রবিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সাবেক প্রেসিডেন্টদের বাড়ি কাহিনি

সাইফ ইমন

সাবেক প্রেসিডেন্টদের বাড়ি কাহিনি

একটি দেশের প্রেসিডেন্ট সেই দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। তাঁর অধীনে থাকে সবাই। দুনিয়া কাঁপানো ক্ষমতাবান এই ব্যক্তিরা তাদের কর্মজীবন শেষে ফিরে যান পুরনো জীবনে। অনেকে অনেক রকম কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে ব্যস্ত সময় কাটান। কেউ লেখালেখি করেন। কেউ বাগান করেন। কেউবা তৈরি করেন রাজপ্রাসাদ। আবার অনেকে রয়েছেন যারা একদমই সাধারণ জীবনযাপন করেন। থাকেন সাধারণ খামারবাড়িতে। বিশ্বজুড়ে সাবেক কিছু রাষ্ট্রপ্রধানের বাড়ি ও জীবন নিয়ে আজকের রকমারি...

 

বারাক ওবামা (যুক্তরাষ্ট্র)

ভাড়া বাড়িতে থাকছেন এক সময়ের বিশ্বনেতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পর ওয়াশিংটন ডিসির মনোরম এলাকায় ৮ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি বাসা ভাড়া নেন বারাক ওবামা। হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর থেকে সেখানেই বসবাস করছেন সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার। ২০১৭ সালে বাড়িটি কিনে নেবেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। ওয়াশিংটনের উত্তর-পশ্চিম চতুর্থাংশের মধ্যে ক্যালোরামায় অবস্থিত বাড়িটি। এটি অভিজাত অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত। এ বাড়িতে বসে বেশির ভাগ সময় স্টাডি রুমে কাটান সাবেক প্রেসিডেন্ট। নিজের লেখালেখি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সময় কাটান। একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বছরে পেনশন পান প্রায় ২ লাখ ৬ হাজার ডলার। এ ছাড়া আরও কিছু ভাতা আছে। সব মিলিয়ে ওবামা এখন আগের চেয়ে বেশি ধনী। ওবামা সবসময়ই গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের চর্চা করতে আগ্রহী।  ২০০৯ সালে দ্য অডাসিটি অব হোপ ও ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার বই দিয়ে সফলতা পেয়েছিলেন।

 

মাহমুদ আহমাদিনেজাদ (ইরান)

সবচেয়ে সাধারণ বাড়িতে বসবাস

ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত প্রেসিডেন্ট। হাসান রুহানির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর খুবই সাধারণ বাড়িতে ওঠেন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। সেখানে নেই কোনো চাকচিক্য। এমনকি পোশাক পরিচ্ছেদেও অত্যন্ত সাধারণ মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। ২০০৫ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক হলেও ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পরপরই মূলধারার রাজনীতি করে আসছেন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ও তাঁর জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ ছিল। আর এ জন্য বিশ্বজুড়ে আলোচিতও ছিলেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল ভবনের দামি কার্পেটগুলো তেহরানের মসজিদে দান করে দিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর সহজ সরল জীবনযাপনের উদাহরণ টেনেই তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক বলা হয়ে থাকে।

 

বিল ক্লিনটন (যুক্তরাষ্ট্র)

ক্লিনটন দম্পতির রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শুভ্রস্বর্গ

২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর নেন ক্লিনটন। এরপর নিজের প্রতিষ্ঠিত ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন মানব কল্যাণমূলক কাজে তিনি জড়িয়ে পড়েন। তাঁর প্রচেষ্টায় ক্লিনটন ফাউন্ডেশন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গবেষণা খাতে বিনিয়োগ করে আসছে। হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর ওয়াশিংটনে নিজের বাড়িতে ওঠেন বিল ক্লিনটন। বাড়িটির নাম ‘হোয়াইটহ্যাভেন’। তাই একে ক্লিনটনের শুভ্রস্বর্গ বলাই যায়। বেশির ভাগ সময় ক্লিনটন দম্পতি এ বাড়িতেই বসবাস করেন। অবসরে বাড়ির বাগানে হাঁটতে পছন্দ করেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। লেখালেখি করেন স্টাডিরুমে বসে। তাঁর লেখা প্রথম বই ‘বিটউইন হোপ অ্যান্ড হিস্টোরি’ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবসরের পর তিনি আবারও লেখালেখি শুরু করেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’, যা ছিল সর্বাধিক বিক্রীত আত্মজীবনীগুলোর একটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় জেমস পেটারসনের  সঙ্গে লেখা তাঁর বহুল আলোচিত বই ‘দ্য প্রেসিডেন্ট ইস মিসিং’।

