রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খনি শ্রমিক থেকে বিশ্বসেরা

আবদুল কাদের

খনি শ্রমিক থেকে বিশ্বসেরা

লেখক হিসেবে বিশ্বজুড়ে মার্ক টোয়েন নামে পরিচিত। ছিলেন লেখক, বক্তা, রসজ্ঞ ও পর্যটক। বিচিত্র কাজ করেছেন। মুদ্রক, নৌকার মাঝি ও খনি শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। এমনকি করেছেন ব্যবসাও। ছোট গল্প লিখে বিপুল খ্যাতির অধিকারী হন। কিশোরদের জন্যও লিখেছেন কালজয়ী বই।  জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মের জন্য সমাদৃত এ লেখক...

 

বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার গল্প

মার্ক টোয়েন, কালজয়ী এক লেখক ও সাহিত্যিকের নাম। যদিও ‘মার্ক টোয়েন’ নামটি লেখক নিজেই তাঁর ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিখ্যাত এ লেখকের আসল নাম স্যামুয়েল লংহর্ন কিমেন্টস। বিখ্যাত লেখকের সাহিত্যকর্ম এখনো পাঠক, সাহিত্যবোদ্ধাদের বিস্ময়ে ডুবিয়ে রেখেছে।  যদিও টোয়েন আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিলেন না, তা সত্ত্বেও তাঁর রম্যবোধ আর চপলবুদ্ধি ছিল তীক্ষè। তাঁর সময়ে গোটা আমেরিকায় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা। মার্কিন গ্রন্থকার উইলিয়াম ফল্কনার টোয়েন সম্বন্ধে বলেছিলেন, টোয়েন ছিলেন ‘প্রথম এবং প্রকৃত আমেরিকান লেখক, তাঁর পরের আমরা সবাই তাঁর উত্তরাধিকারী’। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য কর্ম ‘অ্যাডভেঞ্চার্স অব টম সয়্যার’ এবং ‘অ্যাডভেঞ্চার্স অব হাকলবেরি ফিন’। এ উপন্যাসদ্বয় বিশ্বসাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করেছে। টোয়েন তাঁর  বেড়ে ওঠা শহর হ্যানিবাল, মিসৌরিতেই বিখ্যাত দুটি উপন্যাস হাকলবেরি ফিন এবং টম সয়্যার রচনার মূল উপাদান খুঁজে নিয়েছিলেন। একজন প্রকাশকের অধীনে কিছু দিন শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন। সেই কাজে চমক দেখিয়ে মুদ্রণ সন্নিবেশক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সে সময় বড় ভাইয়ের সংবাদপত্র তাঁর নজর কাড়ে। সেখানে প্রবন্ধ লেখেন মার্ক টোয়েন। ১৮৬৫ সালে তাঁর কৌতুকপূর্ণ গল্প প্রকাশ হলে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রসিক স্কেচ ‘দ্য ড্যান্ডি ফ্রাইমিং অব স্কিটার’ বোস্টনের একটি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর তিনি রম্য লেখক হিসেবে সবার নজরে আসেন। সাংবাদিক থেকে আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের একজন হয়ে ওঠেন।

তবে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে তাঁকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ায় খনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে রচিত ‘জিম স্মাইলি অ্যান্ড হিজ জাম্পিং ফগ’ গল্পটি সবার কাছে প্রশংসিত হয়।  এ ছোট গল্পটি মূলত সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যরসাত্মক লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। ধীরে ধীরে তাঁর লেখা ছোট গল্প ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ছোট গল্পের পাশাপাশি রম্য রচনা আর কলাম লিখেও সমানতালে এগিয়ে যান মার্ক টোয়েন। মাঝি (নাবিক) না হলেও পর্যটক হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইন যাত্রার বাস্তব কাহিনিকে হাস্যরসিকতার রং চড়িয়ে ১৮৬৭ সালে তিনি লিপিবদ্ধ করেন ‘ইনোসেন্ট অ্যাবরোড’ নামক বইয়ে।  তাঁর লেখা গল্পের বইগুলোয় সংক্ষিপ্ত বিবরণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আনা হতো। এমনকি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল তাঁর অসংখ্য বই। গদ্য ও বক্তৃতায় তাঁর বুদ্ধি ও বিদ্রূপাত্মকতা, সমালোচক ও সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করে। শুধু লেখালেখিতে নয়, বক্তৃতা দিয়েও খ্যাতি অর্জন করেন টোয়েন। তাঁর রম্য বক্তৃতাকে আজকের স্ট্যান্ডআপ কমেডির সঙ্গে তুলনা করা হয়। লেখক খ্যাতির সঙ্গে বক্তা হিসেবে বাড়তি জনপ্রিয়তা যোগ হলে মার্ক টোয়েন রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন। অর্থপ্রাচুর্যে জীবন কাটে তাঁর। অবশ্য সে জীবন বেশি দিন টেকেনি। নতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে এক সময় দেউলিয়ার পথে হাঁটেন।

বন্ধু হেনরি হাটলসন রজার্সের পরামর্শে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। আর্থিক দুরবস্থা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেন মার্ক টোয়েন।

এক সময় সব দেনা পরিশোধ করেন। যদিও দেনা পরিশোধে টোয়েনের ওপর আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমেরিকার বিখ্যাত এ লেখক জীদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর পরও যুগ যুগ গল্পে কিংবা কথায় তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত এবং ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনভঙ্গি সমালোচক, পাঠক নির্বিশেষে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। অক্সফোর্ড থেকে ইয়েল- নামিদামি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির ফুলঝুরিতে ভেসে গেছেন আমেরিকার বিখ্যাত এ লেখক ও সাহিত্যিক।

 

বিবর্ণ শৈশবের কাহিনি

আমেরিকার সাহিত্যের জনক ও বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন। জন্ম ১৮৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। আসল নাম স্যামুয়েল লংহর্ন ক্লিমেন্টস। কিন্তু ছদ্মনামে লেখালেখি করে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হন। মার্ক টোয়েন ছিলেন কেন্টাকির অধিবাসী। তিনি ভার্জিনিয়ান অধিবাসী জন মার্শাল ক্লেমেন্সের সন্তান। বাবা ছিলেন একজন অ্যাটর্নি ও বিচারক।

অসংখ্য শিশুর শৈশব রঙিন করা এ সাহিত্যিকের শৈশব ছিল বিবর্ণ। সাত ভাইবোনের মধ্যে মার্ক ষষ্ঠ, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে বেঁচে ছিলেন মাত্র তিনজন। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই তাঁকে তাঁর মায়ের পেট কেটে বের করা হয়। অপুষ্ট শরীরের কারণে তাঁর বেঁচে থাকাটাই ছিল সন্দিহান। তাঁর বয়স যখন চার বছর, তখন তাঁর বাবা মিসৌরির হ্যানিবালে পাড়ি দেন। মিসৌরি সে সময় ছিল একটি দাস শহর। এখান থেকে ছোট্ট টোয়েন আমেরিকার দাস প্রথা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৮৪৭ সালে, ১১ বছর বয়সে বাবা জন মার্শাল (৪৯) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এদিকে ছোট্ট টোয়েন অত্যন্ত রুগ্ন ছিলেন। সামান্য অসুখে ভেঙে পড়তেন। পিতৃহারা হয়ে বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন মার্ক টোয়েন।

বাবার মৃত্যুর পর স্কুলের পাঠ চুকিয়ে পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করেন। ১৮৫১ সালে মার্ক টোয়েন একজন প্রকাশকের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন। সে সময় ‘হ্যানিবাল জার্নাল’ নামের একটি স্থানীয় পত্রিকায় খাদ্যের বিনিময়ে টাইপসেটার (মুদ্রক) হিসেবে চাকরি নেন। পত্রিকায় একজন প্রদায়ক হিসেবে নানা প্রবন্ধ ও রম্য স্কেচ আঁকা শুরু করেন। এখান থেকে লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় মার্ক টোয়েনের। পরে বড়ভাই ওরিয়ন ক্লেমন্সের সম্পাদনায় চালিত পত্রিকা ‘হ্যানিবাল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন’ পত্রিকায় টাইপিংয়ের পাশাপাশি লেখালেখি আর সম্পাদনা করার সুযোগ পান। ১৮  বছর বয়সে টোয়েন হ্যানিবাল ত্যাগ করেন। নিউইয়র্ক সিটি, ফিলাডেলফিয়া, সেন্ট লুইস, সিনসিনাট্টি এবং ওহিওতে প্রকাশক হিসেবে কাজ করেন।

