শিরোনাম
বুধবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ► বিচারপতি, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় ৫০ বছর। এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে শত্র“মুক্ত করি। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে পথ চলতে হলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত অনেক সত্যকে সামনে অনাবৃত করতে হবে। নির্মম সেসব সত্যকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালে লাখ লাখ বাঙালি নারীর আত্মত্যাগ স্মরণ করার সময় এসেছে। এ সত্য নিয়ে কথা বলার আগে এটিও জানতে হবে কোন প্রেক্ষাপটে অবশেষে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। রয়েছে বিশাল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কীভাবে চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের পথ ধরে অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বান ও নেতৃত্বে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে সেটিও অনিবার্যভাবে জানা প্রয়োজন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এ প্রস্তাবটিকেই পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত করা হয়। এ প্রস্তাবের খসড়ার বেশ কিছু সংশোধন সাপেক্ষে শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক তা অধিবেশনে পেশ করেন। অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রস্তাবটি সমর্থিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি প্রকট হতে থাকে। এরই মধ্য দিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম আবাস ভূমির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৪৬ সালে সর্বভারতীয় নির্বাচনী ফলাফলে জিন্নাহর দাবির প্রতি মুসলমানদের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৩০টি মুসলিম আসনের সবকটিই পায় মুসলিম লীগ। প্রদেশগুলোর মধ্যে ৫২৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ৪৬৪টি আসনে জয়লাভ করে। এ বিজয়ের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দাবি করতে থাকেন যে, ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন হলো মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ব্রিটিশ কেবিনেটের  তিনজন সদস্য ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতবর্ষে আসেন। অনেক আলাপ-আলোচনা এবং দেনদরবারের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এ। এভাবেই হয় দেশ বিভাগ। ১৪ আগস্ট জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক একটি মুসলিম রাষ্ট্র যার পরবর্তী নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। আরেকটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্ররূপে জন্ম হয় ভারতের।

পাকিস্তানের জন্মের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমেই সন্দিহান হয়ে উঠছিলেন। ব্রিটিশ শোষণের হাত থেকে ভারতবর্ষের মানুষ যখন স্বাধীনতা লাভ করে এর স্বাদ ভোগ করছে ঠিক তেমনি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ অনুভব করতে থাকে- “সম্ভবত আমরা জ্বলন্ত আগুন থেকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ঝাঁপ দিয়েছি।” মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ওপর প্রথম যে আঘাতটি আসে সেটি হলো- রাষ্ট্রভাষার ওপর আঘাত। জিন্নাহ চাইলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার মানুষ জিন্নাহর দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে প্রতিবাদে ফেটে ওঠে। বিশেষ করে পূর্ব-বাংলার ছাত্রসমাজ সেদিন জিন্নাহর উপস্থিতিতেই শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করার প্রকাশ্য বিরোধিতা করে। শুরু হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। এ অন্দোলনের গোড়া থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তদানীন্তন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিউর, সালাম, জব্বার, বরকত আরও অনেক নাম না জানা শহীদের রক্তের বিনিময়ে পূর্ব-বাংলার মানুষ ‘বাংলা’কে পাকিস্তানের অন্যতম দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হয়।

’৫২ সালের শহীদদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এগিয়ে যেতে থাকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে। ’৫৪ সালের নির্বাচনে এ ভূখন্ডের মানুষ তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ অঞ্চলে এক নতুন বৈষম্য ও নিপীড়নের অধ্যায়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। এ ছয় দফা ছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মেনিফেস্টো। আইয়ুব খান সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শেখ মুজিবকে ছয় দফা প্রণয়নের অপরাধে কারান্তরালে নিক্ষেপ করে।

পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ভারতের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে তাদের সাহায্যে পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র করার চেষ্টা করেছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের চাপে আইয়ুব খান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯-এ এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আবির্ভাব ঘটে। ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পরই ঘোষণা করেন দেশে অনতিবিলম্বে তিনি সাধারণ নির্বাচন দেবেন এবং এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ  তৎকালীন সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। এ ভূখন্ডের মানুষ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ এবং ১৭ তারিখের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে  নির্বাচিত করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে (মহিলা আসনসহ)। পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিল কিন্তু তাদের কেউই নির্বাচিত হননি। নির্বাচনী ফলাফলের ধরন এমনভাবে প্রতিভাত হয় যে, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণও পাকিস্তানপন্থি কাউকেই তাদের নেতৃত্বে দেখতে চায়নি। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু পিডিপি নেতা নুরুল আমিন ও চাকমা রাজা ত্রিদীব রায়। পাকিস্তানভিত্তিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চরম ও দৃশ্যমান অনীহা প্রকাশ করে। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এমন নেতিবাচক মানসিকতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সাল থেকে অর্থাৎ পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও তাঁর জীবন ও কর্ম  নিয়ে  আন্যান্য লেখকের লেখা বই থেকেও বঙ্গবন্ধুর এ ভ্রান্তিহীন ধারণার  প্রমাণ মেলে।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করা হয় পাকিস্তানে। তাঁর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অকুতোভয় দামাল ছেলেরা প্রিয় দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপণে যুদ্ধ করে। তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় আমাদের মুক্তিবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬  ডিসেম্বর দেশকে চূড়ান্তভাবে শত্র“মুক্ত করতে সক্ষম হয়। বাঙালি অর্জন করে বিজয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লে. জে. নিয়াজি ও তার অধীন ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচিত হয় বাংলাদেশের মাটিতে।

নয় মাসের এ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেছেন ৩০ লাখ মানুষ আর সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধে আত্মবলিদানকারী ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে কতজন পুরুষ আর কতজন নারী তার হিসাব হয়তো কেউ রাখেনি। হয়তো এ হিসাবও আমরা রাখিনি যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কতজন নারী সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, কাঁকন বিবি, গীতা কর, শিরিন বানু মিথিল প্রমুখ বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম হয়তোবা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আরও যে অগণিত মা-বোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তার হিসাব আমরা কি কখনো রেখেছি? এ নিয়ে কি কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি লজ্জার বিষয়।

কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে

কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় এ সত্য বচন তুলে ধরেছেন আমাদের চৈতন্যোদয়ের জন্য। আমাদের দেশের নারীরা যতজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক নারী এ মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ সম্মান নিজ সম্ভ্রম হারিয়েছন। মা-বোনদের ওপর পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় কুখ্যাত দোসর রাজাকার আল বদরদের নির্মম অত্যাচারের বর্বর সত্য আমরা যেন কোনো দিন বিশ্রীত না হই সেই শপথ আমাদের নিতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের প্রতি যে বর্বর পাশবিক নির্যাতন পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের কুখ্যাত দোসররা করেছিল তার একটি চিত্র শহীদ রুমি স্কোয়াডের গবেষণায় ওঠে এসেছে। খুলনার ডা. বিকাশ চক্রবর্তী লিখেছেন, “যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাচের জার উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়েছিল খুব নিখুঁতভাবে।” কী নির্মম ও অমানবিক! এ যেন কেবল নারীর প্রতি নয়, পুরো মানবতার বিরুদ্ধেই পাশবিক আক্রমণ।

কুমারখালীর বাটিয়ামারার মো. নুরুল ইসলাম লিখেছেন- “মার্চে মিরপুরের একটি বাড়ি থেকে পরিবারের সবাইকে ধরে আনা হয় এবং কাপড় খুলতে বলা হয়। তারা এতে রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে আদেশ করা হয় যথাক্রমে মেয়ে এবং মাকে ধর্ষণ করতে। এতে রাজি না হলে প্রথমে বাবা এবং পরে ছেলেকে  টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয় এবং মা-মেয়ে দুজনকে দুজনের চুলের সঙ্গে বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।”

মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী মালেকা খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন- “আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিতা নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষতবিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।” এমন বর্বর সম্ভ্রমহানির ঘটনা বুঝি পৃথিবীতে বিরল। জীবনের বাকি সময়টিতেও সম্ভ্রমহানির ক্ষত তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে।

বিচারপতি কে এম সোবহান তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- “১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাংকার থেকে ২৩ জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।” (এখানে উল্লেখ্য, মিরপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারির শেষের দিকে)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রতন লাল চক্রবর্তী বলেছেন- “যুদ্ধের পর পর ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি, ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু নারীকে। তাদের পোশাক এবং চলাফেরা থেকে আমরা অনেকেই নিশ্চিত জানতাম ওরা যুদ্ধের শিকার এবং ওদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।”

“কোনো কোনো মেয়েকে পাক সেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।” -সুসান ব্রাউনি মিলার (এগেইনস্ট আওয়ার উইলঃ ম্যান, হিউম্যান অ্যান্ড রেপঃ ৮৩)। “এক একটি গণধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাক সেনাও অংশ নিয়েছে।” (ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গ্রন্থ “যুদ্ধ ও নারী”)

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল নিয়াজি। এই নরপশুর নেতৃত্বেই রাও ফরমান আলীসহ অন্য পাকিস্তানি জেনারেলরা পরিকল্পিতভাবে এদেশের বাঙালি  জনগোষ্ঠীর ওপর চালায় শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা। এদেরই পলিসি ও পরিকল্পনায় সংঘটিত হয় ধর্ষণের মতো অপরাধ। এ বর্বর অপরাধমূলক কর্মটিকে তারা ব্যবহার করে অস্ত্র হিসেবে। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় অমানবিক নেকড়েতুল্য দোসরদের সুসংগঠিত আক্রমণ ও অত্যাচারের চিত্র হার মানাবে হিটলারের নির্মমতাকে, আনা ফ্র্যাঙ্কের ডাইরিকে। সম্ভবত সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে আমাদের এদেশে, মুক্তিযুদ্ধকালে। এ ধর্ষণ ও সম্ভ্রমহানির বর্বরতা পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে ছিল ‘জায়েজ’।

বিভিন্ন উৎস থেকে জেনারেল নিয়াজির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা যায়। ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহমান সিদ্দিকী তার “East Pakistan The End Game” বইতে লেখেন,- “নিয়াজি জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাসক্তিমূলক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করতেন।” চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “আমার বাঘেরা গতকাল রাতে তোমাদের অর্জন কী?” অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকেই বোঝাতেন।

আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পূর্ব-পাকিস্তানের সব ফরমেশন কমান্ডারের কনফারেন্সে এক অফিসার পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। নিয়াজি তখন সেই অফিসারকে ধমক দিয়ে বলেন, “আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিও।” তারপর নিয়াজি হিংস্র হাসি হেসে বলে- ‘হিন্দুয়ানি বাঙালি রক্তে খাঁটি মুসলিমদের পাঞ্জাবি রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।” নিয়াজি আরও বলত, “আপনারা কীভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে, যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব-পাকিস্তানে এবং যৌন ক্ষুধা মেটাতে যাবে ঝিলমে?”

ধর্ষণে লিপ্ত এক পাকিস্তানি মেজর তার বন্ধুকে চিঠি লিখেছে- “আমাদের এসব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে সাচ্চা মুসলিম এবং সাচ্চা পাকিস্তানি।” নিয়াজি ধর্ষণে তার সেনাদের এতই চাপ দিতেন যে তা সামলে উঠতে না পেরে এক বাঙালি সেনা অফিসার আত্মহত্যা করে বসেন, সম্ভবত তার নাম ছিল মেজর মুশতাক।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের মানুষ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেক অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু মহিলা বা নারীদের বেদনা ও কষ্টটা ছিল অনেক বেশি, অনেক বেশি অব্যক্ত। বিশিষ্ট লেখক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরীর লেখা থেকে ওঠে এসেছে কীভাবে কত অব্যক্ত কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে আমাদের মা-বোনেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় দিনাতিপাত করেছেন। অবদান রেখেছে মুক্তিযুদ্ধে। মা-বোনদের ধরে নিয়ে বিভিন্ন নির্যাতন ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে দীর্ঘ নয় মাস। তার লেখা থেকে উঠে এসেছে নারীদের প্রাকৃতিক সমস্যাগুলোর কথা। ’৭১ সালে যে মা বা বোনটি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তাকে অনেক সমস্যার সম্মুুখীন হতে হয়।  অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়লে তেমন কোনো চিকিৎসাসেবা পেতেন না। গ্রাম্য কবিরাজি চিকিৎসাই ছিল একমাত্র ভরসা। পেতেন না তারা কোনো পুষ্টিকর খাবার। সন্তান প্রসবের পর নবজাতকের কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা ছিল না। পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারের কারণে যখন বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়ে পুরুষরা গাদাগাদি করে এক জায়গায় থেকেছে তখন সেখানে মহিলাদের থাকতে হয়েছে উন্মুক্ত আকাশের নিচে কোনো বাড়ির একটি জায়গায়। আফসান চৌধুরী তার বই ‘গ্রামের একাত্তরে’ যুদ্ধকালীন মাসিক হওয়া নারীদের সম্বন্ধে এভাবে উল্লেখ করেছেন-“তখন মাসিকের সময় তিনি সহ (তিনি একটি মেয়ের নাম) বাড়ির অন্য মেয়েরা কাপড় (ছেঁড়া ন্যাকড়া) ব্যবহার করতেন। এসব বিষয় নিয়ে ওই সময়ে কেউ কারও সঙ্গে আলোচনা করতেই চাইতেন না। নিজে নিজে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতেন।”

ভারতে শরণার্থী শিবিরে থাকা মহিলাদের ব্যাপারে আফসান চৌধুরী তার বইতে আরও উল্লেখ করেছেন যে, মাসিকের সময়ে মেয়েদের সমস্যায় পড়তে হতো। বিশেষ করে কাপড় নিয়ে সমস্যা হতো। নাটোরের এক শরণার্থী শর্মিলা পালের উদ্ধৃতি দিয়ে আফসান চৌধুরী লিখেছেন তাদের কাছে বাড়তি তেমন কোনো কাপড়ও ছিল না। যে দুই-একটা কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন তা দিয়েই মাসিকের সময় নোংরা মোছা লাগত। অনেক সময় মাসিক হলে চুপ করে বসে থাকতেন তারা। কোনো চিকিৎসকের কাছে তখন তারা যেতে পারেননি। পাশের কোনো মহিলাকেও এ বিষয়ে সহায়তার জন্য কিছু বলতে পারতেন না। যতই দিন যাচ্ছিল শেষের দিকে কাপড় বা নেকড়াও ছিল না। তাই মাসিক হলে মহিলাদের অসহনীয় কষ্ট সহ্য করতে হতো। শরণার্থী শিবির থেকে অনেক দূরে একটা পুকুর ছিল সেখানে মাঝে মাঝে গিয়ে গোসল করে আসতে হতো। বাড়তি কাপড় না থাকায় গোসলও করা হতো না। টয়লেট করার মতো নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ছিল না। দীর্ঘ সময় টয়লেট চেপে ধরে থাকতে হয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে পাশের কোনো ঝোপে গিয়ে তারা টয়লেট করেছেন।

আফসান চৌধুরীর লেখা ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বইতে উঠে এসেছে কীভাবে মহিলারা বিভিন্ন সময়ে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন-‘কালো তালিকাভুক্ত ফণি চৌধুরীকে (চট্টগ্রামের সেঞ্চুরি মটরের মালিক, বর্তমানে মৃত) ধানের ডোল চাপা দিয়ে এক মুসলিম মহিলা রাজাকারের কাছ থেকে বাঁচায়। (পৃষ্ঠা ১৪২)।’ ওই সাহসী নারী এভাবেই অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।

আফসান চৌধুরীর বইয়ে এক জীবন বাগ্চীর গল্প উঠে এসেছে। তিনি বলছেন- বাড়ি থেকে (রামদিয়া) বাজারে (পানটি) যাচ্ছিলাম, পথে দেখি আর্মি, যে যাচ্ছে তাকেই ধরে হিন্দু না মুসলমান এ রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। আমাকে দাঁড়াতে বললেও আমি শুনিনি, এমন ভাব করে যাচ্ছিলাম। ওরা আমার প্রতি বিরক্ত হয় কিন্তু ওই সময়ে রাজাকার কমান্ডার কুতুবের মা আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওইদিন এভাবেই বাঁচি। জনৈক সুধীর কুমার বিশ¡াসের জবানিতে তিনি লিখেছেন -‘বিহারি নিয়ে (কুষ্টিয়া থেকে) রাজাকাররা যখন আমাদের গ্রামে আসে তখন গ্রামের এই অপর পাড়ায় খিলুদের বাড়ির আশেপাশে পাট খেতে পালাই... বাড়ির মেয়েছেলেরা কোথায় যাচ্ছে তার খোঁজখবর নেওয়ারও অবসর নেই। আমার মেয়েটাকে (ছয়-সাত বৎসর) ওর মা গ্রামের জলিলের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। রাজাকাররা জলিলের বাড়িতেও হিন্দুরা পালিয়েছে কিনা দেখতে যায়। কিন্তু জলিলের স্ত্রী বলে, ‘এখানে কোনো হিন্দু নেই’। সবকিছু দেখে রাজাকাররা চলে যাচ্ছিল তখন মেয়েটা ‘পিসিমা’ বলে জলিলের স্ত্রীকে বসার জন্য একটি পিঁড়ি এগিয়ে দেয়। তখন একজন রাজাকার ‘হিন্দু রেখেছিস’ বলে হাতের রাইফেল দিয়ে আঘাত করলে ওই মহিলাটি (জলিলের স্ত্রী) অজ্ঞান হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মা-বোনেরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। নানা কর্মের মাধ্যমে অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। তখন এ ভূখন্ডের জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল নারী। কখনই এটি ভাবার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে এ নারী গোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই। মুক্তিসংগ্রামের একজন নিরস্ত্রও অংশ নিতে পারে যুদ্ধে। শত সহস্র ঘটনায় দেখা যাবে যে, ১৯৭১ এ অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ করেছে নারীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখে, তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। কখনো তারা করেছে তথ্য সরবরাহ, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে সেবা। কখনোবা তারা গান গেয়েও উদ্দীপ্ত করেছে। শিক্ষিত নারীদের পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ নারীরাও এমন যুদ্ধে সক্রিয় ও সাহসী ছিলেন। এমনও দেখা যায় যে, স্বামী শান্তি কমিটির সদস্য কিন্তু স্ত্রী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে গেছেন। রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধারা যখন কোনো স্কুলে বা পরিত্যক্ত কোনো জায়গায় অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের মোকাবিলা করার জন্য এরকম অবস্থায় আশপাশে থাকা নারীরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, কৌশলে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অনেকের। নারীদের এমন সাহসী ও মানবিক কর্ম অবদান রেখেছে মুক্তিযুদ্ধে। নীরব না থেকে তাদের এ অবদান আবিষ্কারে ও স্বীকৃতি দেওয়ার সময়  এসেছে। ১৯৭১-এ নারীরাও ছিল বীর যোদ্ধা। দেশের বহু স্থান থেকে মায়েদের উৎসাহে এদেশের অনেক যুবক সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের নারীরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বাস্তুচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে অনেক শরণার্থীকে সাহায্য করেন। তারা এভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন। রেখেছেন অবদান। আফসান চৌধুরীর বই ‘গ্রামের একাত্তরে’ উঠে এসেছে গ্রামের এক নারী মহিতুন্নেছার গল্প। “একদিন প্রবল বৃষ্টির পরে রামেশ¡রপুর গ্রামের হিন্দুরা যখন ধীরে ধীরে সীমান্তের দিকে এগুচ্ছিল (ফরিদপুর জেলা) তখন স্থানীয় মুসলমানরা এ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে তাদের বাড়িতে জায়গা দিয়েছে।” এ শরণার্থীদের খাওয়ানো ও আশ্রয় প্রদানকারী সুনিগাতি গ্রামের এক মহিতুন্নেছার গল্প বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-“না থাকলি দিতাম। আর বেগ কইরে যার যার (শরণার্থীরা) খাবার তৈরি কইরে বোরোত। যার না থাকতে তাকে রান্না করতে দিতাম না। আমরা খাওয়াতাম। প্রতিদিন সকালে দশ সের আটার রুটি বানায়ে দিতাম। আর গুড় ছেল ঘরে। যারা দৌড়ায়ে যাতো, তাগে দুইডে রুটি দিয়ে একটু গুড় দিয়ে দিতাম। ধর, পথে যাইয়ে খাইয়োনে।”

এ মহিতুন্নেছাদের গল্প আমরা খুব একটা জানি না। এরকম মহিতুন্নেছা রয়েছেন অনেক। তারা রয়েছেন নিভৃতে। কিন্তু যতদিন এদের অবদান সম্বন্ধে জাতি না জানবে ততদিন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মা-বোনদের সাহসী অবদান ও ভূমিকার সত্যটি রইবে অনাবিষ্কৃত। এটি কাম্য নয়। সত্যকে সামনে আনার অনাগ্রহ আমাদের জন্য লজ্জার। মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের মা-বোনেরা কেবল সর্বোচ্চ আত্মসম্পদ বিসর্জন দেননি, তারা নানাভাবে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, বাস্তুচ্যুত মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে।

১৯৭২ সালের  নিউ ইয়র্ক টাইমস এ ‘Killing of Babies Feared in Bengal’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্ষণের পরিণতিতে ২৫ হাজার নারী সন্তান জন্ম দেন। জন্ম নেওয়া এসব যুদ্ধশিশুদের দত্তক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়ামসহ নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। কতজন যুদ্ধশিশুকে এভাবে দত্তক নিয়ে সেসব দেশে নিয়ে যাওয়া হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট রেকর্ড নেই। একটি বুলেট একজনকে একবারই হত্যা করে। কিন্তু যুদ্ধকালীন সম্ভ্রম লুণ্ঠন বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী এক অস্ত্র। এ ঘৃণ্য ভয়াবহ অস্ত্রটি সেসব সম্ভ্রম হারানো নারীকে জীবনভর হত্যা করে চলেছে। আর যেসব যুদ্ধশিশুর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তাদের কী অবস্থা? তারাও ওই নির্মমতার সেকেন্ডারি ভিকিটম। তাদেরও নিরন্তর বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অবহেলা, হতে হয় সামাজিকভাবে নিগৃহিত। সম্ভ্রম হারানো নারী ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সম্মান, সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলিং ও আর্থিক সমর্থন। সর্বোচ্চ সম্পদ নিজ সম্ভ্রম হারানো লাখ লাখ এই মা-বোন ও যুদ্ধশিশুরা যে রক্তাক্ত বেদনা বয়ে চলেছেন তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি অবিচ্ছেদ্য সত্য।  

আমাদের দেশে কতজন ‘যুদ্ধশিশু’ আছে তার কোনো হিসাব হয়তো আমরা রাখি না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত সৈয়দ মো. কায়সারের বিচার করতে গিয়ে এক বিরল অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। আমি তখন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান। আমার অপর দুই ব্রাদার ছিলেন মাননীয় বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও মাননীয় বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। এই অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মোট ১৬টি চার্জ গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে অভিযোগ নং ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ এর প্রত্যেকটি অপরাধের জন্য অভিযুক্তকে মৃত্যুদন্ড এবং অভিযোগ নং ১, ২, ৭, ৯, ১১, ১৩ ও ১৪ এর প্রত্যেকটিতেই বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়। অভিযোগ নং ৪ ও ১৫ এর অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় তাকে এ দুটি অপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ ক্রিমিনাল আপিল নং ০৪/২০১৫ এ প্রদত্ত রায়ে ১২নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত সাজা বহাল রাখেন। অভিযোগ নং ১২ ছিল একজন নারী মাজেদা বেগমকে অভিযুক্ত কর্তৃক পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া ও এরপর পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ক্যাম্পে বেশ কদিন আটক অবস্থায় উক্ত নারীর ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগ প্রমাণ করতে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে আসেন ধর্ষণের শিকার মাজেদা বেগম ও তার কন্যা শামসুন্নাহার। এই শামসুন্নাহার হলো ধর্ষণের পরিণতিতে গর্ভবর্তী হয়ে পড়া মাজেদা বেগমের কন্যা। একজন যুদ্ধশিশু।

আমাদের সামনে এই ধর্ষণের শিকার মা ও তার কন্যা (যুদ্ধশিশু) যা বলেছিল সেটি থেকেই নারকীয় নির্মমতা ও ঘটনা পরবর্তী সামাজিক নিগ্রহে জর্জরিত তাদের জীবনগাঁথা চিত্রিত  হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে নারীর আত্মত্যাগের খন্ডিত চিত্র এটি। বিচারকালে উঠে এসেছে নির্মম এক সত্য। এ নির্মম সত্য যে কোনো সভ্য ও মানবিক মানুষকে করবে বেদনার্ত। পাঠক, যেহেতু, এ অভিযুক্তের বিচার শেষ হয়েছে, আপিলও নিষ্পত্তি হয়েছে তাই নিপীড়িতা মা ও নিপীড়নের পরিণতিতে জন্ম নেওয়া কন্যাসন্তান ট্রাইব্যুনালে এসে তাদের অব্যক্ত ও নিরন্তর বয়ে বেড়ানো বেদনার্ত যে কথাগুলো বলে গেছে তা জাতির সামনে তুলে ধরছি। ১৯৭১-এ সংঘটিত বর্বরতার অনেক অজানা নির্মম সত্য সামনে আসা প্রয়োজন। যেন আমরা জানতে ও বুঝতে পারি যে, আমাদের মা ও বোনেরা কী অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য, স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য।

সাক্ষী মাজেদা বেগম : (পি.ডব্লিউ-৫)

আমার নাম মোছা. মাজেদা বেগম ওরফে মাজেদা খাতুন, পিতা- মো. আতাব মিয়া (মৃত), মাতা- মোছা. আর্জুদা বানু (মৃত), স্বামী মো. আলাই মিয়া (মৃত)। ঠিকানা- গ্রাম- সুলতানপুর, থানা- মাধবপুর, জেলা- হবিগঞ্জ। আমি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৫৯/৬০ বছর। আমি একজন গৃহিণী। নার্সারিতে কাজ করে সংসার চালাই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ১৫/১৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে আমার বিয়ে হয়।

... মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমাদের এলাকার নোয়াপাড়া নিবাসী সৈয়দ মো. কায়সার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়। কায়সার সাহেবের ভয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গায়, ফসলের খেতে পালিয়ে থাকতাম। বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে দুপুর বেলা আমার বাবা ও আইয়ুব আলী চাচাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। এ সময় কায়সার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্য আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করল মতিন (সাক্ষীর চাচা) কোথায়? কায়সার সাহেব বলেছে তাকে ধরে নিয়ে যেতে। আমার বাবা প্রত্যুত্তরে বলল মতিন কোথায় আমি তা জানি না। এ সময় কায়সার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা আমার বাবাকে বন্দুক দিয়ে পিটাতে থাকে। বাবার চিৎকারে আমি ঘরের ভিতরে থেকে চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করি। তখন কায়সার বাহিনীর লোকেরা ভাতের থালা ও হাঁড়ি ফেলে দিয়ে আমার বাবা, আইয়ুব আলী চাচা ও আমাকে ধরে নিয়ে জগদীশপুর হাইস্কুলে অবস্থিত পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।  সেখানে গিয়ে দেখি কায়সার সাহেব আছেন। রাজাকার ও কায়সার বাহিনীর লোকেরা আমাকে ও আমার বাপ-চাচাকে কায়সারের সামনে হাজির করে।

(শেষ পর্ব পড়ুন আগামীকাল)

সর্বশেষ খবর