 

জর্জ ডব্লিউ বুশ (যুক্তরাষ্ট্র)

পেইন্টিংয়ে ব্যস্ত যুদ্ধবাজ  উপাধি পাওয়া প্রেসিডেন্ট

হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর সময় কাটানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা নানারকম কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে থাকেন। কেউ ফিরে যান নিজের ব্যবসা জগতে, কেউবা জড়িয়ে পড়েন জনকল্যাণমূলক কাজে। কিন্তু নজির স্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। কারণ তাঁর আগ্রহের বিষয় এখন রং আর তুলি। তাই রং-তুলিতেই নিজের শান্তি খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আর এ কাজের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন নিজের বাড়ি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  টেক্সাসে বসবাস করেন তিনি। ছবি আঁকতে পছন্দ করেন বলেই হয়তো নিজের বাড়িটিকেও সাজিয়েছেন তিনি ছবির মতো করেই। সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা বাড়িটিতে নির্জনে সময় কাটান এক সময়ের দুনিয়া কাঁপানো এই সাবেক প্রেসিডেন্ট। অনেকে তাঁকে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট বলেও আখ্যায়িত করেন। অথচ সেই তিনিই এখন নিভৃতচারী। ঝড় তোলেন রং-তুলির আঁচড়ে। ছবি আঁকায় সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন  চার্চিলের একটি প্রবন্ধ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।

 

 

নিউইয়র্কে রাজকীয় হালে থাকছেন ট্রাম্প

(যুক্তরাষ্ট্র)

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সদ্য পরাজিত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার শীর্ষ ধনীদের একজন। তাঁর রয়েছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট। নিউইয়র্কে ট্রাম্প টাওয়ার নামে রয়েছে একটি বহুতল ভবন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এখানেই তিনি থাকতেন। ট্রাম্প ভবনের পরতে পরতে রয়েছে রাজকীয় সাজসজ্জা। যার ছবি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ট্রাম্প টাওয়ার ভবনের তিনটি ফ্লোর নিয়ে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট। এর ৬৬, ৬৭, এবং ৬৮ তলাজুড়ে এ ট্রিপলেক্স ফ্ল্যাটেই ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া এবং তাঁদের পুত্র ব্যারন বাস করেন। এ অ্যাপার্টমেন্টটির আনুমানিক মূল্য ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ডলার। জানা যায়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের উইন্টার প্যালেস দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে মি. ট্রাম্প তাঁর নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টটি নতুন করে সাজান। ভবনটি নিউইয়র্কের কেন্দ্রস্থলে সেন্ট্রাল পার্কের পাশেই। নিউইয়র্কের এ ফ্ল্যাট ছাড়াও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরও অনেক বাড়ি আছে বিভিন্ন জায়গায়। এর একটি হচ্ছে নিউইয়র্ক স্টেটের সেভেন স্প্রিংস-এ। ২৩০ একর জায়গার ওপর ৩৯ হাজার বর্গফুট আয়তনের এ বাড়িটি হচ্ছে শহরের বাইরে তাঁর পারিবারিক বাড়ি।  এতে ৬০টি কক্ষ, ১৫টি শয়নকক্ষ ও তিনটি সুইমিং পুল।

 

পারভেজ মোশাররফ (পাকিস্তান)

দুবাইতে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট

১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোশাররফ। তার আগে তিনি ছিলেন দেশের সেনা বাহিনীর প্রধান। সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নওয়াজ শরিফের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন মোশাররফ।