১৮৫৭ সালে ২১ বছর বয়সে পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি মিসিসিপি নদীতে রিভারবোট পাইলট (মাঝি) হিসেবে কাজ করেন। মিসিসিপিতে এক রিভারবোট পাইলট হওয়ার পর বেশ খুশি ছিলেন টোয়েন। স্বপ্ন ছিল জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। তবে ভাগ্য সহায় হলো না, ১৮৬১ সালে আমেরিকান সিভিল ওয়ারের (গৃহযুদ্ধ) সময় সেই চাকরি থেকে ইস্তফা নেন। তবে জলপথ আর রিভারবোট তাঁর ভালো লেগে যায়। ‘মার্ক টোয়েন’-এর শাব্দিক অর্থ ‘১২ ফুট গভীর জল’। রিভারবোট পাইলট হিসেবে কাজ করার সময়ই ‘মার্ক টোয়েন’ নামটি তাঁর মাথায় আসে। সেই থেকে তিনি ‘মার্ক টোয়েন’কেই ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেন।

রিভারবোট পাইলটের কাজ ছেড়ে ভার্জিনিয়া শহরে স্বর্ণের খনিতে মাইনিং (খনি শ্রমিকের) কাজ করেন। কষ্টের কাজ বলে সেটাও বেশি দিন করতে পারেননি। শেষমেষ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে নেভাদায় পাড়ি জমান। ১৮৬২ সালে, ভার্জিনিয়ার একটি সংবাদপত্র ‘ভার্জিনিয়া সিটি টেরিটোরিয়াল’-এ লেখালেখির কাজ পেয়ে যান। ‘মার্ক টোয়েন’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে সংবাদকে হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপনের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি ব্যঙ্গচিত্র আঁকায়ও পটু ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

 

দারিদ্র্যের জন্য শেষ করেননি পড়াশোনা

বাবা জন মার্শালের মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে বাধ্য হন মার্ক টোয়েন। দারিদ্র্যের বেড়াজালে বারবার পেশা বদল করেন। সংসারের আর্থিক দ্বৈন্যতা কাটাতে উপার্জনের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৮৫১ সালে ওরিয়নের মালিকানাধীন ‘হ্যানিবাল জার্নাল’ নামের একটি স্থানীয় পত্রিকায় টাইপসেটারের (মুদ্রণ সন্নিবেশক) কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই পড়াশোনার ইতি ঘটে বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের। তবে লেখালেখি শুরুর আগেই নানা পেশায় জড়িয়েছিলেন মার্ক টোয়েন। পরিবারের অর্থ উপার্জনে সাহায্য করার জন্য কিশোর বয়সেই স্টোর ক্লার্ক ও ডেলিভারি বয়ের কাজ শুরু করেন। নৌকার মাঝি ও খনি শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। করেছেন ব্যবসাও। ১৮৫৩ সালে হ্যানিবাল ত্যাগ করেন এবং নিউইয়র্ক সিটি, ফিলাডেলফিয়া, সেন্ট লুইস, মিসৌরি, সিনসিনাট্টি এবং ওহিওতে প্রকাশক হিসেবে কাজ করেন। টাইপসেটারের কাজ করার পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন। এক সময় হয়ে ওঠেন লেখক ও সাহিত্যিক। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর পড়াশোনার সার্টিফিকেট ছিল সীমিত।

 

ভ্রমণ লেখক

১৮৬১ সালে মার্ক টোয়েন ও তাঁর ভাই একসঙ্গে পশ্চিমে রওনা দেন। দুই ভাই মিলে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে একটি স্টেজকোচে চেপে বৃহৎ ভূমি এবং রকি পর্বতের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেন। টোয়েনের ভ্রমণ ভার্জিনিয়া সিটি, নেভাদার রৌপ্য খনির শহরে এসে শেষ হয়। সেখানে ‘কমস্টক লোড’-এ খনি শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। খনি শ্রমিক হিসেবে ব্যর্থ হন এবং ভার্জিনিয়া সিটির পত্রিকা ‘দ্য টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজ’-এ কাজ শুরু করেন। পশ্চিমে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লেখার নানা উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৮৬৫ সাল, স্যাক্রামেন্টো ইউনিয়ন হাইওয়ে ভ্রমণবিষয়ক একটি প্রতিবেদন করার জন্য মার্ক টোয়েনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময় ‘স্যান্ডইউচ দ্বীপপুঞ্জ’ এবং ‘হাইললুলু’ পত্রিকা তাঁর ভ্রমণ প্রতিবেদন প্রকাশ করত। ১৮৬৬ সালে ‘অ্যালতা ক্যালিফোর্নিয়া’র ভ্রমণ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। এ পেশাকে তিনি ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকে তিনি পৃথিবীকে চেনেন। তাঁর প্রতিবেদনগুলো চিঠি আকারে পাঠাতেন। তাঁর লেখা ‘কানেকটিকাট ইয়াঙ্কিও’ এবং ‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’ পাঠকদের মনে সারা জাগিয়েছিল। ১৮৮৫ সালে টোয়েন দেউলিয়া হওয়ার পর আবারও বিশ্বভ্রমণ শুরু করেন।

 

চলে যান দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে

মার্ক টোয়েন লেখালেখি করে প্রচুর আয় করেছিলেন। পাশাপাশি নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে তাঁর আগ্রহ ছিল। সে কারণে প্রচুর অর্থ-বিত্ত খুইয়েছিলেন টোয়েন। তিনি তাঁর আয়ের একটি বড় অংশ নতুন আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিতে, বিশেষ করে ‘পেইগ মুদ্রণ সন্নিবেশকারী যন্ত্রের’ ওপর বিনিয়োগ করার মাধ্যমে হারিয়েছিলেন। ১৮৮০ থেকে ১৮৯৪ সালের মধ্যে তিনি এ যন্ত্রের পেছনে ৩ লাখ ডলার ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু তা পুরোপুরি উপযুক্ত হওয়ার আগেই লাইনোটাইপ যন্ত্রের কারণে অযোগ্য হয়ে যায়। ফলে টোয়েন তাঁর লেখালেখি থেকে উপার্জিত অর্থ হারানোর পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী অলিভিয়ার সম্পত্তির উল্লেখযোগ্য অংশও হারিয়ে ফেলেন। এ সময় নতুন বন্ধুর নিঃস্বার্থ সহযোগিতা তাঁকে আবার আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ১৮৯৩ সালে হেনরি এইচ রজার্সের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। বন্ধু রজার্স টোয়েনকে প্রথমে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করতে বলেন। টোয়েনের লেখালেখির স্বত্বাধিকার তাঁর স্ত্রী অলিভিয়ার কাছে হস্তান্তর করান। উদ্দেশ্য পাওনাদাররা যেন সে সবের দখল নিতে না পারে।  এরপর টোয়েন দীর্ঘ এক বছর মেয়াদের জন্য বিশ্বব্যাপী বক্তৃতা প্রদানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। যাত্রার অংশ হিসেবে হাওয়াই, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মৌরিতানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। পাওনা শোধ করার মতো যথেষ্ট অর্থ উপার্জন শেষে ১৯০০ সালে মার্ক টোয়েন আমেরিকায় ফিরে আসেন।

 

বক্তৃতা প্রদানে পারদর্শিতা

নির্বাচিত রম্য বক্তা হিসেবেও মার্ক টোয়েন ছিলেন প্রচুর জনপ্রিয়। তাঁর রম্য বক্তৃতাকে বিশেষজ্ঞরা আজকের সময়ের স্ট্যান্ডআপ কমেডির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি নানা সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অথরস ক্লাব, বিফস্টিক ক্লাব, ভ্যাগাবন্ডস, হোয়াইট ফ্রায়ারস এবং হ্যার্টফোর্ডের সান্ধ্যকালীন রম্য বক্তৃতায় তিনি দর্শক মাতিয়ে রাখতেন। ১৮৯০ সালে লন্ডনের স্যাভেজ ক্লাবে বক্তৃতা দিয়ে ক্লাবের সম্মানসূচক সদস্যপদ লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের প্রিন্স অব ওয়েলস অ্যাওয়ার্ড পান। ১৮৯৭ সালে ভিয়েনার কনকর্ডিয়া প্রেস ক্লাব ও ১৯০১ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য সংঘতেও বক্তৃতা করেন। তিনি নিয়মিত যার সঙ্গেই কথা বলেতেন তার যে কোনো প্রশ্নের হাস্যরসাত্মক উত্তর দিতেন। সে সময় তাঁর হাস্যরসে বুঁদ হতেন সবাই।

 

বিয়ে এবং সন্তানাদি

১৮৬৮ সাল পুরোটা মার্ক টোয়েন এবং অলিভিয়া একসঙ্গে ছিলেন। প্রথমবার অলিভিয়া টোয়েনের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। অবশ্য এর দুই মাস পর তাঁরা পরস্পরের সম্মতিতে বাগদান করেন। ১৮৭০ সালে নিউইয়ার্কে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

অলিভিয়া ছিলেন ধনী পরিবারের মেয়ে। টোয়েন দম্পতি ১৮৬৯ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত বাফেলো, নিউইয়র্কে বসবাস করেন। বাফেলোয় থাকাকালীন তাঁদের সন্তান ল্যাংডন মাত্র ১৯ মাস বয়সে ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। টোয়েন দম্পতি তিন কন্যার জনক-জননী ছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর একসঙ্গে কাটানোর পর ১৯০৪ সালে অলিভিয়া মৃত্যুবরণ করেন। ক্লেমেন্স পরিবারের সব সদস্য নিউইয়র্কের উডলন সমাধিতে শায়িত আছেন।

 

নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী

মার্ক টোয়েন কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ তিনি আগেই জানতেন! ১৮৩৫ সাল, তাঁর জন্মের বছর আকাশে দেখা যায় হ্যালির ধূমকেতু, যেটি প্রতি ৭৫ বছর পর পর আবির্ভূত হয়। ১৯০৯ সালে মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে এসেছি হ্যালির ধূমকেতুর সঙ্গে। সামনে এটি আবার আসছে। আমার মনে হয় আমি এই ধূমকেতু আসার বছরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব। এমনটা হলে তা হবে হাতাশার। এমন লেখা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল সাধারণ পাঠক। নিজের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করে ১৯১০ সালের ২১ এপ্রিল পৃথিবী থেকে বিদায় নেন বিখ্যাত এ লেখক ও সাহিত্যিক। কাকতালীয়ভাবে তাঁর মৃত্যুর এক দিন আগেই আকাশে দেখা দিয়েছিল হ্যালির ধূমকেতু।

 

অনন্য সাহিত্যকর্ম

১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয় মার্ক টোয়েনের ছোট গল্প ‘দ্য সেলিব্রেটেড জাম্পিং ফ্রগ অব কালাভেরাস কাউন্টি’। এ গল্প ছাপা হওয়ার পর মার্ক টোয়েনকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ছোট গল্পকার হিসেবে খ্যাতি বাড়তে থাকে মার্ক টোয়েনের। ১৮৮৪ সালে, চঞ্চল প্রকৃতির একটি ছেলে ও এক কৃতদাসের গল্প ‘অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ লিখে উঠে আসেন সেরা সাহিত্যিকদের তালিকায়। দুরন্ত আর ডানপিটে এক কিশোর হাকলবেরি ফিন। তার সঙ্গী জিম নামের এক ক্রীতদাস। কিশোর আর কৃতদাসের রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে লেখা বইটি সে সময় ব্যাপক সাড়া জাগায়। গল্পে তুলে ধরা হয় আমেরিকার দাসপ্রথার অন্ধকার ইতিহাস। আরও আছে দরিদ্রতার গল্প। কালজয়ী এ লেখক তাঁর ৭৫ বছরের জীবনে উপহার দিয়ে গেছেন অসংখ্য বই। লেখালেখির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সে সময়কার বাস্তব চিত্র। পাশাপাশি আরও অসংখ্য রচনায় মুখরিত ছদ্মনামধারী স্যামুয়েল লংহর্ন ক্লিমেন্টস। মার্ক টোয়েনের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার’ (১৮৮১), ‘লাইফ অন দ্য মিসিসিপি’ (১৮৮৩), ‘আ কানেক্টিকাট ইয়াংকি ইন কিং আর্থার’স কোর্ট’ (১৮৮৯), ‘পুডনহেড উইলসন’ (১৮৯৪)। এর পাশাপাশি কলাম ও ছোট গল্পেরও কয়েকটি বই বের হয় মার্ক টোয়েনের। এসব বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দ্য ১,০০০,০০০ ব্যাংক- নোট অ্যান্ড আদার স্টোরিস’ (১৮৯৩), ‘দ্য ম্যান দ্যাট করাপ্টেড হাইডেলবার্গ অ্যান্ড আদার এসেইস’ (১৯০০), ‘হোয়াট ইজ ম্যান?’ (১৯০৬)। মার্কিন গ্রন্থকার উইলিয়াম ফকনার  মার্ক টোয়েনের সাহিত্যকর্মে মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘আমেরিকান সাহিত্যের জনক’ আখ্যায়িত করেন।’ সেই থেকে বিখ্যত লেখকের লেখনীতে মুগ্ধ বিশ্ববাসী।

 

সর্বশেষ খবর