়ে লতা-গুল্ম, ফাঙ্গাস। জানা যায়, ১৬৯৪-৯৬ সালে জমিদারের বংশধররা এই স্থানে বসবাস শুরু করেন। আনুমানিক ১৭০০ সালের দিকে এই জমিদারবাড়ির গোড়াপত্তন। এ বংশের জমিদারি শুরু হয় জমিদার দেওয়ান রাজা শ্যাম রায়ের মাধ্যমে। তিনি জমিদারি লাভ করেন বাংলার নবাব শায়েস্তা খানের কাছ থেকে। নবাব শায়েস্তা খান যখন চট্টগ্রাম বিজয় করেন, তখন তার প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যাম রায়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী খান নামে পরিচিতি পান। মনোহর খান বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলে শায়েস্তা খান নিজের মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। জনশ্রুতি আছে, জমিদার শায়েস্তা খান তার জমিদারির ২৫ শতাংশ মনোহর আলী খানকে দান করেছিলেন। তার বংশধরদের জমিদারি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ছেড়ে হাতিয়া-নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়। খাজনা  আদায়ের সময় ভারতবর্ষের সেরা শিল্পী, বাদক দল মাতিয়ে রাখতেন এ বাড়ি। বছরজুড়ে থাকত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাদের অধীনে চট্টগ্রামে ছিল অনেক ছোট ছোট জমিদার। এই জমিদারের বংশধররা তাদের বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য কাজী, মহুরি, সিকদার, নাপিত, ধোপা, কামার-কুমারসহ অনেক পেশাজীবী কর্মচারী রাখতেন। সবাই জমিদারবাড়িতে বাস করতেন। জমিদার মনোহর আলী খানের অধস্তন সপ্তম পুরুষ ছিলেন ফাজিল খান। তিনি আনোয়ারার ‘ফাজিল খাঁ’ হাটের প্রতিষ্ঠাতা। নবম পুরুষ ছিলেন ইলিয়াছ খান। তিনি ৩০০ বছরের পুরনো ‘ইলিয়াছ খান মসজিদ’র প্রতিষ্ঠাতা। শায়েস্তা খানের আমল থেকে ১৯তম বংশধর পর্যন্ত জমিদারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে ষাটের দশক থেকে জমিদারের বংশধররা এখানে বসবাস বন্ধ করে দেন। তখন থেকে জমিদারবাড়ির স্থাপনা অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে। স্থাপনাগুলোতে এখন লতাপাতা ও গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। সংস্কার না হওয়ায় পুরনো ভবনটি বিলুপ্তপ্রায়। স্থানীয়দের দাবি, বৃহত্তর চট্টগ্রামে ছিল এ পরিবারের খ্যাতি। কালক্রমে হারিয়ে যায় জৌলুস। ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনায় জন্মে ঝোপ-জঙ্গল। তাই দেশের পুরনো ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বড়উঠান মিয়াবাড়িটি রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। পুরনো ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে বাড়িটি সংস্কার করলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।

 

শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদারবাড়ি

প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে দ্বিতল বাড়ি। বাড়িজুড়ে আছে কারুকাজ। দেয়াল-কার্নিশগুলোতে শোভা পাচ্ছে সুনিপুণ দৃষ্টিনন্দন শিল্প। ভবনের ছাদগুলো কাঠের। আছে বড় শয়নকক্ষ, গুদামঘর, ধানের গোলা, রান্নাঘর, বাড়ির মাঝখানে শৈল্পিক কারুকাজের বড় মন্দির, বড় বড় তিনটি পুকুর। বাড়ির সামনে-পেছনে ঘাট, গোয়ালঘর, ঘোড়াশাল। পুরো বাড়ির কোথাও নেই রডের গাঁথুনি। আছে কেবল লাল ইট আর চুনামাটি। বাড়ির দুই পাশে দুটি গম্বুজ বাড়ির গর্বের প্রতীক হিসেবে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, নান্দনিক সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলী সংবলিত শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদারবাড়ির চিত্র এটি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার উত্তর ফতেয়াবাদ নন্দীরহাট এলাকায় প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি লোকমুখে সত্য সাহার জমিদারবাড়িও বলা হয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহা এই জমিদারবাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার দৃশ্য ধারণ হয় এই বাড়িতে। ১৮৯০ সালের দিকে এই ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়িটি জমিদার পরিবারের বিত্তবৈভব প্রদর্শনের জন্য জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা নির্মাণ করেন। ১৯২০ সালে জমিদার লক্ষ্মীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা- তিন ভাই মিলে জমিদারির সূচনা করেন। তাদের সন্তান ১২ জন। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে লক্ষ্মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহার হাতে জমিদারি সমাপ্ত হয়। জমিদার প্রসন্ন সাহার ছিল দুটি ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনি আদালতে যেতেন। সঙ্গে থাকতেন দুইজন নেপালি দাওয়ান। চাকর-বাকর ছিল অর্ধশতাধিক, ছিল হালের গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। প্রতিবেলায় রান্না হতো ২০০ থেকে ৩০০ জনের। হাটহাজারী, নাজিরহাট, ধলই, গুমনমর্দন, জোবরা, আলীপুর, ফতেয়াবাদসহ আশপাশের এলাকায় ছিল জমিদারি। প্রায় ১০ হাজার কৃষক প্রতি বছর রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠান করতেন। তবে এসব আর নেই। জমিদারবাড়িটির অবস্থা এখন বেহাল। কালের পরিক্রমায় এটি এখন জরাজীর্ণ। তবে রয়ে গেছে এর ভাবগম্ভীর ঐতিহ্য-সৌন্দর্য। প্রাচীন ঐতিহ্যের বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে।

 

যোগেশচন্দ্র রায়ের জমিদারপল্লী

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া গ্রাম। ১৮৩৪ সালে জমিদার যোগেশচন্দ্র রায় এ গ্রামে জমিদারি স্থাপন করেন। তার বংশের জমিদাররা শত বছর এ গ্রামে বসবাস করেন। পরবর্তীতে এখানে জমিদারি করেছেন জমিদার প্রসন্ন কুমার রায়বাহাদুর। যার জমিদারি বিস্তৃত ছিল দক্ষিণের মহেশখালী পর্যন্ত। ফলে গ্রামটিকে বলা হতো ‘জমিদারপল্লী’। জমিদারপল্লীটি ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ, লোকে লোকারণ্য। জানা যায়, বৈদ্য বংশের প্রখ্যাত জমিদার যোগেশচন্দ্র রায়ের পূর্ব পুরুষ ছিলেন দেওয়ান বৈদ্যনাথ। ১৬০০ শতকে এদের জমিদারির গোড়াপত্তন। চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার, দেওয়ানজি পুকুরপাড়, দেওয়ানহাট তার নামের সাক্ষী বহন করছে। জমিদার যোগেশচন্দ্র রায় ১৮৩৪ সালের দিকে মূল জমিদারি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী, জনদরদি, মহানুভব, দানশীল এবং বিলাসী প্রকৃতির। তাই ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দিয়েছিল। তার রাজপ্রাসাদটির আয়তন ছিল প্রায় ৪০ কানি। ১৮৫০ সালের দিকে প্রবল প্রতাপশালী জমিদার বৈদ্যনাথ দেওয়ানের আমল থেকে বাড়িটির বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয় বলে গবেষকরা মনে করেন। রাজপ্রাসাদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথে ছিল চারটি বলয়রেখা অঙ্কিত ও নানা নকশার তোরণ। আছে উঁচু উঁচু খুঁটি ও পুর্তগিজ সভ্যতার শৈলীশিল্পে করা নকশাখচিত তোরণ। ছিল বেলতলা পুকুরের মাঝখানে পিতলের তৈরি পান্থশালা। চারটি বড় বড় পুকুর, খেলার মাঠ, নাচঘর, খাজনাঘর, বৈঠকখানা, অভ্যর্থনা প্রাচীর, পুঁড়াবাড়ি, সিতলা মন্দির, জালাতনী মন্দির, দশভুজা মন্দির এবং বিশ্রামাগার। উত্তর পাশে সুউচ্চ গম্বুজসম্পন্ন মন্দিরের নিদর্শন। জনশ্রুতি আছে, জমিদার সেখানে বসে জ্যোৎস্না দেখতেন। বাড়ির ভিতরে আছে অসাধারণ সব কারুকাজ। ছাদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বড় বড় লোহার পাটাতন। জমিদারবাড়িতে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাওয়ার জন্য ছিল সাতটি তোরণ। রায়বাহাদুর প্রসন্ন কুমারের জমিদারি ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে যখন বিদ্যুৎ ছিল না, তখন জমিদার রায়বাহাদুর প্রসন্ন কুমারের বাড়িতে জেনারেটরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলত। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ আগে থেকে বিদ্যুৎ সম্পর্কে অবগত ছিল। জমিদার ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা। তার বাড়িতে কলকাতা থেকে নামকরা শিল্পীরা আসতেন। আগত শিল্পীরা গানের আসর বসাতেন। মহারাষ্ট্রের ধ্রুপদী গায়িকা কানন বালা ও কলকাতার বিখ্যাত নাট্যদল ‘নট্ট কোম্পানি’র দল জমিদারবাড়িতে জলসার আয়োজন করত। নামকরা শিল্পীদের আনাগোনায় গ্রামটিও প্রসিদ্ধি পায়। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসলও। প্রজাদের সুবিধার্থে খনন করেছিলেন অসংখ্য দীঘি, নির্মাণ করেছিলেন হাট-বাজার, ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তাঘাট ও বিদ্যালয়। তবে কালের ব্যবধানে সেই জৌলুস হারাচ্ছে জমিদারবাড়িটি। সাতটি তোরণের মধ্যে টিকে আছে দুটি। আছে তিনটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। খসে পড়ছে কিছু ভবনের চুন-সুরকি। ধ্বংস হয়ে যায় কয়েকটি ভবন। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা জমিদার ভিটায় টিকে আছে একটি বৈঠকখানা, বলি কাটার স্থান, ভগ্ন পুকুর ঘাট।

 

শ্রী রামধন জমিদারবাড়ি

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামের রামধন জমিদারবাড়ি। প্রাচীন কারুকাজ সংবলিত বিস্তৃত ভবন। আছে পুকুর, রামধর দীঘি, বাড়ির সামনে তোরণ, চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি কাচারিঘর, জমিদারের আনন্দ মহল, নাচখানা এবং বিশাল মন্দির। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত এই বাড়ির কর্তাদের আধিপত্য ছিল এলাকাজুড়ে। এলাকার জমিদারি ছিল বাড়িটির কর্ণধার রামধন জমিদারের হাতেই। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনা থাকত বাড়িটিতে। শ্রী রামধন জমিদার মারা যাওয়ার পর তার পুত্র কেশবচন্দ্র ধর জমিদারির হাল ধরেন। কেশবচন্দ্র ধর ১৯৫৫ সালের ৬ জুন মারা যান। এরপর থেকে ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে জমিদারিবাড়ির ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এর জৌলুস। বাড়িটির বার্ধক্যের ছাপ দৃশ্যমান। বর্তমানে দেয়ালের পলেস্তারা উঠে শেওলা জমেছে ভবনটির বিভিন্ন স্থানে। কর্মচাঞ্চল্যে ভরা বাড়িটি এখন কেবলই কংক্রিটের দালান। ঐতিহ্যময় ভবনটিজুড়েই এখন সুনশান নীরবতা। জমিদার রামধন ও রামগতি ধরের বংশধরের মধ্যে অনেকেই চট্টগ্রাম শহর ও ঢাকায় বসবাস করছেন। জমিদার বাড়িটির কিছু অংশ সংস্কার করে রামধনের নাতি-নাতনিসহ কয়েকজন এখনো বসবাস করেন এই বাড়িটিতে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিদারবাড়িটি রুপার থালা, বালতি, কেতলি ব্যবহারসহ অভিজাত শ্রেণির ভোগবিলাসিতায় ভরপুর ছিল। এলাকার মানুষের কাছ থেকে রুপার টাকায় খাজনা আদায় করতেন জমিদার। যারা খাজনা দিতেন তাদের জমিদারবাড়ি থেকে দেওয়া হতো একজোড়া নারিকেল, একবিড়া পান আর বাতাসা। ডাবুয়া জগন্নাথ হাট, ডাবুয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, চিকদাইর পুলিশ ফাঁড়ি ও রাউজান আরআরএসি মডেল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমিদার বংশের বিশেষ অবদান আছে।

 

 

মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন কাজীবাড়ি

বিস্তৃত পরিসর। দৈর্ঘ্যে ২০০ ফুট। ৬০ কক্ষের বিশাল প্রাসাদ। প্রতিটি ফটক তৈরি করা হয় লালবাগ কেল্লার আদলে। জমিদারি প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষের কার্নিশ, দেয়াল, দরজা, জানালার পরতে পরতে আছে মুঘল স্থাপত্যের ছোঁয়া। ‘মিয়া সাহেবের’ অনুমতি ছাড়া এ বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি মিলত না। পাড়া-পড়শীরা বাড়ির সীমানা পার হতেন জুতা খুলে। বাড়ির প্রবেশপথে আছে মুঘল স্থাপত্যের আদলে নির্মিত তিনটি গম্বুজ ও ১২টি মিনারযুক্ত মসজিদ। আড়াইশ বছর আগে তুর্কি প্রকৌশলীরা চুন-সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুরের কাজীরহাট বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটি টিলার ওপর নির্মিত বিখ্যাত জমিদার কাজী সাহাবুদ্দিন চৌধুরীর জমিদারিবাড়ির গল্প এটি। তবে বর্তমানে ৬০ কক্ষের প্রাসাদটি নেই। নেই জমিদারের সোনা-রুপাখচিত আলিশান চেয়ার। বাড়ির চারপাশের নেই পরিখা। প্রতি বছর এখন হয় না রাজপুণ্যাহ উৎসব। ধসে পড়েছে ছাদ। দেয়ালে নেই পলেস্তারা। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি দেয়াল। আগাছা-পরগাছায় ভরপুর। সংরক্ষণের অভাবে বিলীনের পথে স্থাপনাটি। শোনা যায়, এ বাড়িতেই তখন চলত বিভিন্ন অপরাধীর বিচার। দোষী সাব্যস্ত হলে ঝুলতে হতো ফাঁসিতে। বাড়িতেই ছিল ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসির মঞ্চটি ছিল গোলাকার। পাদদেশ থেকে এটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। পাটাতন ছিল মোটা সেগুন কাঠের। দুই জল্লাদ ফাঁসি দেওয়ার রশিটি বিভিন্ন তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি রাখতেন। ফাঁসি কার্যকরের পর লাশ ফেরত দেওয়া হতো পরিবারকে। গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর ‘প্রবন্ধ বিচিত্রা : ইতিহাস ও সাহিত্য’ বই থেকে জানা যায়, কাজী সাহাবুদ্দিন চৌধুরীর আদি পুরুষ ছিলেন মহব্বত সাধু। তিনি বাস করতেন গৌড় নগরে। সস্ত্রীক সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম এসে বসতি স্থাপন করেন ফেনীর দাঁদরায়। তার একমাত্র ছেলে সাদুল্লাহ।

সাদুল্লাহর তিন ছেলে- আনিস মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হোসেন ও কাজী সাহাবুদ্দিন চৌধুরী। কাজী সাহাবুদ্দিনের তিন ছেলে- কাজী হায়দার আলী চৌধুরী, কাজী আনসার আলী চৌধুরী ও কাজী হাসমত আলী চৌধুরী। কাজী হাসমত আলী চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। ‘চিন ফগফুর শাহ’ ও ‘আলিফ লায়লা’ নামে দুটি পুঁথি রয়েছে তার। ১৮৫৮ সালে তিনি এগুলো রচনা করেন। কবি কাজী হাসমত আলীর ঘরে জন্ম নেন ছয় ছেলে, চার মেয়ে। কাজী সাহাবুদ্দিন চৌধুরী ও তার বংশধররা পাঁচ পুরুষ প্রায় দুইশ বছর জমিদারি করেছেন। জমিদার কাজী হায়দার আলীর আমলে (১৭৬৫-১৮৪৫) মুঘল স্থাপত্য আদলে তৈরি হয় ২২টি মসজিদ, ২২টি কালভার্ট, ২২টি দীঘি। কাজী সাহাবুদ্দিন চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন ‘কাজীরহাট’ নামে বাজার।

 

পদুয়ার রামমোহন গুপ্ত এস্টেট

দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া তেওয়ারি হাট সংলগ্ন গুপ্ত এস্টেট জমিদারবাড়ি। প্রায় ১০ একর জমির ওপর এটি নির্মাণ করেন জমিদার রামমোহন গুপ্ত। নির্মিত ১২০টি কক্ষের স্থাপত্যশৈলী ছিল অপূর্ব। বলা যায়, প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো প্রাসাদসম অট্টালিকা এটি। বাড়ির প্রবেশমুখে কারুকাজ সংবলিত দীর্ঘ গেট। বাড়িটি দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগে বিশাল কাচারিঘর। এখানে বসে রামমোহন বিচারকার্য চালাতেন। অপর ভাগের পুরোটাই অন্দর মহল। সামনে বড় বারান্দা। রাজবাড়ির ভিতরে রয়েছে বিশাল মন্দির, পাঠশালাসহ নানা স্থাপনা। চুন-সুরকি এবং ইট দিয়ে তৈরি ভবনটি প্রায় ২৪ ইঞ্চি প্রস্থের দেয়ালের পিলারগুলো দ্বিতল ভবনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তিন পাশে বাড়ি ও একপাশে মন্দির। মাঝখানে খালি মাঠ। এর প্রতিটি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শৈল্পিক কারুকাজ। ১৭০০ সালে দ্বিতীয় মহারানী ভিক্টোরিয়া রামমোহন রায়কে এ সম্পত্তি দান করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, এ বাড়ি নির্মাণে বিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ। কাঠগুলো আনার জন্য খনন করা হয়েছিল ‘কৃষ্ণ খাল’ নামে একটি খাল। কাঠের বিমগুলোই ভবনকে শক্ত ভিত দিয়েছে। বাড়ির মাঝখানের মাঠে প্রতি বছর শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হতো। তাছাড়া জমিদাররা এখানে ঠাকুরদীঘি নামে বিশাল এক দীঘিও খনন করেছিলেন। এর আয়তন প্রায় ২২ দশমিক ৪৩ একর। বিশাল এ দীঘির নামেই পুরো এলাকার নামকরণ হয় ‘ঠাকুরদীঘি’ নামে। বান্দরবান জেলা ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া উপজেলার ৮০ শতাংশ জায়গা ছিল তার জমিদারির আওতায়। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে জমিদারবাড়ির জৌলুস। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বাড়িটি। ১২০ কক্ষের বাড়িতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ২০টি কক্ষ। বিশাল বাড়ির পশ্চিম পাশের ভবনটি ভেঙে একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণ পাশের দ্বিতল ভবনটি কোনোরকমে টিকে আছে। পূর্ব পাশের ভবনটির উত্তরাংশ ধসে পড়েছে। জনশ্রুতি আছে, এ বাড়ির সামনে দিয়ে একসময় কেউ জুতা পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে যেতেন না। স্বয়ং ব্রিটিশরাও এ জমিদারবাড়িকে সম্মান জানাত।

সর্বশেষ খবর