একসময় চিকিৎসার জন্য দুবাইয়ে চলে যান পারভেজ মোশাররফ। সেখানে কিছু দিন হাসপাতালে থাকেন তিনি। এরপর থেকে তিনি দুবাইতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না কেউই। ২০১৬ সালেই দেশ ছেড়ে দুবাইয়ে রয়েছেন মোশাররফ। জানিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্যই সেখানে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু এরপর আর কখনো পাকিস্তানে ফেরেননি। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী একাধিকবার তিনি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার জন্যই দেশে ফিরতে পারছেন না তিনি। দুবাইতে বেশ জাঁকজমক বাড়িতে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে। বর্তমানে রাজনীতি থেকে অনেক দূরে প্রবাসেই নিজের  আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি।

 

এক ভুতুড়ে বাড়িতে জোসে মুজিকা

প্রেসিডেন্ট বলতেই যখন আমাদের মনে আসে একজন ক্ষমতাবান ও বিত্তবান ব্যক্তিত্বের ছবি, তখন জোসে মুজিকার নাম মনে নিলেই ভেসে ওঠবে দানশীল ও সহজ সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এক সাবেক রাষ্ট্রনায়কের ছবি। তার সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা ১ হাজার ৯০০ ডলারের একটি গাড়ি। তিনি নিয়মিত চলাচলের জন্য একটি অতি সাধারণ এ গাড়ি ব্যবহার করেন। ঘোরাফেরার জন্য তাঁর নিত্যসঙ্গী ২৮ বছরের পুরনো ভোক্সওয়াগান বিটল। বর্তমানে এটি ভেঙে করুণ দশায় উপনীত হয়েছে। পুরনো মডেল বলে খোদ নির্মাতা কোম্পানি ২০০৩ সাল থেকে এ গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। মুজিকার গাড়িটি কিনতে চেয়েছিলেন এক আরব শেখ। তিনি গাড়িটির দাম হাঁকেন ৮ কোটি টাকা। কিন্তু মুজিকা রাজি হননি কারণ এ গাড়ির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাঁর বাড়িটিকে কেউ বলেন ভূতের বাড়ি, কেউ বলেন পরিত্যক্ত।

ওপরে টিনের চাল, দেয়ালের আস্তর খসে পড়ছে। কাপড় কাচার ঘর বাইরে। কূয়া থেকে পানি তুলে নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে হয়। ভাঙাচোরা এ খামারবাড়িও নিজের নয়। মালিক তাঁর স্ত্রী। এখানেই থাকেন উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসে মুজিকা। রাজনীতিবিদদের আরাম-আয়েশ আর চাকচিক্যময় জীবন তাঁকে টানে না। বিশ্বের মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত লাতিন রাষ্ট্র উরুগুয়ের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল প্রায় দেড় লাখ ডলার। কিন্তু বেশির ভাগ অর্থ তিনি দান করে দিয়েছেন। নিজের বেতনের শতকরা ৯০ ভাগই এই প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দান করে দেন। এ দানশীলতার কারণেই তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাঁর স্ত্রী লুসিয়াও ছিলেন একজন সিনেটর। তিনিও বেতনের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দান করে দিয়েছেন। জোসে মুজিকার দানশীলতার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যাদের মাসিক আয় এর থেকেও অনেক কম যা দিয়ে দিন পার করছে। উরুগুয়ে প্রশাসনের সাবেক সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এ ব্যক্তির বসবাসের জীর্ণ খামার বাড়িটি দেখলে অনেকেই ভূতের বাড়ি বলে চমকে ওঠে। বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকার বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন নিতান্তই এক সাধারণ জীবন। এখনো কর্দমাক্ত পথ পেরিয়েই নিজের খামারবাড়িতে পৌঁছতে হয় তাঁকে। এখনো খামারে স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত কৃষিকাজ করেন তিনি। খামারে চাষ করছেন হরেক রকমের ফুল। একটি ভাঙাচোরা কূয়ার পানিই বাড়িতে  পানি সরবরাহের একমাত্র ব্যবস্থা।

সর্বশেষ খবর