রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পাইপলাইনে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইতিহাসের পাতা থেকে

পৃথিবীর বুকে পাইপলাইনের ব্যবহার শুরু হয় অতি প্রাচীনকাল থেকে। বিভিন্ন সূত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও মিসরীয় সভ্যতায় কাদামাটির তৈরি পাইপ ব্যবহার করে পানি সরবরাহ এবং অপ্রয়োজনীয় পানি অপসারণ করার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর মধ্য আমেরিকায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০-২৫০ অব্দে মায়ান সভ্যতায় এবং পরবর্তীতে চীনের হান শাসনামলে অভিজাত পরিবার ও রাজপ্রাসাদে পানি সরবরাহের জন্য পাইপ ব্যবহৃত হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। কাদামাটির পাইপ ছাড়াও পাথরের বুকে খোদাই করে পাইপের আকৃতি প্রদান এবং বাঁশের ভিতর ছিদ্র করে পানি সরবরাহের প্রচলনও শুরু হয় প্রায় একই সময়ে। পরবর্তীতে ধাতব পদার্থ বিশেষত লোহার আবিষ্কার পাইপ নির্মাণ প্রযুক্তি ও পাইপের ব্যাপক ব্যবহারে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করে। পাইপলাইনের মাধ্যমে খনিজ তেল সরবরাহ শুরু হয় ১৮০০ সালের পর থেকে বা ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তারও পরে শুরু হয় প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালনের জন্য পাইপের ব্যবহার। বলা চলে প্রায় একই সময় থেকে পাইপলাইন জমিতে বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৮৩৪ সালে আমেরিকায় কাস্ট আয়রনের পাইপযোগে তেল ও গ্যাস সরবরাহের প্রচলন ঘটে।  তার কিছু দিন পর থেকেই পাইপলাইন বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনা বিশ্বে প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়।

 

ভয়াবহতম পাইপলাইন বিস্ফোরণ

রাশিয়া (১৯৮৯)

পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহতম পাইপলাইন বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৮৯ সালের ৪ জুন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) ইউফা শহরের নিকটবর্তী পাশাপাশি দুটি রেললাইনের ওপর। ইতিহাসের পাতায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ‘ইউফা ট্রেন দুর্যোগ’ বা ‘ইউফা ট্রেন ডিজাস্টার’ নামে পরিচিত। রাশিয়ার রেল সংস্থা ট্রান্স সাইবেরিয়ার দুটি পাশাপাশি রেললাইন সাইবেরিয়ার নভোসিরিয়স্ক অঞ্চল থেকে ইউফা শহরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ রাশিয়ার বিভিন্ন জেলাকে সংযুক্ত করেছে। দুর্ঘটনা স্থলের অর্থাৎ রেললাইনের প্রায় ৫০০ মিটার দূরে গ্যাস পাইপলাইন ছিল। এই পাইপলাইন দিয়ে উচ্চচাপে লিকুইড নেচারাল গ্যাস (এলপিজি) বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হতো। বিভিন্ন কারণে উক্ত গ্যাস লাইনের দুর্ঘটনাস্থলে লিক বা ছিদ্র দেখা দেয়, এই ছিদ্র দিয়ে ক্রমেই গ্যাস বের হতে থাকে এবং আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে কন্ট্রোল রুমে গ্যাসের চাপ কম দেখা যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ক্রমেই গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে আরও দ্রুত গ্যাস বের হতে থাকে এবং আবহাওয়া পারিপার্শ্বিক ভূ-প্রাকৃতিক কারণে তা কু-লী আকারে রেললাইন ও তার অংশ আশপাশে মেঘ আকারে জমা হয়। ৪ জুন ১৯৮৯ তারিখে ঠিক ওই স্থান দিয়ে পাশাপাশি অতিক্রম করছিল যাত্রীভর্তি দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন। সাধারণত এই সময়ে কৃষ্ণ সাগরের পাড়ে ভ্রমণ ও সামার ক্যাম্প করার জন্য ওই ট্রেন লাইন দিয়ে অসংখ্য পর্যটক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন।

সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পাশাপাশি দুটি ট্রেন জমাট বাঁধা গ্যাসের কুন্ডলী অতিক্রম করার সময় ট্রেনের চাকা ও রেললাইনের মধ্যে সৃষ্ট ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন আগুনের কারণে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটায়। মুহূর্তেই এই আগুন ব্যাপক আকারে দুটি ট্রেনসহ আশপাশের এলাকায় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ও ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনই ছিটকে পড়ে এবং দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত দুটি আণবিক বোমার ক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ১৫ ও ১০ হাজার টিএনটি। আর ইউফা ট্রেন দুর্ঘটনার স্থলে তার অর্ধেক প্রায় পাঁচ হাজার টিএনটি ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটে। বিভিন্ন সূত্রে এ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী ও আহতদের বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যায়। কারণ আগুনের ভয়াবহতায় প্রকৃত অর্থে গণনা করার মতো মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল।

তবে উইকিপিডিয়া মতে, এই ট্রেন দুর্ঘটনায় উভয় ট্রেনেরই দুটি ইঞ্জিন লেকোমোটিভ ও মোট ৩৮টি যাত্রীবাহী বগি লাইনচ্যুত হয় ও পুড়ে যায়। এতে প্রাণ হারায় অন্তত ৬৪৫ জন। অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি এবং আহত সংখ্যা ১২০০ বলে উল্লেখ করা হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং রাষ্ট্রীয় শোক  ঘোষণাসহ উদ্ধার ও পুনর্বাসন কাজে নেতৃত্ব দেন।

 

প্রতি বছর দুর্ঘটনা ঘটে নাইজেরিয়ায়

বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নাইজেরিয়া। সুশাসনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও দেশটিতে রয়েছে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ। যার অন্যতম খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। নাইজেরিয়া সরকারের মোট আয়ের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৯০ শতাংশ অর্জিত হয় খনিজ তেল ও গ্যাস থেকে। দেশটির অ্যানভায়রনমেন্টাল রিসোর্সেস ম্যানেজার্স লিমিটেড নামক সরকারি দফতর সূত্রে আরও জানা যায়, নাইজেরিয়ায় রয়েছে ১৫৯টি তেল ক্ষেত্র (খনি) এবং ১ হাজার ৪৮১টি তেলের কূপ। এসব খনি থেকে কূপের মাধ্যমে উত্তোলনকৃত জ্বালানি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং প্রতিবেশী আলজেরিয়া ও ঘানায় সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাস সমুদ্রবন্দরে আনা হয় এবং তেল ও গ্যাসবাহী জাহাজে তা আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। তাই দেশটিতে জালের মতো বিস্তৃত রয়েছে বিভিন্ন আয়তন ও দৈর্ঘ্যরে তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন কারণে দেশটিতে তেলের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত বা বা ছিদ্র করে তেল চুরির ঘটনা দেশটির একটি ভয়াবহ সমস্যা। দেশটির কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে নাইজেরিয়ান ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সূত্র দাবি করে, ২০১৬ সালে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত বা ছিদ্র করে প্রতিদিন প্রায় সাত লাখ ব্যারেল তেল চুরি হয়। নাইজেরিয়ার কিছু কিছু খনির তেল এত উন্নত যে, স্থানীয়ভাবে সামান্য চেষ্টাতেই অপরিশোধিত তেল উন্নতমানের ব্যবহারযোগ্য তেলে পরিণত হয়। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কুচক্রী মহল চোরাই তেল ক্রয়ে সক্রিয় রয়েছে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে তেলের পাইপলাইন ছিদ্র করে তেল চুরির ঘটনা নাইজেরিয়ার একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

তবে প্রবাহমান তেলের পাইপে রাতের আঁধারে বা দিনে-দুপুরে বন জঙ্গলে স্থানীয়ভাবে ছিদ্র করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। রিসার্চ গেইট নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রবন্ধ মতে, সত্তর দশকের শেষভাগে নাইজেরিয়ার তেলের পাইপলাইন ছিদ্র এবং এ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার তথ্য জনসম্মুখে আসতে শুরু করে। ১৯৭৬ থেকে ৮০ সালের মধ্যে ৭৮৪ বার তেলের পাইপলাইন থেকে অবৈধভাবে তেল সংগ্রহের ঘটনা ঘটে। শুধু ১৯৮১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) ১২১ বার তেল চুরির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় একদিকে লাখ লাখ ব্যারেল তেল নষ্ট হয় এবং প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। অন্যদিকে এর ফলে প্রাণ হারাতে থাকে হাজার হাজার নাগরিক। এসব দুর্ঘটনার মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর জনবহুল শহর লাগোস থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে জেসি নামক স্থানের বিস্ফোরণ। ওই এলাকায় ছিল নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেলের পাইপলাইন, যা দূরবর্তী তেল খনি থেকে স্থানীয় তেল শোধনাগারে তেল সরবরাহ করত। সরকারি তথ্য মতে, সংঘবদ্ধ একটি চক্র অবৈধভাবে তেল সংগ্রহের জন্য তেলের পাইপলাইনে গোপনে ছিদ্র করার সময় আগুনের সূত্রপাত ঘটে মুহূর্তেই আশপাশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর গ্রেফতারের ভয়ে অগ্নিদগ্ধ ও আহত অনেকেই পালিয়ে যায়। ফলে পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে ঘটনার পরপরই একটি গণকবরে প্রায় ৩০০ লাশ সমাহিত করা হয়। অন্য সূত্রমতে, চুরির ঘটনায় বরং ক্ষতিগ্রস্ত পুরনো পাইপলাইন থেকে এমনিতেই তেল বের হচ্ছিল। পরবর্তীতে সিগারেট ধরানোর সময় অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। এতে মৃত্যুবরণ করেন মোট ১০৮২ জন। লাগোস শহরের অপরপ্রান্তে আবুলে এগবা নামক স্থানে ২০০৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঘটে আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রেও সংঘবদ্ধ তেল চোরেরা তেলের একটি পাইপলাইন ছিদ্র করে ফেলে। এরপর প্লাস্টিকের জ্যারিকেন ভরে রাতভর তেল চুরির উৎসব চলে। এমনকি চোরাই তেল ক্রয়ের জন্য তেলের লরি (তেলবাহী গাড়ি) আসতে থাকে ঘটনাস্থলে। সকালের দিকে অজ্ঞাত কারণে ঘটনাস্থলে আগুন ধরে যায় এবং স্থানীয় গ্রাম, মসজিদ, চার্চ ও বসত এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতারের ভয়ে যথারীতি পালিয়ে যায় আহতরা। ফলে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা জানা না গেলেও তা পাঁচ শতাধিক বলে ধারণা করা হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একজন ফটো সাংবাদিক ঘটনাস্থলে প্রায় ৫০০ মৃতদেহ দেখেছেন বলে দাবি করেন। চলতি বছর জানুয়ারি মাসেও তেল চুরির ঘটনা থেকে সৃষ্ট আগুনে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে।  এভাবে মৃত্যুর মিছিল লেগেই থাকে নাইজেরিয়ায়।

 

মানুষ যেন চুলার জ্বালানি কাঠের মতো জ্বলছিল

কেনিয়া (২০১১)

বস্তি এলাকায় আগুনের গোলক বা ফায়ার বল পড়তে থাকে এবং এ থেকে সৃষ্ট আগুন তাৎক্ষণিকভাবে কেড়ে নেয় শতাধিক প্রাণ। তবে প্রকৃত পক্ষে এই করুণ ঘটনায় ঠিক কতজনের প্রাণহানি ঘটেছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ আগুনে পোড়া অনেক মৃতদেহই ঘটনার পর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী নদীতে ভাসতে দেখা যায়

২০০৯ সালটি কেনিয়ার জন্য ছিল এক বিভীষিকাময় বছর। এ বছরের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখ কেনিয়ার মলো এলাকায় একটি তেলের ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং রাস্তার পাশে উল্টে যায়। এতে ট্যাঙ্কারের জ্বালানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। আর সেই তেল সংগ্রহ করতে স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ও রান্নাঘরের তৈজসপত্র নিয়ে ভিড় করেন। এই ফাঁকে সম্ভবত কোনো একজনের সিগারেটের আগুন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরিত হয়। ফলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান অন্তত ১১৩ জন আর আহত হন ২০০ জন। এ ঘটনার ঠিক তিন দিন আগে অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি ২০০৯ সালে কেনিয়ার নাকুমাট সুপার মার্কেটে আগুন লেগে মারা যান ২৯ জন।

২০০৯ সালের এই শোক ভোলার আগেই ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর (৯/১২) কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির সিটি সেন্টার ও বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করা তেলের পাইপলাইনে এক প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল লুঙ্গা। লুঙ্গা শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত সিনাই বস্তি এলাকা। এদিন সকালে বস্তি এলাকার নিচে পাইপলাইনের ছিদ্র বা ফাটা অংশ থেকে জ্বালানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে পাশের ড্রেনে। আর এই তেল সংগ্রহের জন্য সেখানে ভিড় জমায় শত শত বস্তিবাসী। ঠিক তখন নিকটবর্তী একটি নদীর তীরে নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে শহরের আবর্জনা পোড়ানো হচ্ছিল। আবর্জনা পোড়ানোর আগুন থেকে (মতান্তরে সিগারেটের আগুন থেকে) ড্রেনে বহমান জ্বালানিতে আগুন লেগে যায় এবং মুহূর্তেই তা তেল সরবরাহের মূল পাইপলাইনে পৌঁছে যায়। এর ফলে বিকট শব্দে পাইপলাইনের একটি অংশ বিস্ফোরিত হয় এবং আশপাশের এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বস্তি এলাকায় আগুনের গোলক বা ফায়ার বল পড়তে থাকে এবং এ থেকে সৃষ্ট আগুন তাৎক্ষণিকভাবে কেড়ে নেয় শতাধিক প্রাণ। তবে প্রকৃত পক্ষে এই করুণ ঘটনায় ঠিক কতজনের প্রাণহানি ঘটেছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ আগুনে পোড়া অনেক মৃতদেহই ঘটনার পর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী নদীতে ভাসতে দেখা যায়।

রাজধানী নাইরোবিতে অবস্থিত কেনিয়াট্টা ন্যাশনাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মোট ২২টি শয্যা থাকলেও নানা মাত্রার ক্ষত নিয়ে সেখানে ভিড় জমান শত শত আগুনে পোড়া রোগী। ফলে ডাক্তার, নার্স ও ওষুধের তীব্র সংকটের পাশাপাশি চিকিৎসাসামগ্রী ও রক্তের সংকট দেখা দেয়। হাসপাতালেই প্রাণ হারান অনেকে। আর শত শত মানুষ আগুনে পোড়া অঙ্গ এবং সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছে। তাদের মতে, মানুষ যেন চুলার জ্বালানি কাঠ বা লাকড়ির মতো জ্বলছিল, যাদের অনেকেই ছিল স্কুলের পোশাক পরা শিশু।  অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী স্কুলের শত শত শিশুকে শিক্ষকরা দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিলে তারা প্রাণ বাঁচলেও ফিরে পায়নি তাদের নিজ বাড়িঘর কিংবা প্রিয়জনদের।

 

নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণ (২০২০)

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে বিচ্ছিন্নভাবে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিভিন্ন স্থানে গ্যাস অনুসন্ধান ও সীমিত আকারে প্রাপ্তির তথ্য পাওয়া যায়। তবে ১৯৬২ সালে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর দিয়ে প্রবহমান তিতাস নদীর তীরে বিপুল গ্যাস মজুদের নিশ্চিত খবরে সমগ্র প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। এই গ্যাস মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছতে লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের বাসায় প্রথম আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। একই বছর (১৯৬৮) ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের ৫৮ মাইল দীর্ঘ তিতাস-ডেমরা সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে সিদ্ধিরগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে শুরু হয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বলাবাহুল্য, প্রাথমিক অবস্থায় অজ্ঞতা ও ভীতির কারণে গ্যাস সংযোগের প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। পরবর্তীতে বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলাসহ বেশ কিছু স্থানে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, সঞ্চালন লাইন বৃদ্ধি ও আবাসিক ক্ষেত্রে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে মানুষের ভীতি ক্রমেই দূর হয়ে যায়। বরং সমূহ বিপদ জেনেও কেবল আর্থিক লাভের আশায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নেওয়ার এক ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা। দেশের প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে তাই গ্যাস পাইপলাইনে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের বহু ঘটনা ঘটে। এসবের মধ্যে এ বছর নারায়ণগঞ্জের মসজিদে গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ছিল করুণতম।

প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ শুক্রবার রাতে এশার নামাজ আদায় করার পর মোনাজাত চলাকালে মসজিদের ভিতরে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, মসজিদে ব্যবহৃত ছয়টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়ে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। যার ফলে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ প্রায় অর্ধশত এলাকাবাসী নানা মাত্রায় দগ্ধ হন এবং আহত হন। একবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর আবার বিদ্যুৎ ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে বলে জানান স্থানীয়রা। এ ঘটনায় মারাত্মক আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। বাকিরা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিতে থাকেন। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস, অগ্নিনির্বাপণের পর মসজিদের মেঝের ফাঁক বা ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয় বলে ধারণা করা হয়, এসি চালানোর জন্য মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা হলে ধীরে ধীরে আবদ্ধ মসজিদে গ্যাস জমা হতে থাকে এবং হঠাৎ বিদ্যুৎ আসায় স্পার্কিং থেকে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত এ ঘটনায় ৩৫ জনের অগ্নিদগ্ধজনিত কারণে মৃত্যু ঘটে। এই করুণ ঘটনার নেপথ্য কাহিনি এবং পরবর্তীতে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও বেশ করুণ। প্রাথমিকভাবে মসজিদ কমিটি এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার পেছনে একে অন্যকে দায়ী করে। তবে জেলা প্রশাসনের তদন্তে উভয়পক্ষকেই দায়ী করা হয়। জানা যায়, উক্ত স্থানে মসজিদ নির্মাণের কোনো বৈধতাই ছিল না মসজিদ কর্তৃপক্ষের। যে কারণে গ্যাস পাইপলাইনের ওপর গড়ে ওঠে এই বায়তুস সালাত মসজিদটি। তদুপরি মসজিদে ছিল অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ, যা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অন্যদিকে মসজিদ কমিটির অভিযোগ, মসজিদে গ্যাসের গন্ধ বা পাইপ ছিদ্রের কথা তিতাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা কাজ না করে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে। এরই মধ্যে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর, একজন স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ান এবং সরকারি বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের অভিযুক্ত সর্বমোট ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, যারা বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি।

 

মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে ম্যাক্সিকোতে

১৯৫৯ সাল থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই ম্যাক্সিকোর জ্বালানি তেলের পাইপলাইনে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে মূলত সংঘবদ্ধভাবে তেল চুরির ঘটনা। এই চক্র সুযোগ পেলেই নানা কৌশলে জ্বালানি তেল সরবরাহের পাইপলাইন ছিদ্র করে এবং সেখান থেকে বের হতে থাকা তেল বাজারে বিক্রি করে। এমনি এক ঘটনা ঘটে মেক্সিকোর হিদালগা অঞ্চলের টালাহুইলি পান শহরে। এই অঞ্চলের মাটির নিচে রয়েছে ম্যাক্সিকোর ভেড়াক্রজ রাজ্যের টুক্সপান সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তুলা এলাকার পিম্যাক্স কমপ্লেক্সে জ্বালানি তেল সরবরাহের লাইন। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি বিকাল ৫টা ৪ মিনিটে একদল দুষ্কৃতকারী এই তেলের পাইপের একটি অংশে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়। সেই ফাটল দিয়ে পাহাড়ি ঝরনার মতো জ্বালানি তেল প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর শুরু হয় বালতি, জেরিক্যান, ড্রাম, হাঁড়ি-পাতিল, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি দিয়ে তেল সংগ্রহের বন্য উৎসব। এই তেল সংগ্রহকারীর সংখ্যা এক সময় শয়ের (১০০) অঙ্ক পেরিয়ে হাজারে পৌঁছে। অন্যদিকে শিশুরাও এই সময় জলকেলির মতো জ্বালানি তেল একে অপরের দিকে ছুড়ে মারার শিশুতোষ খেলায় মেতে ওঠে।

এ ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশের ৯১১ নম্বরে ফোন করে এলাকাবাসী। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তেল সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। কারণ ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে জ্বালানি তেলের পাইপলাইন ছিদ্র করে তেল চুরির ঘটনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। এমনকি দিনে গড়ে ৪০টি ছিদ্র করা এবং বছরে দুই হাজারের বেশি ছিদ্রের ঘটনাও ঘটে। অন্যদিকে তেল সংগ্রহকারী ও উৎসুক জনতার সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় তেল পাইপলাইন পাহারার জন্য নিয়োজিত সৈন্যদের ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এতে বাদ সাধে সাধারণ জনগণ। তারা সৈন্যদের ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে নানাভাবে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করে। হাজার হাজার আক্রমণাত্মক তেল সংগ্রহকারীর তুলনায় সৈন্যদের সংখ্যাও ছিল অপ্রতুল। অন্যদিকে লাঠিচার্জ, বলপ্রয়োগ বা ফাঁকা গুলি ছুড়লে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা জ্বালানি তেলে আগুন লাগার আশঙ্কাও ছিল। ফলে সেনা সদস্যরাও ছিল দ্বিমুখী চাপের মধ্যে। এমন অবস্থায় প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ জ্বালানি তেল লুটপাট চলতে থাকে। সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে তীব্র শব্দে এক বিস্ফোরণ ঘটে এবং চারদিকে আগুন লেগে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয় লিক হয়ে যাওয়া পাইপসহ আশপাশের জনপদ। কর্তৃপক্ষের হিসাবে ছিদ্র করা বা ফেটে যাওয়া পাইপটিতে ১০ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল ২৯০ পিএসআই গতি বা শক্তিতে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে এই আগুন নেভানো সহজ ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দূর থেকে তারা লাকড়ি বা জ্বালানি কাঠের মতো মানুষের দেহ পুড়তে দেখেছেন।  কিন্তু কিছুই করার ছিল না তাদের। বরাবরের মতো এই অগ্নিকান্ডের মৃতের সংখ্যাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এই সংখ্যা ১৪০ অতিক্রম করেছে সন্দেহাতীতভাবে।

 

উন্নত দেশেও পাইপলাইন বিস্ফোরণ

পৃথিবীর মধ্যে খনিজ তেলের রিজার্ভের দিক থেকে কানাডার অবস্থান তৃতীয় এবং উৎপাদন ও রপ্তানির দিক থেকে চতুর্থ। এ ছাড়াও কানাডায় রয়েছে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ। এই জ্বালানি তেল ও গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে সঞ্চালন এবং দেশের সীমা পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির জন্য দেশজুড়ে রয়েছে বিস্তৃত পাইপলাইন নেটওয়ার্ক। ১৯৬০ সাল থেকে চলতি ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর কানাডায় পাইপলাইন বিস্ফোরণের তথ্য পাওয়া যায়। এতে বিপুল প্রাকৃতিক খনিজসম্পদ এবং জীবজন্তু ও মানুষের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়। চীনে ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর তারিখে সানডং অঞ্চলে তেলের পাইপলাইন বিস্ফোরণে ৫৫ জনের মৃত্যু ঘটে। ১৯১৪ সালের ২৭ নভেম্বর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ২২ জন। একই বছর তাইওয়ানে গ্যাস পাইপলাইন লিকেজ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে মৃত্যুবরণ করেন ৩০ জন এবং আহত হন ৩০০ জন। স্বপ্নের দেশ আমেরিকাতেও প্রায় প্রতি বছর তেল ও গ্যাস  পাইপলাইন বিস্ফোরিত হয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর