বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ফলাফল নিয়ে যত কাহিনি

সাইফ ইমন

ফলাফল নিয়ে যত কাহিনি

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থার ইতিহাস অনেক পুরনো। অন্যসব দেশের চেয়ে বেশ আলাদা। সেই সঙ্গে তা অনেক ঘটনাবহুল। নির্বাচনে তৈরি হয়েছে নানা বিপত্তি, ঘটেছে বিস্ময়কর সব ঘটনা। সব সময় এই নির্বাচন সরলভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রায় ২৫০ বছরের মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা নিয়ে আজকের রকমারি

 

নির্বাচনে কম ভোট পেয়েও জয়ী

বেশি ভোট পাওয়ার পরেও কোনো প্রার্থীর পরাজয়ের ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো হলেও সত্য। ১৮৭৬, ১৮৮৮, ২০০০ এবং ২০১৬ সালে যে প্রার্থীরা জনগণের ভোট বেশি পেয়েছিলেন (পপুলার ভোট), ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পাওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি। অনেকবার ইলেকটোরাল কলেজের ভোটিং পদ্ধতির বাইরে জনভোটের বিচারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তাব আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে কিন্তু কোনোবারই তা পাস হয়নি। ১৯২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে চারজন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছিলেন। সেই ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হন জন কুইন্সি অ্যাডামস। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সেবারই সাধারণ ভোট ও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে সংখ্যাধিক্য থাকার পরেও পরাজিত হয়েছিলেন কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।

 

 

ফলাফলে দ্বিধাবিভক্ত জাতি

নির্বাচনে লিঙ্কন জয়ী হওয়ার সপ্তাহখানেক পরেই সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য ভোট দেয়। তাদের সমর্থন করে অন্যরা

১৮৬০ সালে নির্বাচন ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে আমেরিকান জাতি। এ সময় রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন। ফলে দাসপ্রথার পক্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্যের ব্যালটে তার নামই ছিল না। এই নির্বাচনে লিঙ্কন শতকরা ৪০ ভাগ পপুলার ভোট পান। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া ও অরেগন অঙ্গরাজ্যসহ উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ইলেকটোরাল ভোট তিনি জয় করেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮০টি ইলেকটোরাল ভোটের বিপরীতে স্টিফেন ডগলাস মাত্র ১২টি পেয়েছিলেন। এই নির্বাচনে পপুলার ভোটে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও ইলেকটোরাল ভোটে ব্রেকেনরিজের চেয়েও পিছিয়ে পড়েছিলেন ডগলাস। নির্বাচনে পপুলার ভোটে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ৭২টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন ব্রেকেনরিজ। নির্বাচনে লিঙ্কন জয়ী হওয়ার সপ্তাহখানেক পরেই সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য ভোট দেয়। দক্ষিণাঞ্চলের আরও ছয়টি রাজ্য সাউথ ক্যারোলিনাকে অনুসরণ করে।

 

দুই বছর মিলিয়ে ভোট গ্রহণ!

‘দুই বছর ধরে’ ভোট গ্রহণ চলছে এ কথা শুনে অনেকেই হয়তো অবাক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভসের তথ্য অনুযায়ী, ১৭৮৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৭৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ দিন ধরে ওই নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়।

অর্থাৎ এক বছরে ভোট শুরু হয়ে শেষ হয় আরেক বছরে এসে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই একবারই দুই ক্যালেন্ডার বছরজুড়ে নির্বাচন হয়েছিল। তখনকার ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোট ছিল ৬৯টি, এখন যা ৫৩৮টি। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতা হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন সব ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জন অ্যাডামস ৩৪টি ভোট পেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

 

 

সমান ভোটে বিপত্তি

ফলে কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার গিয়ে পড়ে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ওপর। সাত দিন ধরে ৩৫ দফা ভোটাভুটিতেও কোনো সমাধান আসেনি।

সমান ভোট নিয়ে বিপত্তি ঘটে ১৮০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এবং অ্যারন বার। আর ফেডারেলিস্টদের প্রার্থী ছিলেন সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস আর চার্লস সি পিঙ্কনি। রিপাবলিকানরা চাইছিলেন যে, তাদের দুই প্রার্থীর মধ্যে জেফারসন কিছু ভোট বেশি পাবেন আর অ্যারন বার একটি হলেও কম। তাহলে একজন প্রেসিডেন্ট, আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে দুজনের ভোট সমান, ৭৩ ভোট হয়ে যায়। ফলে কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার গিয়ে পড়ে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ওপর। সাত দিন ধরে ৩৫ দফা ভোটাভুটিতেও কোনো সমাধান আসেনি। শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডার হ্যামিলটন কয়েকজন ফেডারেলিস্ট প্রতিনিধিকে জেফারসনকে সমর্থন করাতে রাজি করাতে সক্ষম হন। টমাস জেফারসন প্রেসিডেন্ট হন আর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান অ্যারন বার।

 

সংকটে কমিশন গঠন

কমিশন করে প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ করার ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৭৬ সালের নির্বাচনকে বলা হয় আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেছিল রাদারফোর্ড বি হেইসকে আর ডেমোক্র্যাটরা মনোনীত করেছিল স্যামুয়েল জে টিলডেনকে। নির্বাচিত হওয়ার জন্য টিলডেনের দরকার ছিল এক ভোট আর হেইসের দরকার ছিল ২০টি ভোট। আর বাকি ২০টি ভোট উভয় দলই নিজেদের বলে দাবি করে। সংকট সমাধানের জন্য একটি আইন পাস করে ১৫ সদস্যের নির্বাচনী কমিশন গঠন করা হয়। শেষ পর্যন্ত কমিশনের আট-সাত ভোটের ব্যবধানে ২০টি ইলেকটোরাল ভোট হেইসকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সিদ্ধান্তে ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ নির্বাচিত হন। ভোটাভুটি হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট আল গোর পেয়েছিলেন ২৬৭ ইলেকটোরাল ভোট আর রিপাবলিকান বুশ পেয়েছিলেন ২৪৬ ভোট। শুধু ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ২৫টি ভোট বাকি ছিল। সেখানে দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান এত কম ছিল যে, সপ্তাহের পর সপ্তাহজুড়ে ভোট গণনা চলছিল। পুনরায় গণনার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট বুশকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করার রায় দেয়।

 

বিশ্বকে অবাক করেছিলেন ট্রাম্প

ট্রাম্পের আমেরিকা জয় সত্যিই বিশ্বয়কর ঘটনা। এর আগে কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা না থাকা ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনে হোয়াইট হাউসে যাওয়া নিশ্চিত করেছেন সাবেক ফার্স্টলেডি ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৮৩ বছর পর নতুন একজন প্রেসিডেন্ট এলেন, যার রাজনৈতিক পদে দায়িত্ব পালনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এর আগে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন সাবেক গভর্নর, সিনেটর কিংবা পাঁচতারকা জেনারেল। অভিবাসী, মুসলমান ও নারীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সমালোচনা, একের পর এক নারীর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ, রিপাবলিকান পার্টির অনেক রথী-মহারথী সমর্থন প্রত্যাহার এবং অনেক বিশ্বনেতা ও বুদ্ধিজীবীর প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশের কারণে ট্রাম্পের পক্ষে বাজি ধরার লোকেরও অভাব ছিল। ভোটের আগে সর্বশেষ জনমত জরিপে হিলারিকেই এগিয়ে রেখেছিল বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএনের জনমত জরিপ। কিন্তু রিয়েল এস্টেট, এনটারটেইনমেন্ট ও স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রির সফল ব্যবসায়ী ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ফিরিয়ে আনার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার কাছে মিথ্যা হয়ে গেছে অন্য অনেক কিছু।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি হবেন ‘সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট’। আমেরিকাকে তিনি ‘শীর্ষে’ রাখবেন সব সময়। দুই যুগের বেশি সময় ধরে আমেরিকার রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে বিচরণ করা হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন বলে আশা করেছিলেন সমর্থকরা। তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

 

হেডকোয়ার্টার যখন কারাগার

কারাগার থেকে প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচন করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন ইউজেন ডেবস। সেবার নির্বাচনে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন প্রার্থী ইউজেন ডেবস। তিনি আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০০, ১৯০৪, ১৯০৮ ও ১৯১২ ১৯২০ সালের নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ইউজেন ডেবস। ১৯১২ সালের নির্বাচনে ৬ শতাংশ পপুলার ভোট তথা ৯ লাখেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। পঞ্চমবারের মতো অংশ নিয়ে ইউজেন ডেবসের নির্বাচনী প্রচারণার হেডকোয়ার্টার ছিল জেলখানা। ঘটনা আসলেই তাই। কারণ ডেবস তখন জেলখানায় বন্দী ছিলেন। ১৮৯৪ সালে রেললাইন অবরোধ ছাড়াও ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তিনি মার্কিন সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয় এবং বিচারে তার ১০ বছরের কারাদন্ড হয়।

 

নির্বাচনে না জিতেও প্রেসিডেন্ট

আজ অবধি জেরাল্ড আর ফোর্ডই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো নির্বাচনে না জিতেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে। আমেরিকার ৩৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘটনাটি সত্যিই অভূতপূর্ব। ইতিহাসে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি। ভাগ্য যেন জেরাল্ড ফোর্ডকে টেনে এনেছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। আর তাতে হোয়াইট হাউসের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেরাল্ড আর ফোর্ড। আমেরিকার ইতিহাসে তিনি একজন ভাগ্যবান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। প্রথমবার কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়াই ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত হন। সে সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো ইগ্নেউ পদত্যাগ করেছিলেন। নতুন পদে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বছর না পেরোতেই আবার ভাগ্য খুলে যায় জেরাল্ড ফোর্ডের। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগের পর তিনিই গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব। মূলত আমেরিকার ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী নির্বাচন ছাড়া প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত হন জেরাল্ড আর ফোর্ড। জেরাল্ড আর ফোর্ড ১৯৭৪ সালে ৩৮তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় ঘোষণা করেছিলেন, আমি অসাধারণ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেছি। মজার বিষয় হলোÑ আজ অবধি তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো নির্বাচনে না জিতে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর