বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুম্বাইয়ে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার এক যুগ

নৌকায় করে মুম্বাই এসেছিল ১০ জঙ্গি। গুলি-গ্রেনেড হামলা, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। আগুনে জ্বলছিল হোটেল তাজ। সেই মুম্বাই ট্র্যাজেডি নিয়ে লিখেছেন- তানভীর আহমেদ

মুম্বাইয়ে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার এক যুগ

কী হয়েছিল সেদিন

¤¤¤ ২৬ নভেম্বর, ২০০৮। লস্কর-ই-তৈয়্যবার ১০ জঙ্গির তান্ডব চলে ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বাইয়ে। জঙ্গি হামলা হয় সিএসটি রেলস্টেশন, তাজ হোটেল, ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট, নরিম্যান হাউস, কামা এবং অ্যালব্লেস হাসপাতাল, লিওপোর্ড ক্যাফে, মেট্রো সিনেমা, টাইমস অব ইন্ডিয়া বিল্ডিং ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পেছনের গলি। মাজাগাঁও ও ভিলে পার্লে ট্যাক্সিতে বিস্ফোরণ হয়।

 

¤¤¤  মাছ ধরার ডিঙি নৌকা নিয়ে ১০ জঙ্গি রাতের অন্ধকারে এসে নামে মুম্বাইয়ের উপকূলে। মুম্বাইয়ে সে সময় স্থানীয় কিছু লোকের প্রশ্নের মুখে পড়ে তারা। ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী জঙ্গিরা নিজেদের ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। জঙ্গিদের আরেকটি দল কিছু মৎস্যজীবীর সামনে পড়ে যায়। মৎস্যজীবীদের সন্দেহ হতেই জঙ্গিরা রীতিমতো শাসানি দিয়ে বলে, ‘নিজের চরকায় তেল দাও।’ আতঙ্কিত মৎস্যজীবীরা পুলিশকে জানালেও তারা বিষয়টির গুরুত্ব আঁচ করতে পারেনি।

 

¤¤¤  রাত সাড়ে ৯টা থেকে জঙ্গিরা মুম্বাইয়ের প্রকাশ্য রাস্তায় এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। কিছু পরেই জঙ্গিরা নরিম্যান হাউস, যা ইহুদিদের বাসস্থান বলে পরিচিত সেখানে হামলা চালায়। এর সঙ্গে সঙ্গে হামলা হয় বিলাসবহুল হোটেল হিসেবে পরিচিত ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট এবং তাজ হোটেলে। সব মিলিয়ে জঙ্গিরা ১২টি হামলা চালায়।

¤¤¤  ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত জঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে নিরাপত্তা বাহিনীর। ৯ জন জঙ্গিকে হত্যা করতে সমর্থ হয় নিরাপত্তা বাহিনী। নারকীয় এই হামলায় ভারতীয় ছাড়াও আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ১৭০ জন প্রাণ হারান। মারাত্মকভাবে জখম হন প্রায় ৩০০ মানুষ। শুধু ওবেরয়-ট্রাইডেন্টেই ৩২ জন বন্দীকে জঙ্গিরা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল। চার দিনের মাথায় ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট, নরিম্যান হাউস এবং তাজ হোটেলকে জঙ্গিমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে জানানো হয় ১০ জঙ্গির মধ্যে একজনকে শুধু জীবিত অবস্থায় ধরা গেছে। এ জঙ্গির নাম আজমল কাসাব।

 

¤¤¤ কাসাবকে জেরা করে সামনে আসে মুম্বাই হামলায় লস্কর-ই-তৈয়্যবার যোগের তথ্য ও প্রমাণ। অস্ত্র আইন, বেআইনি কার্যকলাপ, বিস্ফোরক আইন, শুল্ক আইন, দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো অভিযোগ দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও রেলওয়ে অ্যাক্টসহ আরও বেশ কিছু ধারা যোগ করা হয়। টিকিট ছাড়াই রেলওয়ের চৌহদ্দিতে পা-রাখার জন্যও মামলা হয়েছিল জঙ্গি কাসাবের বিরুদ্ধে। বিচারসম্পন্ন করে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে ২০১২ সালের নভেম্বরে আজমল কাসাবকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

 

¤¤¤ মুম্বাই হামলার পর পরই আমেরিকায় ধরা পড়ে আরেক মাস্টারমাইন্ড ডেভিড কোলম্যান হেডলি। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান ছিল হেডলি। এফবিআই ও ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ এবং এনআইএর তদন্তকারী অফিসারদের সামনে হেডলি জানায়, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরের আগে দুবার এমন সন্ত্রাসবাদী হামলার ছক করেছিল লস্কর-ই-তৈয়্যবা। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে হামলা  চালানোর সেই ছক ভেস্তে গিয়েছিল।

 

এফআইএর তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীরা

এফবিআইএর গোয়েন্দারা জাপানে ইয়ামাহা মোটরসের সদর দফতর থেকে জানতে পারেন করাচির ইয়ামাহা ডিলারের কাছ থেকে লস্কর-ই-তৈয়্যবার অর্থদাতা আমজাদ খান আটটি ইঞ্জিন কেনে, যা মুম্বাই হামলায় ব্যবহৃত হয়...

ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এফআইএ ১৮ নভেম্বর স্বীকার করেছে ২৬/১১ হামলা পাকিস্তানের মাটি থেকেই শুরু হয়। ৮৮০ পাতার তালিকায় বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে এফআইএ। মুলতানের মুহাম্মদ আমজাদ খান জঙ্গিদের মুম্বাই পৌঁছানোর জন্য আল ফৌজ নৌকাটি কেনে। এই নৌকা করেই জঙ্গিরা মুম্বাই পৌঁছায়। নৌকার জন্য ইয়ামাহা ইঞ্জিন, লাইফ জ্যাকেট প্রভৃতি সংগ্রহ করে। নৌকাটি আমজাদ কিনেছিল করাচির এআরজেড ওয়াটার স্পোর্টস থেকে। ভাওয়ালপুরের শাহীদ গাফুরের নামও রয়েছে এফআইএ’র তালিকায়। আল-হুসেইনি ও আল-ফৌজ নৌযানের নাবিক ছিল সে। তালিকায় নৌযানের ৯ ক্রু সদস্যেরও নাম রয়েছে। সাহিওয়ালের মুহাম্মদ উসমান, লাহোরের আতিক-উর-রহমান, হাফিজাবাদের রিয়াজ আহমেদ, গুরজানওয়ালার মুহাম্মদ মুস্তাক, ডেরা গাজী খানের মুহাম্মদ নঈম, সারগোদার আবদুল শাকুর, মুলতানের মুহাম্মদ সাবির, লোধরানের মুহাম্মদ উসমান, রহিম ইয়ার খান শাখিল আহমেদের নাম প্রকাশ করেছে এফআইএ। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা অবশেষে স্বীকার করেন এরা সবাই মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত লস্কর-ই-তৈয়্যবার সদস্য। এফআইএ’র তালিকা মুম্বাইয়ের হামলাকারীদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ বলে বর্ণনা করেছে। মুম্বাই হামলায় ব্যবহৃত নৌকার ইঞ্জিন কেনা নিয়ে তদন্তের স্বার্থে জাপানে গিয়েছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর গোয়েন্দারা। জাপানে ইয়ামাহা মোটরসের সদর দফতর থেকে তারা জানতে পারেন করাচির ইয়ামাহা ডিলারের কাছ থেকে লস্কর-ই-তৈয়্যবার অর্থদাতা আমজাদ খান আটটি ইঞ্জিন কেনে। এই নৌযানগুলো দিয়েই ১০ পাকিস্তানি জঙ্গি মুম্বাই হামলায় অংশ নিতে গিয়েছিল। মুম্বাই হামলার আরেক ষড়যন্ত্রকারী লস্কর জঙ্গি ইফতিহার আলী ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল বা ভিওআইপির জন্য ইসলামাবাদের ইউরো ২০০৫ মানি চেঞ্জারে ২৫০ মার্কিন ডলার জমা দেয়। এই ভিওআইপি আল হুসসাইনি ও আল ফৌজ শাহীদ গাফুর নৌযানের ক্যাপ্টেন, ক্রু মেম্বার আবদুল রহমান উসমান, আতিক-উর রহমান, রিয়াজ আহমেদ, নঈম, আবদুল শাকুর, সাবির, উসমান, শাকিল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ব্যবহৃত হতো। উসমান জিয়া, আব্বাস নাসির, জাভেদ ইকবাল, মুখতার আহমেদ, আহমেদ সাইদ ও মুহাম্মদ খান জঙ্গি হামলায় অর্থায়নে যুক্ত ছিল। সন্ত্রাসবাদীদের তালিকায় বরাবরই মুম্বাই হামলায় জড়িত ১৯ জন জঙ্গির নাম ছিল। তালিকায় নতুন সংযোজন করায় তাতে রয়েছে ১ হাজার ২০১ জনের নাম। পাকিস্তানের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ), ইসলামাবাদ ক্যাপিটাল টেরিটরি (আইসিটি)-সহ পাক পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান, গিলগিট-বাল্টিস্তান প্রদেশের গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া জঙ্গির নামও তাতে রয়েছে।

 

সেনাদের মতো ট্রেনিং নেয় পাকিস্তানে

মাছ ধরার ডিঙি নৌকা নিয়ে ১০ জঙ্গি আসে মুম্বাই

পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল জঙ্গিদের। হামলাকারী ১০ জনকেই আত্মঘাতী জঙ্গি হিসেবে তৈরি করেছিল লস্কর-ই-তৈয়্যবা। ১৮ মাস ধরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল তারা। আজমল কাসাব জেরার মুখে এ কথা জানায়। জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যবার শীর্ষ নেতৃত্বের অধীনে চার দফা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরে মুম্বাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় ১০ জঙ্গি। আরব সাগরে তাদের নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল একবার। তবে কোনোক্রমে রক্ষা পায়। প্রথমে ৭ নভেম্বর হামলার ছক ছিল তাদের। তাদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিতে অস্বীকার করে একটি ভারতীয় নৌকার ক্যাপ্টেন। জঙ্গিদের নাগাল থেকে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। এক মৎস্যজীবীর ডিঙিতে চড়ে পরে মুম্বাই এসে পৌঁছায় তারা। যদিও তাদের উদ্দেশ জানতেন না ওই মৎস্যজীবী। রাত আনুমানিক ৮টা। মুম্বাইয়ে পৌঁছে খুব দ্রুত পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে ট্যাক্সি করে ১০ জঙ্গি রওনা দেয় পূর্বনির্ধারিত টার্গেটে। রাতে ভিলে পার্লে এবং ওয়ালি বন্দরে দুটি ট্যাক্সিতে বিস্ফোরণও হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রে বড় ধরনের আঘাত হানা। তাই জনবহুল এবং পর্যটকদের ভিড় রয়েছে এমন জায়গাকেই নিশানা করেছিল জঙ্গিরা।

 

জঙ্গিদের চার দিনের তান্ডব

ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির রিপোর্ট, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ডেভিড কোলম্যান হেডলি মুম্বাই হামলার জন্য ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নানা তথ্য সংগ্রহ করে জঙ্গিদের কাছে পাঠায়

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনালে হামলা চালায় দুই জঙ্গি। একে-৪৭ হাতে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় সাধারণ মানুষের ওপর। মারা যায় মোট ৫৮ জন নিরপরাধ মানুষ। রাস্তায় নেমেও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় জঙ্গিরা। মারা যান আটজন পুলিশকর্মী। বাস টার্মিনাল থেকে কামা হাসপাতাল। জঙ্গি কাসাবের নেতৃত্বে তা-ব চালায় জঙ্গিরা। মারা যান মুম্বাই পুলিশপ্রধান হেমন্ত কারকারেসহ আরও কয়েকজন পুলিশকর্মী। কনস্টেবল অরুণ যাদবের বুদ্ধিমত্তা আর পুলিশ অফিসার তুকারাম ওম্বলের অসীম সাহসিকতায় কাসাবকে ধরে ফেলা সম্ভব হয়। তুকারাম মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান অরুণ যাদব। তুকারামকে তার সাহসিকতার জন্য অশোকচক্রে সম্মানিত করা হয়েছিল। জনপ্রিয় লিওপোল্ড ক্যাফেতেও হামলা চালায় জঙ্গিরা। মারা যান ১০ জন নিরপরাধ মানুষ। হামলা চালানো হয় তাজ হোটেল এবং ট্রাইডেন্ট হোটেলেও। শুধু তাজমহল হোটেলেই ছয়টি বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। প্রথম দিন, রাতের অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে কোনোরকমে ২০০ জন পণবন্দীকে উদ্ধার করেন দমকলকর্মীরা। কিন্তু ভিতরে জারি ছিল হত্যালীলা। ৪২ ঘণ্টা পর ২৮ নভেম্বর জঙ্গিমুক্ত হয়েছিল ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট। নরিম্যান হাউসে ইহুদিদের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দখলও নিয়েছিল জঙ্গিরা। জঙ্গিদের হটাতে হেলিকপ্টার থেকে নরিম্যান হাউসের ছাদে নামেন এনএসজি কমান্ডোরা। দুই জঙ্গিকে হত্যা করা গেলেও এতে প্রাণ হারান একজন ভারতীয় কমান্ডো। জঙ্গিদের গুলিতে মারা যান ছয়জন সাধারণ মানুষ। আজমল কাসাব ছাড়াও মুম্বাই পুলিশ ফাহিম আনসারী ও সাহাবুদ্দিন নামে আরও দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি মুম্বাই হামলায় আরও যারা জড়িত তাদের অপরাধের মাত্রা উল্লেখ করে রিপোর্ট দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ডেভিড কোলম্যান হেডলি মুম্বাই হামলার জন্য ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নানা তথ্য সংগ্রহ করে জঙ্গিদের কাছে পাঠায়। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির রিপোর্ট, পুরো হামলার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। হামলা চালায় লস্কর-ই-তৈয়্যবা। পাকিস্তানের আইএসআই জঙ্গি দলকে সব ধরনের লজিস্টিক ও টাকা দিয়ে সাহায্য করে। সাজিদ মজিদ ও ওয়াসি লস্কর-ই-তৈয়্যবা থেকে হামলা সমন্বয় করে। মুম্বাই থেকে ডেভিড কোলম্যান হেডলি পাকিস্তানের আইএসআই এজেন্ট মেজর ইকবালের সঙ্গে বৈঠক করে হামলার পরিকল্পনা করে। ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির দাবি, মেজর ইকবাল, সাজিদ মাজিদ, হাফিজ সাইদ, জাকির-উর রহমান  মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার পুরো পরিকল্পনাটি সাজায় ও নৃশংস হামলা চালায়।

 

অজামিনযোগ্য ওয়ারেন্ট

নয় জঙ্গির নাম

২০১১ সালে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির বিশেষ কোর্ট মুম্বাই হামলায় জড়িতদের ওপর একটি ওয়ারেন্ট জারি করে। অজামিনযোগ্য এই ওয়ারেন্টে মোট নয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে দুজন যুক্তরাষ্ট্রের ও সাতজন পাকিস্তানের নাগরিক।

সন্ত্রাসীরা হলো- ১) ডেভিড কোলম্যান হেডলি (যুক্তরাষ্ট্র) ২) তহাউর হুসেইন রানা (যুক্তরাষ্ট্র) ৩) হাফিজ মুহাম্মদ সাইদ ৪) জাকির-উর রহমান লকভি ৫) সাজিদ মজিদ ৬) আবদুর রহমান হাসিম সাইদ ৭) মেজর ইকবাল ৮) মেজর সামির আলী এবং ৯) ইলিয়াস কাশ্মীরি।

 

 

 

কমান্ডোদের দুর্ধর্ষ অভিযান

হামলার পরই সবার আলোচনায় আসে মুম্বাইয়ের মার্কোস এলিট ফোর্স। মুম্বাই হামলায় সন্ত্রাসী দমনে প্রথম কমান্ডো হিসেবে এই অভিজাত দলটি মাঠে নামে। বিশেষায়িত বাহিনীর তৎপর অভিযানে ২৮ নভেম্বর সকালেই সন্ত্রাসের কবল থেকে মুম্বাইকে মুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হয়। শুধু তাজ হোটেলে তখনো নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গিরা। তাজ হোটেলকে জঙ্গিমুক্ত করতে ২৯ নভেম্বর ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’ অভিযান চালায় ভারতীয় এনএসজি কমান্ডোরা। সেদিন সকালের মধ্যে ১০ জঙ্গির মধ্যে নয়জনকেই হত্যা করে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং পাওয়া এই অভিজাত কমান্ডোরা। হেলিকপ্টার থেকে কমান্ডোরা নরিম্যান হাউসের ছাদে নামে। প্রথম ফ্লোর থেকে নয়জন বন্দীকে উদ্ধার করে তারা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরো ভবন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। চারপাশে বিপুল সংখ্যক স্নাইপার নিযুক্ত হন। নরিম্যান হাউস ও গ্র্যান্ড ওবেরয়কে সন্ত্রাসমুক্ত করার পর এনএসজি কমান্ডোরা তাজ হোটেলে পৌঁছান। কমান্ডোরা সামনে এগোতেই গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গোলাগুলি শুরু হয়। আগুন ও ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারপাশ। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কমান্ডোরা বিদ্যুৎ গতির এক কাউন্টার অ্যাটাক পরিচালনা করেন। সে সময় হোটেল তাজে তিনজন সশস্ত্র জঙ্গি অবস্থান করছিল। চৌকস কমান্ডোদের হামলায় জঙ্গিদের সবাই প্রাণ হারায়। এই দুর্ধর্ষ অভিযানে এক এনএসজি কমান্ডোও প্রাণ হারিয়েছেন। নরিম্যান হাউস থেকে ২৫০ জন, হোটেল তাজ থেকে ৩০০ জন ও ওবেরয় হোটেল থেকে ৬০ জন সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করেন কমান্ডোরা।

 

ফাঁসি হয় একমাত্র বন্দীর

আজমল কাসাব। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া কাসাবের বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। কাসাব ও তার জঙ্গি সহযোগী ইসমাইল মিলে মুম্বাইয়ে ৭২ জনকে  হত্যা করে।

একমাত্র তাকেই জীবিত গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার দেওয়া তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় কারা এই হামলার পরিকল্পনাকারী ও জঙ্গিদের বিস্তারিত। তাকে গ্রেফতারের পর ২০১০ সালের ৬ মে ফাঁসির সাজা শোনায় ট্রায়াল কোর্ট। হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট কাসাবের ফাঁসির সাজা বহাল রাখা হয়।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে কাসাব। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। ২১ নভেম্বর তাকে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। কবর দেওয়া হয় জেলের মধ্যেই।

 

 

জড়িতদের তালিকা ভারতের হাতে

হামলার পর তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে জড়িত সন্ত্রাসীদের তালিকা করে ভারত। জঙ্গি হামলায় কারা জড়িত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে ভারতের এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি)-এর হাতে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারত তিনজন গ্রেফতারকৃত জঙ্গি ও ৩৫ জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসীকে অভিযুক্ত করে এসব দলিল প্রকাশ করে। অভিযুক্তদের মধ্যে জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাও রয়েছেন। মুম্বাই হামলায় তাদের কতটুকু ভূমিকা ও সহযোগিতা ছিল সেসবের বিস্তারিত-

১) মুহাম্মদ আজমল মুহাম্মদ আমির কাসাব ওরফে আবু মুজাহিদ, বয়স ২১।

২) ফাহিম আরশাদ মুহাম্মদ ইউসুফ আনসারী, আবু জাফর, সাকিব, সাহিল পওয়াস্কার, সামির শেখ, আহমেদ হাসান। অভিযুক্তদের বয়স ৩৫ বছর।

৩) সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাব্বির আহমেদ শেখ, সাবা, ফারহান, মুবাশ্বির, বাবর, সামির সিং, সানজিভ, আবু আল কাসিম, ইফতিখার, মুরশাদ, মুহাম্মদ শফিক ও আজমল আলী। অভিযুক্তদের বয়স ২৪ বছর।

৪) ৯ জন মৃত ও ৩৫ জন জঙ্গি মুম্বাই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।

৫) আজমল কাসাব একমাত্র পাকিস্তানি জঙ্গি যাকে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতেনাতে গ্রেফতার করে। বিচারের মুখোমুখি করার পর তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।

 

পাকিস্তানে মামলার ধীরগতি

আজমল কাসাব জেরার মুখে স্বীকার করে এই হামলার পেছনে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে। এর পরই আন্তর্জাতিক চাপে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এফআইএ মুম্বাই হামলা নিয়ে একটি মামলা রুজু করে। এখন পর্যন্ত ২৭ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে তারা। এদের মধ্যে ২০ জনকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তবে মামলা এখনো চলছে। আদালত ঘটনার ১২ বছর পরও মামলা শেষ করতে পারেনি। উপযুক্ত প্রমাণ নেই- এমন কথা বলে বিচার দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। পাকিস্তানের ইসলামাবাদ হাই কোর্টে একটি ডিভিশনাল বেঞ্চে এ নিয়ে পিটিশনের ওপর শুনানি হয় ২০১৯ সালে। পাকিস্তানের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এই মামলার এন্টি টেররিজম কোর্টে একটি স্টে অর্ডার চায়। মামলায় ১৯ জন সাক্ষী হাজির করার জন্য প্রসিকিউশনকে আরও সময় দেওয়া হয়। এ সাক্ষীদের অনেকেই প্রাণভয়ে আদালতে হাজির হননি। বিচারকে দীর্ঘায়িত করার পাশাপাশি পাকিস্তান এ হামলায় জঙ্গিদের যে তালিকা দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করে ভারত।

 

লাহোরের জেলে হাফিজ সাইদ

মুম্বাই হামলার মাস্টারমাইন্ড হাফিজ সাইদকে সম্প্রতি ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত। জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি) প্রধান হাফিজ সাইদ। লাহোরের সন্ত্রাস-দমন আদালতে একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি।

এ ছাড়া আরও দুটি নাশকতামূলক ঘটনায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে পাকিস্তানের আদালত। হাফিজ সাইদকে পাকিস্তানের কারাদন্ড দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে আর্থিক মদদ দেওয়ার অভিযোগে হাফিজ এবং তার সহযোগীদের ১১ বছরের কারাদন্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। হাফিজকে ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও আমেরিকা।

২০০৮ সালে মুম্বাইতে জঙ্গি হামলায় প্রধান চক্রী ছিলেন হাফিজ সাইদ। এদিকে গত বছর জুলাইতে জঙ্গিদের অর্থ জোগানের অভিযোগে গ্রেফতার হয় হাফিজ। সে এখন কোর্ট লাখপত জেলে বন্দী রয়েছে।

 

 

জঙ্গিদের বাঁচাতে পাকিস্তানের কৌশল

ভারতের মুম্বাইয়ে জঙ্গি হামলায় অভিযুক্তদের বাঁচাতে নানা ধরনের কৌশল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভারতের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ দাখিল করার পরও পাকিস্তান অভিযুক্ত জঙ্গিদের বিচার দীর্ঘায়িত করে। অভিযুক্ত জঙ্গি হাফিজ সাইদ যিনি লস্কর-ই-তৈয়্যবার প্রধান তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ হাফিজ সাইদের মাথার দাম ১ কোটি ডলার ঘোষণা করে।

সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কড়া বার্তার পর আদালতের নির্দেশে লাহোরে গৃহবন্দী হন সাইদ। তখন সাইদ ও তার চার সহযোগীকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক করা হয় ৯০ দিনের জন্য। পরে দুবার আটকাদেশ বাড়ানো হয়। অভিযোগ ওঠে, হাফিজ সাইদকে গ্রেফতারের নামে একটি গেস্ট হাউসে আয়েশে রাখা হয়। তার কারাজীবন কতটা বিলাসী ছিল তার নমুনা, জেলে থেকেও তিনি সন্তানের বাবা হন। গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে, মুম্বাই হামলার পাঁচ বছর পর পুরস্কার হিসেবে পাকিস্তানি সরকার তাকে ৬০০ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি অনুদান দেয়। এ ছাড়া হাফিজ সাইদ এবং তার জঙ্গি দলকে আড়াই কোটি রুপি দামের বুলেট প্রুফ গাড়ি দিয়েছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা। আরেক অভিযুক্ত জঙ্গি জাকির-উর রহমান লকভিকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে। কিন্তু তার বিচার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

সিন্ধ হাই কোর্ট থেকে তিনি জামিন পান এবং মামলা থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রিভিউ পিটিশনও করেনি। এ ছাড়া মুম্বাই হামলার সঙ্গে যারা অভিযুক্ত তাদের বিষয়ে পাকিস্তানকে নীরব থাকতে দেখা যায়। এমনকি পাকিস্তান উল্টো এই হামলায় অন্য দেশের জঙ্গিরা জড়িত বলে নানা প্রমাণ ও যুক্তি তুলে ধরে দৃষ্টি সরাতে চেয়েছে।

এদিকে জঙ্গিদের অর্থায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স বা এফএটিএফের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। এফএটিএফের অধিবেশনে কালো তালিকাভুক্ত করা হতে পারে পাকিস্তানকে। তাই আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি কিছুটা স্বচ্ছ করার তাগিদে ইসলামাবাদ সম্প্রতি মুম্বাই হামলার মাস্টারমাইন্ড হাফিজ সাইদকে আরও ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর