বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেশে দেশে

সাইফ ইমন

লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেশে দেশে

অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভ দমাতে ধরপাকড় জরিমানা

অস্ট্রেলিয়ায় লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দমাতে ধরপাকড় ও জরিমানা করা হয়েছে। দীর্ঘ লকডাউনে ক্ষিপ্ত অস্ট্রেলিয়াবাসী রাস্তায় নেমে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জারি সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। আর সমাবেশ বানচাল করতে প্রস্তুত থাকা দেশটির পুলিশ সদস্যরা সমাবেশ থেকে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারীকে ছত্রভঙ্গ করেন। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে এ বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ ছিল দেশটির ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নে কড়া লকডাউনে থাকা মানুষজনের।
এ সময় সরকারি নির্দেশ অমান্যের দায়ে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে দেশটির পুলিশ। অস্ট্রেলিয়ায় করোনা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মেলবোর্নে প্রায় ৩০০ মানুষ কঠোর লকডাউন জারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। এ ছাড়া সিডনি, ব্রিসবেন, অ্যাডিলেড এবং পার্থের মতো বড় শহরগুলোতেও বিক্ষোভ করেছেন লকডাউনবিরোধী মানুষজন। শুরুতে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী মেলবোর্ন শহরের প্রাণকেন্দ্র শ্রাইন অব রেমেমব্রেন্স থেকে আলবার্ট পার্ক লেকে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। নিষিদ্ধ অবস্থায় মেলবোর্নে সমাবেশ করার দায়ে কমপক্ষে ১৭ জনকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগও রয়েছে।
মেলবোর্নে বিক্ষোভকারীরা ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘মানবাধিকার গুরুত্বপূর্ণ’ এমন বিভিন্ন স্লোগান দেন। নগর পুলিশ জানিয়েছে, লকডাউন নিষেধাজ্ঞা না মানায় শহরজুড়ে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা ছাড়াও আরও দেড় শতাধিক মানুষকে জরিমানা করা হয়েছে। বাকি শহরগুলোতেও লকডাউন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ থেকে অনেককে গ্রেফতার ও জরিমানা করা হয়।


সিডনির হাইড পার্ক ও অলিম্পিক পার্কে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকেও বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। একই ঘটনা ঘটে ব্রিসবেনের বোটানিক গার্ডেনে, যেখানে শখানেক বিক্ষোভকারীর জমায়েত ঘটে। প্রায় ২০০ বিক্ষোভকারী সমাবেশ করেন অ্যাডিলেডে।
পার্থেও সমাবেশ আয়োজিত হয়, তবে কোনো আটকের ঘটনা ঘটেনি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শুক্রবার বলেন, দেশের আটটি রাজ্য ও অঞ্চলের মধ্যে সাতটি আগামী ডিসেম্বরে নিজেদের সীমান্ত ফের খুলে দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে।
দেশের পর্যটন খাত চাঙ্গা হলে ফের প্রাণ ফিরে পাবে অর্থনীতি।
তবে ভ্যাকসিন না এলে বছরের পর বছরজুড়ে এমন করেই জীবনযাপন করতে হতে পারে বলে দেশের মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।

 

জার্মানিতে করোনায় মাস্কবিরোধী বিক্ষোভ

বার্লিনে মাস্ক পরায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জার্মানির বার্লিনে করোনাভাইরাসের জন্য আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় ৩০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে দেশটির পুলিশ। আনসেল্ম লেনৎস নামের সাবেক এক সাংবাদিক প্রথম এমন বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন। লেনৎসের অভিযোগ, গণতন্ত্র বিলুপ্ত করতে জার্মান রাষ্ট্র বিভিন্ন ওষুধ ও প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বার্লিনের রোজা লুক্সেমবুর্গ চত্বরে ৪০ জন মানুষ জার্মানির প্রথম লকডাউন-বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। প্রথম বিক্ষোভের প্রায় এক মাস পর আয়োজিত আরেক বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১ হাজার জন হয়। তাদের কয়েকজন মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বিরুদ্ধে ‘ভ্যাকসিনেশন ডিক্টেটরশিপ’-এর অভিযোগ আনেন। বার্লিনের প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ শহরের রাস্তায় বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিক্ষোভ কর্মসূচি মূলত শান্তিপূর্ণই ছিল।

একটি র‌্যালি থেকে প্রায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যেখানে কট্টর ডানপন্থি দুষ্কৃতকারীরা পাথর ও বোতল ছুড়ে মেরেছে বলে অভিযোগ তুলেছে কর্তৃপক্ষ। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, করোনাভাইরাস এক ধরনের প্রবঞ্চনা।

 

মিছিল হয়েছিল আমেরিকাতেও

লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছিল আমেরিকাতেও। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন চালু করা নিয়ে শুরুতেই গড়িমসি করতে দেখা গিয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। পরে লকডাউনের বিরোধিতায় রাস্তায় নামলেন দেশটির জনগণ। যদিও কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লকডাউন উঠে যায় আরও আগেই। লকডাউনবিরোধী আন্দোলনের জেরে মিশিগান, ওহাইয়ো, কেন্টাকি, মিনেসোটা সর্বত্র ছবিটা বিপজ্জনক মনে করছিলেন গভর্নররা। টান পড়েছে বলেই তারা রাস্তায় নেমেছেন বলে দাবি একাংশের। এপ্রিল মাসে মিশিগানের রাস্তায় কয়েক মাইলজুড়ে দেখা গিয়েছিল গাড়ির লাইন। গাড়ি থেকে না বেরিয়ে এভাবেই ‘অপারেশন গ্রিড-লক’-এ নেমেছিলেন এই প্রদেশের একাংশ। তাদেরই একজন বলছিলেন, ‘যা দেখছি, তাতে এখানে আমরা যারাই এসেছি, সবাই আক্রান্ত হব। কিন্তু লকডাউন না উঠলে তো এমনিতেই মরতে হবে মনে হচ্ছে।’ করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে চললেও যুক্তরাষ্ট্রে এমন লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভে সবাই শুরুতে হতবাক হয়ে যান। যদিও পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আসছে ৩ নভেম্ভর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে দেশটিতে নির্বাচনী উত্তেজনা চলছে।

 

লন্ডনে ১৮ জনকে আটক করে পুলিশ, প্যারিসেও বিক্ষোভ

লন্ডনে লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ১৮ জনকে আটক করে পুলিশ। সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে যাওয়ার আগে বিক্ষোভকারীরা বাকিংহাম প্যালেসের বাইরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। কিছু বিক্ষোভকারীর হাতে ফ্রিডম বা স্বাধীনতা এবং অত্যাচার লেখা প্লাকার্ড দেখা যায়। পুলিশ জানায়, তারা বিক্ষোভকারীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানালে তারা তর্কে জড়িয়ে পড়েন। ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজে বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করা হলে সেখানে সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এখান থেকে অনেককে আটক করা হয়।

উল্লেখ্য, ব্রিটেনে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলে, স্থানীয়ভাবে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এমন কি লন্ডনে এ সপ্তাহের শুরু থেকে লেভেল-২ পর্যায়ের লকডাউন কার্যকর হয়েছে। এর ফলে ঘরে হাউসহোল্ড মিস্কিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইরে রুলস অব সিক্স কার্যকর করা হয়েছে এবং রাত ১০টার মধ্যে রেস্টুরেন্ট পাব বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শনিবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনার বিরোধিতায় সমাবেশ হয়েছে। এতে অন্তত ২০০ মাস্কবিরোধী বিক্ষোভকারী অংশ নেন। এ সময় তারা ‘স্বাস্থ্যের একনায়কতন্ত্রকে না’, ‘আমাদের শিশুদের শ্বাস নিতে দিন’ এ ধরনের  স্লোগান দেন। অন্যদিকে ভিয়েনা এবং জুরিখেও একই ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ বলেছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা ছাড়া তাদের হাতে কোনো পথ ছিল না। 

 

ইতালিতে বিক্ষোভ রূপ নেয় সহিংসতায়

ইতালিতেও চলছে লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ। অথচ ইউরোপের প্রথম করোনা এপিসেন্টার ছিল এই দেশ। সেখানে প্রায় ৫ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের সংক্রমণ এবং ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ করোনা। অথচ দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানার নির্দেশ আসতেই রোম নগরীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য মাস্ক বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে ইতালিতে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। রাজধানী রোমের কেন্দ্রস্থলে আয়োজিত এ বিক্ষোভে অংশ নেন প্রায় হাজারখানেক মানুষ। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের জন্য করোনা টিকা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলেন। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা মূলত ভ্যাকসিনবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট ও ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিলÑ ‘নো মাস্ক, নো সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’; ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয়’; ‘স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক’ ইত্যাদি স্লোগান। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, ইতালিতে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৩৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৫৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন দেশে ভাইরাস মোকাবিলায় বিধিনিষেধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর