মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

হোয়াইট হাউস দখলের লড়াই

তানভীর আহমেদ

হোয়াইট হাউস দখলের লড়াই

নিজেকে সেরা ভাবেন ট্রাম্প আরও চার বছর ক্ষমতা চান

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটকে পরাজিত করে তিনি ক্ষমতায় বসেন। সাধারণ জনগণের দেওয়া ৩০ লাখের বেশি ভোট পেলেও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যান হিলারি। ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পরপরই বিশ্বজুড়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। বরাবরই আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কারণে তিনি শিরোনাম হয়ে ওঠেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বিখ্যাত। ধনকুবের শিল্পপতি ট্রাম্পের ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্য। তার রয়েছে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখেন। নিউইয়র্কে বিত্তশালী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ফ্রেড ট্রাম্পের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সামরিক একাডেমিতে। এরপর পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন তিনি। তার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু হয় বাবার থেকে ঋণ নিয়ে। দশ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে তিনি রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

১৯৯৯ সালে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ আসে তার হাতে। নিউইয়র্কের কেন্দ্রে ম্যানহাটনের মতো ধনী এলাকায় রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা সম্প্রসারণের বড় উদ্যোগ নেন তিনি। একের পর এক গ্র্যান্ড হোটেল নির্মাণ করেন। ফিফথ এভিনিউতে নির্মাণ করেন ৬৮ তলার টাওয়ার। তার কোম্পানির নির্মিত অন্যান্য সুপরিচিত ভবনের মধ্যে রয়েছে ট্রাম্প প্যালেস, ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড টাওয়ার, ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেলসহ আরও কিছু ভবন। মুম্বাই, ইস্তাম্বুল ও ফিলিপাইনেও আছে ট্রাম্প টাওয়ার।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ কিছু হোটেল, ক্যাসিনো তৈরি করেছেন। বিনোদন জগতের ব্যবসাতেও তিনি এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিস ইউনিভার্স, মিস ইউ এস এ এবং মিস টিন ইউ এস এ সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন তিনি। টিভিতে রিয়েলিটি শো করে দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। শোবিজেও সফল হয়েছেন তিনি। রেসলিং ম্যাচও উপস্থাপনা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প তিনবার বিয়ে করেছেন। ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল না। তিনি আলোচনায় আসেন ২০০৮ সালে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে কিনা, তার এই প্রশ্ন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। ২০১৫ সালে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চান। সবাইকে অভিনব প্রচারণা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত টেড ক্রুজ ও মারকো রুবিওকে পেছনে ফেলে ইন্ডিয়ানা প্রাইমারির পর ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। তাকে ঘিরে স্ক্যান্ডাল, বিতর্ক থাকার পরও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি জিতে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট রাজনীতিতে যার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

 

ট্রাম্পের ব্যর্থতা সামলে আমেরিকানদের ভাগ্য গড়তে চান বাইডেন  

মার্কিন রাজনীতিতে পুরনো খেলোয়াড় জো বাইডেন। ৫০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছেন ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন।

বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাইমারিতে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও তাকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে। ভোটারদের সমর্থন আদায়ে প্রচারণায় বারবার তার মানবিক চ্যালেঞ্জের কথাগুলোই বলেছেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় তার ভূমিকা তুলে ধরেছেন তিনি। বাইডেন অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে টিকে থাকা একজন ব্যক্তি- তার ব্যক্তিত্বের এই বিষয়টি ভোটারদের আগ্রহী করে তুলেছে। তার ব্যক্তি জীবন নিয়ে মার্কিনিদের সহানুভূতি রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ডেলাওয়ারে মর্মান্তিক এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান তার স্ত্রী। জো বাইডেনের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। জো বাইডেনের কৈশোর কেটেছে পারিবারিক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে। পেনসিলভেনিয়ায় খুবই সাদামাটা এক বাসায় যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন তিনি। তার পরিবার ছিল খুব ধার্মিক। তোতলামি করতেন বলে সহপাঠী, শিক্ষকরাও তাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতেন। হাইস্কুল শেষ করে তিনি পড়তে যান ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে। উইলমিংটনে শুরু হয় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। নগর পরিষদের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজনীতিতে তার পথচলা। সিনেটে তার বিজয় ১৯৭২ সালে। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দুই মেয়াদে সিনেটর থাকা রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সিনেটে আসন জয় করেন। রাজনীতির অঙ্গনে তিনি হয়ে ওঠেন ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্ভাবনাময় তরুণ। ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমেও পরে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে বিশ বছর পর আবার নতুন করে লড়াইয়ে নামেন বাইডেন। সেবার বারাক ওবামা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পেয়ে চমকে দেন সবাইকে। বারাক ওবামা তার ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসেবে বেছে নেন জো বাইডেনকে। ওবামার জয়ের পর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী জোরদার করার এবং ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিপক্ষে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। বাইডেন পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক আমেরিকান সিনেট কমিটিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। সিনেটের এই কমিটির সভাপতি হিসেবে ২০১২ সালের অক্টোবরে আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ইরাক যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টিকে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার ওপর। এর ১১ বছর আগে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে সাদ্দাম  হোসেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুমোদনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অভিযোগে যখন ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব করেন, তখন বাইডেন তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন।

 

হাতির সঙ্গে গাধার ভোটযুদ্ধ

রিপাবলিকানদের ইতিহাস

ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি। আদর্শগতভাবে দলটি আগ্রাসী রাজনীতি করে থাকে। এবার এ দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান দল থেকে এ পর্যন্ত ১৯ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ আব্রাহাম লিংকন এ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার বিশ্বজুড়ে সমালোচিত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ এবং সিনেটে দলের সর্বাধিক আসন সংখ্যা রয়েছে রিপাবলিকানদের দখলে। ৯৮টি রাজ্যের মধ্যে ৬৮ রাজ্যের বিধানসভায় রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। দলটি ব্যবসায় বান্ধব, সমকামীদের অধিকার সম্পর্কিত সব আন্দোলনের বিরোধিতা করা ও আগ্নেয়াস্ত্র মালিকানা সম্পর্কিত অধিকার সমর্থন করে দেশব্যাপী সমর্থন আদায় করে থাকে।

 

ডেমোক্র্যাটিকদের ইতিহাস

আগ্রাসী রিপাবলিকানদের বিরোধিতার রাজনীতি করে যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের সমর্থন পেতে চায় ডেমোক্র্যাটিকরা। এবার ডেমোক্র্যাটিক দল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছেন জো বাইডেন। এই দল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন রুজভেল্ট, জন এফ কেনেডির মতো রাজনীতিবিদরা। বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামাও এ দলের রাজনীতি করেছেন। আদর্শগতভাবে দলটি সামাজিক স্বাধীনতা ও উন্নয়ন প্রচলনের রাজনীতি করে। ২০১০ সালের ১১০তম কংগ্রেস নির্বাচনে দলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারী বিচারসভা তথা কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও উচ্চকক্ষ সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।

 

ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই তাদের

ডোনাল্ড ট্রাম্পের রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়ছেন মাইক পেন্স।

আমেরিকার রক্ষণশীলদের কাছে পেন্সের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে।

৬১ বছর বয়সের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাইক পেন্স। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় বার্তা ব্যক্তিগত ইমেইলে ব্যবহার করে সমালোচিত হন। ইন্ডিয়ানা রাজ্যে জন্ম হয় মাইক পেন্সের। তার বাবা এডওয়ার্ড পেন্স যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পেন্স পরিবার ছিল ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থক। ১৯৮৮ সালে প্রথমবার কংগ্রেস সদস্য হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে হেরে যান পেন্স। দুই বছর পর ভোটে আবারও হেরে গিয়ে একটি রেডিওতে ‘দ্য মাইক পেন্স শো’ নামের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরু করেন।

১৯৯৯ সালে নির্বাচন করে সাফল্যের দেখা পান পেন্স। তারপর টানা ১২ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের সদস্য ছিলেন।

২০১৩ সাল থেকে চার বছরের জন্য ইন্ডিয়ানার গভর্নর নির্বাচিত হন মাইক পেন্স। রিপাবলিকান পার্টিতে তার প্রভাব ও জনপ্রিয়তা রয়েছে।

 

এ বছর প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে চেয়ে পরে তহবিলের অভাবে সরে যান ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ কমলা হ্যারিস। পরে জো বাইডেন তার রানিং মেট হিসেবে তাকে বাছাই করেন।  যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে কখনো দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনোটি থেকে অশ্বেতাঙ্গ কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে গ্রহণ করা হয়নি। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জয়লাভ করলে তা হবে নতুন ইতিহাস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনো কোনো নারী জয় লাভ করেননি। কমলা হ্যারিস ২০১৭ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন তিনি। হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড দ্য ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, হ্যাস্টিংস কলেজ অব দ্য ল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন কমলা হ্যারিস। বার পাস করার পর তিনি আলমেডা কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০০৩ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোর ২৭তম ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে নির্বাচিত হন।

 

 

পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আছে স্বতন্ত্র প্রার্থী

ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেনের লড়াইয়ের খবরের নিচে চাপা পড়ে যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের খবর। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের অতীত ইতিহাস বলছে, দল দুটির বাইরে মাত্র একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। তিনি হলেন জর্জ ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প আর বাইডেন ছাড়া অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। তবুও গণতন্ত্রের চর্চায় পিছিয়ে নেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব ধরলে প্রায় ১ হাজার ২১৬ জন প্রার্থী মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হতে ফেডারেল নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরই নির্বাচনী ইশতেহার আছে। কেউ কেউ নিজ অঙ্গরাজ্যের ভোট পাওয়ার ওপরই জোর দিয়েছেন। প্রচারণায় টাকাও ঢেলেছেন লাখ লাখ ডলার। অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর নাম বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্যালটে থাকেও না। মার্কিন নির্বাচনে বড় তহবিল ছাড়া প্রচারণা চালানো অসম্ভব বলা যায়। দাতারাও সব সময় বড় দুই দলকেই অর্থকড়ি দিয়ে শক্তিশালী করে তোলেন।

স্বতন্ত্রদের মধ্যে মোটামুটি সরব এমন তিনজনের কথা জানা যায় বিবিসির একটি রিপোর্টে। তাদের একজন কনসার্টের পিয়ানো বাদক, আরেকজন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী এবং অন্যজন ক্রিপ্টো বিলিওনিয়র। আমেরিকানরা কেন তাঁকে ভোট দেবেন, জানতে চাওয়া হলে কনসার্ট পিয়ানিস্ট ও সাবেক নারী মডেল জেড সিমনস বলেছেন, তিনি অর্থনৈতিক, শিক্ষা খাত ও বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা যেন সবাই পায়, তা নিশ্চিত করবেন। শুধু ওকলাহোমা ও লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ব্যালটে নাম থাকবে সিমনসের। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও ক্রিপ্টো বিলিওনিয়র ব্রক পিয়ের্স। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া নাভাজো সম্প্রদায়ের মার্ক চার্লস বলেছেন নাভাজোদের নিগৃহীত জীবনের দুঃখ-দুর্দশার কথা। পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার চার্লসের স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা নেহাত কম নয়।

 

মেলানিয়া ট্রাম্প ও জিল বাইডেনের অন্যরকম লড়াই

মেলানিয়া ট্রাম্প মার্কিন ফার্স্ট লেডি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মডেলিং শুরু করেন। তবে সুবিধা করতে পারছিলেন না। ১৯৯৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তারপর ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। ধনকুবের ট্রাম্প তাকে সুপার মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তার। ২০০৫ সালে বিয়ে করেন ট্রাম্পকে। কমিয়ে দেন মডেলিং। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের জয়, হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন সঙ্গে মেলানিয়া। অন্যদিকে জো বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেন। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন সেকেন্ড লেডি (ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে বাইডেনকে বিয়ে করেন তিনি। জিল বাইডেন উচ্চশিক্ষিত। পড়েছেন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। তিনি বেশ কয়েকটি অলাভজনক অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখান থেকে চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি প্রদান করেন। জো বাইডেন জিতলে জিল হবেন মার্কিন ফার্স্ট লেডি।

 

নির্বাচন ঘিরে জমজমাট অনলাইন জুয়া

কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে অনলাইনে সক্রিয় জুয়াড়িরা। সর্বশেষ জনমত জরিপ যাই বলুক, জুয়াড়িদের চাল ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে সাধারণ জনগণের ভোটও কোথাও কোথাও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চূড়ান্তভাবে ভোট দেয় ইলেকটোরাল কলেজ। আর এই অনিশ্চয়তার কারণেই জুয়াড়িদের বাজার গরম। অনলাইনে জুয়াড়িদের ভিড় বাড়ার কারণও এই ফাঁকফোকর।  জুয়ার দানে রীতিমতো বাজি ধরে বসে আছেন। এক্ষেত্রে এরই মধ্যে বাজি ধরার রেকর্ড গড়েছে ব্রিটিশ জুয়াড়িরা। খোদ ব্রিটেনের নির্বাচন বা কোনো স্পোর্ট বা খেলাধুলার ক্ষেত্রেও এমন দেখা যায়নি। ২২.০ কোটি পাউন্ড বা ২৮.৪ কোটি ডলারের বাজি ধরেছেন দেশটির জুয়াড়িরা। তা-ও আবার অনলাইনে জুয়া খেলার একটি মাত্র মাধ্যম বেটফেয়ারে এই পরিমাণ অর্থ পড়েছে হার-জিতের পর হাতবদলের অপেক্ষায়। জুয়াড়িদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকা লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বেটফেয়ারের মুখপাত্র ডেরন হ্যাগিস এই তথ্য প্রকাশ করেন। আর বাজি ধরে অর্থ হার-জিতের এই প্রতিযোগিতা নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে বলে জানান তিনি।

মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ধরা বাজির অর্থ এরই মধ্যে আগের মার্কিন নির্বাচনকেন্দ্রিক বাজির রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চার বছর আগে ট্রাম্প-ক্লিনটন লড়াইকে কেন্দ্র করে বাজিকররা ১৯.৯ কোটি পাউন্ডের বাজি ধরেছিলেন। আর ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ভোটাভুটি ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে বাজিকরদের হাত বদল হয়েছিল ১১.৩ কোটি পাউন্ড। বেটফেয়ার ধারণা করছে, এবারের মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরে ৪০ কোটি পাউন্ড হাতবদল করবেন জুয়াড়িরা। সংবাদমাধ্যমে খবর, জুয়াড়ি জেরি রেলি বাইডেনের পক্ষে বড় অঙ্ক হাঁকিয়েছেন। ভিক্টোরিয়া মার্কেল একজন বড় মাপের জুয়াড়ি। তিনি মনে করেন, এবার বাইডেন জিতবেন। তিনি বাইডেনের পক্ষে তিন লাখ ডলার বাজি ধরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অ্যালেন লিখটম্যান বলেছেন, এবার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন বাইডেন। ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের এই অধ্যাপক ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের ফল আগে থেকেই বলে দিয়েছেন।

 

ভোটের হিসাব

৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ৪৩৫টি রিপ্রেজেনটেটিভ, ১০০টি সিনেটর (৫০ অঙ্গরাজ্য থেকে) এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ৩টি ইলেকটোরাল ভোট। প্রেসিডেন্ট হতে হলে লাগবে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট।

 

সর্বশেষ জরিপ

‘সুইং স্টেট’ মিশিগান ও উইসকনসিনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে বাইডেন। এই দুই রাজ্যে গত নির্বাচনে জিতেছিলেন ট্রাম্প। অ্যারিজোনা ও নর্থ ক্যারোলাইনায় লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।

 

আগাম ভোট

ইতিমধ্যে ১০ কোটিরও বেশি ভোটদাতা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়ে ফেলেছেন। করোনাকালে তারা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে নিরাপদে ভোট দেওয়া পছন্দ করেছেন। তার মানে ২০১৬-তে যত ভোট পড়েছিল, তার দুই তৃতীয়াংশ ভোট ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে।

 

আসল ভোটযুদ্ধ যেসব অঙ্গরাজ্যে

 

মার্কিন নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারিত হয় ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেট বলে খ্যাত অঙ্গরাজ্যগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের আধিপত্য আছে এমন অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোট নড়চড় হওয়ার নজির কম। দলীয় প্রার্থীরা সহজেই এসব রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটগুলো পেয়ে যান। কিন্তু কিছু অঙ্গরাজ্য রয়েছে যেগুলোতে কারও একক আধিপত্য নেই। এসব অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট বাগিয়ে নিতে পারলেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ সহজ হয়ে যায়। এই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয়-পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। এই রাজ্যগুলোতেই হয় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এসব রাজ্যেই প্রচারণার বিনিয়োগ ও ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এসব রাজ্যেই ঘন ঘন চলে প্রার্থীদের আনাগোনা, তাদের প্রচারণা সমাবেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে, এই স্টেটগুলোতে অনেক ভোটারই কোনো একটি দলের কট্টর সমর্থক নন এবং প্রার্থীদের নীতিমালা এবং আগামী চার বছরের জন্য প্রার্থীদের পরিকল্পনার বিচারে তারা শেষ মুহূর্তে ভোট দেন। গত কয়েকটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে অঙ্গরাজ্যগুলোর দোদুল্যমান ভোট প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জয়-পরাজয় নিশ্চিত করেছে সেগুলোর মধ্যে ছিল কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইসকনসিন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর