সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাস্কর্য আর স্মৃতিসৌধে নারীর প্রতি সম্মাননা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ভাস্কর্য আর স্মৃতিসৌধে নারীর প্রতি সম্মাননা

কবি নজরুল আজ থেকে কমপক্ষে ৬০ কিংবা ৭০ বছর আগের পরিবেশ বিবেচনা করেই হয়তো সেদিনকার কথা এভাবে বলেছেন। আজ একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় দেখা যায় নারীর অবস্থান অনেকটাই পাল্টে গেছে। নারী আজ কেবল ‘বিজয় লক্ষ্মী’ হয়ে পুরুষকে ‘প্রেরণা’ বা ‘শক্তি’  জোগানোর কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং ‘বিজয়’ ছিনিয়ে আনতে পুরুষদের পাশাপাশি লড়াই করছে সম্মুখ সমরে। তাদের কেউ আকাশে উড়ছে জঙ্গিবিমান নিয়ে, আবার গভীর সমুদ্রে ডুব দিচ্ছে সাবমেরিন নিয়ে। বন, জঙ্গল, সমতল ভূমি, পাহাড়, মরুভূমি কিংবা বরফে ঢাকা তুষার অঞ্চলে আকাশ-বাতাস গর্জে উঠছে নারীর হাতে থাকা মেশিনগান, মিসাইল, ড্রোন কিংবা কামানের গোলার শব্দে। নারীকে আরও এগিয়ে নিতে আজ স্মৃতিসৌধ (নজরুলের ভাষায় বিজয় স্তম্ভ) গড়ে উঠছে দেশে দেশে, যেখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় যুদ্ধ ও শান্তিতে নারীর অসামান্য অবদান। নারীর প্রতি এ সম্মান তাদের আরও  এগিয়ে যেতে ক্রমাগত জোগান দিচ্ছে ‘প্রেরণা’ ও ‘শক্তি’।

 

যুগের পরিবর্তন

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘নারী’ কবিতায় দুঃখ করে লিখেছেন :

“জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,

মাতা, ভগ্নী বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।

কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,

কত নারী দিল সিঁথির সিঁধুর লেখা নাই তার পাশে।

কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি, কত বোন দিল সেবা

বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?

কোনো কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারী,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি  দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”

 

 

মনুমেন্ট টু দ্য ওমেন অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু [ইংল্যান্ড]

মানব ইতিহাসে এক কলঙ্কের নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত টানা ছয় বছর চলে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ। যুদ্ধের একদিকে ছিল ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশ নিয়ে গঠিত মিত্রবাহিনী। অন্যদিকে ছিল জার্মান নেতৃত্বাধীন সেন্ট্রাল ফোর্স বা অক্ষ বাহিনী। জার্মানদের পক্ষ অবলম্বন করে জাপান, ইতালিসহ আরও কিছু দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সংঘাতে প্রায় আড়াই কোটি সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। আহত হয় তারও দ্বিগুণ। নিখোঁজের তালিকাও অনেক দীর্ঘ। বেসামরিক বা সাধারণ মানুষের মধ্যে আহত ও নিহতের সংখ্যাও কয়েক কোটি। সামরিক ও বেসামরিক, উভয় ক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে বিরাট অংশে রয়েছে সাহসী, অসহায়, নিঃস্ব, ধনী, দরিদ্রসহ বিভিন্ন প্রকৃতির নারী ও নারীশিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উভয় পক্ষে মোট অংশ নেওয়া সৈন্য সংখ্যা ছিল ৭ কোটিরও বেশি। এই সৈন্যদের মধ্যে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া নারী সৈন্য এবং সহযোগিতা করা নারী সৈন্যদের সংখ্যাও ছিল বড় আকারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধভিত্তিক জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও নারীদের আবেদনের স্মরণে বিশেষ স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠে। কিন্তু যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া খোদ ব্রিটেনে নব্বই দশকেও এমন কোনো স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠেনি। বিষয়টিকে আলোচনার পদপ্রান্তে তুলে আনেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ লড়াকু যোদ্ধা মেজর ডেভিড ম্যাকনেলি রবার্টসন। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারী  সৈন্যদের সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের নতুন যুদ্ধ। মেজর রবার্টসন ও তার সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় প্রথমেই চলে অর্থ সংগ্রহের কাজ, যেখানে যুক্ত হন সাংবাদিক, প্রযোজক, সংসদ সদস্য ও সংসদের স্পিকার এবং রাজকুমারী প্রিন্সেস রয়াল। অর্থ সংগ্রহের কাজে আরও এগিয়ে আসে ‘দি ন্যাশনাল হেরিটেজ মেমোরিয়াল ফান্ড, টিভি শো ‘হু ওয়ান্ট টু বি এ মিলিওনিয়ার’সহ বেশ কিছু সংগঠন।

অর্থ সংগ্রহের পর ‘‘মনুমেন্ট টু দ্য ওমেন অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’’ নামের মূল ভাস্কর্যটির ডিজাইন করা হয়। ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় ব্রোঞ্জ দিয়ে, যার সর্বমোট উচ্চতা ২২ ফুট। মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা ১৬ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট। ভাস্কর্যের লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত সৈন্যদের রেশন বরাদ্দের বইয়ে ব্যবহৃত অক্ষরগুলোর অনুকরণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারী যোদ্ধারা পেশা এবং কাজের সুবিধার্থে বিভিন্ন ধরনের সামরিক পোশাক পরিধান করত। এমন ১৭ সেট পোশাক ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মাণের ভাস্কর জন উইলিয়াম মিল ফুটিয়ে তুলেছেন এই ভাস্কর্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৬০ বছর পূর্তিতে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০০৫ সালের ৯ জুলাই ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনেক সংসদ সদস্য, প্রতিরক্ষা সচিব, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং কয়েক শ অবসরপ্রাপ্ত নারী যোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর নারী পাইলটরা এ সময় হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান চালিয়ে ও সামরিক কসরত দেখিয়ে শ্রদ্ধা জানায় নারী সেনাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্মরণে পৃথিবীর দেশে দেশে নানা আকৃতির দর্শনীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও শুধু নারী সেনাদের সম্মানে নিবেদিত ইংল্যান্ডের মনুমেন্ট টু দ্য ওমেন অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার একটি আবেগ ও অনুভূতির স্মৃতিসৌধ হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। রাজধানী লন্ডনের হোয়াইটহিলে অবস্থিত এই ভাস্কর্যের স্রষ্টা ভাস্কর জন উইলিয়াম মিলও অমর হয়ে আছেন এই অসাধারণ  সৃষ্টির মাধ্যমে।

 

ভিয়েতনাম ওমেন্স মেমোরিয়াল [আমেরিকা]

১ নভেম্বর ১৯৫৫ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর ভিয়েতনাম, লাউস ও কম্বোডিয়ায় ঘটে যায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পুঁজিবাদী পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েতনাম অস্ত্র তুলে ধরে সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজম মতাবলম্বী দেশসমূহের সমর্থনপুষ্ট উত্তর ভিয়েতনামি সেনাদের বিরুদ্ধে। এই আবরণের অন্তরালে এই মূলের একদিকে যুদ্ধে ছিল পুঁজিবাদী আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ তাদের মিত্ররা। অন্যদিকে তাদের প্রতিহত করতে জোট বাঁধে সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমে বিশ্বাসী চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়া। একসময় লাউস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া এবং আশপাশের আরও কিছু এলাকা দখলে নেয় ফ্রান্স বাহিনী এবং ওই এলাকাকে ফ্রান্স কলোনিতে পরিণত করে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্ট দেশসমূহের সমর্থন নিয়ে ভিয়েতনাম গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ১৯৪৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ফ্রান্সের পরাজয় ও প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে প্রথম ‘ইন্দো-চায়না যুদ্ধ’ নামের এ সংঘাত শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। এরপর লাউস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে শুরু হয় আমেরিকার আধিপত্যবাদ। ভিয়েতনাম তখন উত্তর ও দক্ষিণ, এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রথমে একদল সামরিক উপদেষ্টা পাঠায় এবং অস্ত্রসহ সব যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠিয়ে কয়েক হাজার সৈন্য প্রস্তুত করে। এর বিপরীতে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা উত্তর ভিয়েতনামে তৈরি করে লক্ষাধিক গেরিলা। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আমেরিকা সরাসরি তাদের সৈন্য পাঠানো শুরু করে ভিয়েতনামে। ১৯৬৯ সালে এক পর্যায়ে ভিয়েতনামে আমেরিকার সৈন্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখে পৌঁছে। আমেরিকার সৈন্যদের মধ্যে একটা অংশজুড়ে ছিল নারী সেনা। ১৯৭৩ সালে এই নারী সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। আমেরিকার নারীরা মূলত নার্স অর্থাৎ চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে তাদের মাঝে অনেকেই স্বেচ্ছায় রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে সরাসরি যুদ্ধ করেন। এ ছাড়াও যুদ্ধবিমানের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ ও যুদ্ধক্ষেত্রে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে ব্যাপক ভূমিকা ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার নারী সেনাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজধানী ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মলে ১৯৯৩ সালে গড়ে তোলা হয় ‘ভিয়েতনাম ওমেন্স  মেমোরিয়াল’ নামের ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যে সামরিক পোশাকে তিনজন নারী সৈন্য এবং যুদ্ধে আহত একজন সম্মুখযোদ্ধার অবয়ব রয়েছে। ভাস্কর্যে দেখা যায় আহত পুরুষ সৈন্য মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং অপর নারী সৈন্য তাকে ধরে রেখেছেন। ভিয়েতনামে যুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকার সেনাদের স্মরণে দেশটিতে ‘দি ওয়াল’সহ বেশ কিছু স্মৃতিমিনার থাকলেও শুধু নারীদের স্মরণে তেমন কিছু ছিল না। বিষয়টি পীড়া দেয় ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকার নারী নার্স ডিয়ানি কার্ললস ইভান্সকে। তার মতে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার প্রায় ১১০০ নারী সৈন্য অংশ নেয় এবং ওই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার ২ লাখ ৬৫ হাজার সৈন্য নিয়োজিত ছিল। আমেরিকান নারীদের এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ইভান উদাত্ত আহ্বান জানান এবং ক্রমাগত লবিং করতে থাকেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ৫০টি রাজ্যে এগিয়ে আসে একদল মহিলা সংগঠক, স্বেচ্ছাসেবী, নারীবাদী এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর ইভান ও তার সঙ্গীরা ক্রমাগত অর্থ সংগ্রহ করে এবং ভাস্কর্য নির্মাণে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেন। সব আয়োজন ও কর্তৃপক্ষের অনুমোদন শেষে মূল ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তিনশরও বেশি শিল্পী, স্থপতি ও ভস্কর এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এদের মধ্যে নিউ মেক্সিকোর ভাস্কর গ্লিনা ম্যাক্সি গোদারি জিতে নেন সেরা ভাস্করের পুরস্কার। এরপর তারই তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় ৭ ফুট উঁচু ব্রোঞ্চ নির্মিত তিন নারী ও এক পুরুষ যোদ্ধার অবয়ব বিশিষ্ট ভাস্কর্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়া এককালের মার্কিন সেনা ও পরবর্তীতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোরের উক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ‘ভিয়েতনাম ওমেন্স মেমোরিয়াল’ ভাস্কর্যটি হাজার হাজার জনতা বিশেষত ভিয়েতনাম  যুদ্ধফেরত সেনাদের উপস্থিতিতে উদ্বোধন করা হয়।

 

বাংলাদেশের ভাস্কর্যে নারীর প্রতি সম্মান

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনো প্রকার ভাস্কর্য বা শারীরিক প্রতিবিম্ব নির্মাণের বিপক্ষে। তদুপরি নারীর শারীরিক গঠন সংবলিত ভাস্কর্য নির্মাণ ঐতিহ্যগতভাবেই একটি দুরূহ কাজ বলে বিবেচিত হয়। তবুও নারীর প্রতি যোগ্য সম্মান জানাতে এগিয়ে এসেছেন অনেক ভাস্কর। কখনো প্রতীকী স্থাপত্যে কখনোবা সরাসরি নারীর প্রতিবিম্বকে তারা স্থান দিয়েছেন পুরুষ প্রতিবিম্বের সঙ্গে একই কাতারে। এদেরই একজন স্থপতি হামিদুর রহমান। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে শহীদ হন ভাষাসৈনিক সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে। অকালে প্রাণ হারানো এই তরুণ ও যুবকদের মায়ের কথা স্মরণ করে স্থপতি হামিদুর রহমান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত জাতীয় শহীদ মিনারে একটি স্তম্ভ উৎসর্গ করেছেন। এই শহীদ মিনারে দেশের অহংকারের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চারটি স্তম্ভ। এসব স্তম্ভের ঠিক মাঝেরটিকে একজন মায়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন গুণী এই স্থপতি। মাঝের স্তম্ভটির উপরের অংশ সামান্য বাঁকা হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এতে সন্তানদের নিজের বুকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে বাঙালি মায়ের স্বভাবজাত প্রবণতাই ফুটে উঠেছে। মায়ের দুই পাশে সোজা হয়ে দন্ডায়মান ৪টি সোজা স্তম্ভ যেন মায়েরই চার সন্তান, যারা ভাষা ও দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।

 

অপরাজেয় বাংলা

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নির্মিত একটি ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে এই ভাস্কর্যে ঠাঁই পেয়েছেন তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার একজন নারী। এই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ, যিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার স্থাপত্যে সাধারণ পোশাকে কাঁধে রাইফেল ঝোলানো মুক্তিযোদ্ধা বাংলার কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের প্রতিবিম্ব। ছাত্রসমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে ফুলপ্যান্ট পরা রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে তুলে ধরতে নির্মিত হয়েছে একজন শাড়ি পরিহিতা নারী মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর, যার কাঁধে ঝোলানো একটি চিকিৎসাসামগ্রী বহনের ব্যাগ বা বাক্স। ১৯৭৩ সালে এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৭৫ সালে তা বন্ধ থাকে। ১৯৭৯ সালের বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) উদ্বোধন করা হয় ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামের ভাস্কর্য। ৬ ফুট বেদির ওপর ১২ ফুট উচ্চতা, ৮ ফুট প্রস্থ ও ৬ ফুট ব্যাসবিশিষ্ট ‘অপরাজেয় বাংলা’ দেশের অহংকারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোপার্জিত স্বাধীনতা’ নামের ভাস্কর্য গড়েছেন ভাস্কর শামীম শিকদার। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কদ্বীপে অবস্থিত। পুরো ভাস্কর্যের পরতে পরতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের খন্ড খন্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আন্দোলন, সংগ্রাম, নারী নির্যাতন, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ এবং বিজয় উল্লাসের মতো তাৎপর্যময় মুহূর্তগুলোর স্মরণে ভাস্কর্যের বেদিতে কোলাজ আকারে অবয়ব নির্মিত হয়েছে। আর বেদির ওপরে রয়েছে অস্ত্র হাতে একদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, যাদের একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, পরবর্তী শাসকদের ‘নব্য স্বৈরাচার’ উপাধি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে সরকারবিরোধী দলগুলো।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে একদল সন্ত্রাসী। এতে মিছিলে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজ নিহত হন। এই ঘটনা স্মরণে এবং সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী সবার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘রাজু ভাস্কর্য’ নির্মিত হয়। ভাস্কর শ্যামল দত্ত তাঁর সহযোগী গোপাল পালকে সঙ্গে নিয়ে বৃত্তাকারে হাতে হাত ঠেকিয়ে প্রতিবাদরত সাত ছাত্র এবং এক ছাত্রীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দীজীবনের একটা অংশ কেটেছে ঢাকা সেনানিবাসে। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মিথ্যা অপবাদে তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের বেশ কিছুদিন বন্দী করে রাখা হয় ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনে। এই ভবনেই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-বিজড়িত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা স্মৃতি জাদুঘর নির্মিত হয়। এই জাদুঘরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর, ম্যুরাল এবং ‘বিজয় কেতন’ নামের একটি ভাস্কর্য। প্রখ্যাত স্থপতি ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান ২০০১ সালে জাদুঘরের সামনে সাত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব তুলে ধরেন। এদের একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা, যার হাতে রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও অহংকারের প্রতীক ‘বিজয় কেতন’ বা বিজয়ের  পতাকা।

 

ওমেন্স রাইটস পাইওনিয়ার্স মনুমেন্ট [আমেরিকা]

আমেরিকার তিন সংগ্রামী নারী সুজরনার ট্রুথ, সুশান বি অ্যান্থনি এবং এলিজাবেথ কেডি স্টেনটন। এদের মধ্যে ট্রুথ ছিলেন জন্মগতভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। ১৮২৬ সালে তিনি তার পরবর্তী প্রজন্মকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে নিজ কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যান এবং আদালতের মাধ্যমে তার শ্বেতাঙ্গ প্রভুর বন্দীদশা থেকে নিজের ছেলেকেও মুক্ত করেন। পরবর্তীতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবন উৎসর্গ করেন। সুশান ছিলেন আমেরিকার একজন সমাজ সংস্কারক, নারীবাদী নেত্রী ও ক্রীতদাস প্রথাবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির নেত্রী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আবেদন সংগ্রহ করেন। নারীর ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও তার অবদান চিরস্মরণীয়। সুশানেরই সহযোদ্ধা এবং আজীবন সঙ্গী ছিলেন এলিজাবেথ, ১৮৪৮ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান তুলে ধরা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় আন্দোলন গড়ে তোলেন এলিজাবেথ। নারীর অবস্থান উন্নতির জন্য আমেরিকার প্রথম ঘোষণাপত্র বা কনভেনশন তৈরি হয় তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার কল্যাণে। এই তিন নারীনেত্রীর অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে আমেরিকার নিউইয়র্কে ম্যানহাটনে অবস্থিত সেন্ট্রাল পার্কে স্থাপিত হয় ‘ওমেন্স রাইটস পাইওনিয়ার মনুমেন্ট।

ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পার্কটি আজ থেকে প্রায় ১৭৩ বছর আগে স্থাপিত হয়েছিল। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই পার্কে কোনো নারীর ভাস্কর্য ছিল না। এ বছরই পার্কে নারীর প্রতি সম্মানার্থে ভাস্কর্য তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, ফাউন্ডেশন ও দফতর থেকে প্রায় ৫ লাখ ডলার সংগ্রহ করা হয় এই সময়ে। গার্লস গাইডের সদস্যরা তাদের নিজ হাতে তৈরি বিস্কুট বিক্রি করেও তহবিল সংগ্রহ করেন। সর্বস্তরের নারী জনপ্রতিনিধি, তাদের নিজ নিজ দফতরের সহযোগিতার হাত বাড়ান এই ভাস্কর্য নির্মাণে।

পাঁচ বছর ধরে তহবিল সংগ্রহের পর ২০১৮ সালে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। এতে সাড়া দেন ৯১ জন ভাস্কর। এদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত বিচারে নির্বাচিত হন আমেরিকার নারী ভাস্কর মেরিডিথ বাগম্যান। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর দি নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক ডিজাইন কমিশন মেরিডিথের পরিকল্পিত ভাস্কর্য অনুমতি দেয়। এরপর শুরু হয় মূল ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। যে কোনো আন্দোলন এগিয়ে নিতে একদিকে কথা বলতে হয় এবং আন্দোলনে ডাক দিতে হয় আর অন্যদিকে ডাকে বা আন্দোলনে সাড়া দেওয়াদের সংগঠিত করতে হয়। পাশাপাশি আন্দোলনকে সার্থক রূপ দিতে লেখালেখির গুরুত্বও রয়েছে। তাই ভাস্কর মেরিডিথ তিন অসামান্য নারীর ভাস্কর্যে দেখিয়েছেন প্রথম জন ট্রুথ কথা বলছেন, সুশান সংগঠিত করছেন এবং এলিজাবেথ লিখছেন। নির্মাণের অনুমতি পেয়ে প্রথমে তিনি ৯ ফুট লম্বা কাদার ভাস্কর্য বা অবয়ব তৈরি করেন। এরপর কাদার ভাস্কর্যের ওপর ঢেলে দেন গলন্ত ব্রোঞ্জ। সব শেষে চলে নিখুঁত চেহারা ফুটিয়ে তোলার কাজ। নির্ধারিত ১০ মাসেই তিনি এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শেষ করেন। ১৯১৯ সালের ২৬ আগস্ট আমেরিকায় সর্বত্র নারীদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই প্রতি বছর ২৬ আগস্ট আমেরিকায় ‘নারীর সমঅধিকার দিবস বা ওমেন্স ইকুয়েলিটি ডে পালিত হয়। নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর, উদযাপনের দিনে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট উদ্বোধন করা হয় আমেরিকাজুড়ে নারীর গৌরবের প্রতীক ওমেন্স রাইটস  পাইওনিয়ার্স মনুমেন্ট।

 

ভার্জিনিয়া ওমেন্স মনুমেন্ট [আমেরিকা]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি, ম্যাসাচুসেটস, পেনসিলভেনিয়া এবং ভার্জিনিয়া- এ চারটি রাজ্যকে একসঙ্গে কমনওয়েলথ (Commonwealth) নামে অভিহিত করে আমেরিকানরা। এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন সেখানকার নারীরা। তাদেরই স্মরণে আমেরিকার ভার্জিনিয়া রাজ্যের রিচমন্ড শহরে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। সৌধটির পূর্ণ নাম ‘ভয়েসেস ফ্রম দ্য গার্ডেন : দ্য ভার্জিনিয়া ওমেন্স মনুমেন্ট’। তবে সংক্ষেপে ভার্জিনিয়া ওমেন্স মনুমেন্ট নামেই অধিক পরিচিত এই স্মৃতিসৌধ।

২০০৯ সালে এমন একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে ভার্জিনিয়া রাজ্যের সংসদ ভার্জিনিয়া জেনারেল অ্যাসেম্বলি ২০১০ সালে একটি বিল বা রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে, এই স্মৃতিসৌধে ‘কমনওয়েলথ’ নামে পরিচিত আমেরিকার চারটি রাজ্যের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখা নারীদের ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠিত হয় ভাস্কর্য বানানোর মতো উপযুক্ত সম্মান প্রাপ্য, অনুকরণীয় ও মহীয়সী নারী নির্বাচনের জন্য। কমিশনকে সহায়তা করে ‘লাইব্রেরি অব ভার্জিনিয়া’ এবং প্রফেসরস অব ওমেন্স হিস্ট্রি’ নামের সংগঠন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য বহু নারীর মধ্য থেকে নির্বাচন করা হয় ১২ জন নারীকে, যাদের ভাস্কর্য নির্মিত হওয়ার যোগ্য। পর্যায়ক্রমে এই স্মৃতিসৌধে এই ১২ জনের ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলে ভার্জিনিয়ার জনগণ। এই ১২ জনের মধ্যে রয়েছেন আদিবাসী নারীনেত্রী এনে ব্রুস লিয়ন, পামুনকি, উপজাতীয় নেত্রী কোকা কোয়েসকি’, সীমান্তবর্তী আদিবাসী নারীনেত্রী মেরি ড্রেপার, ইং গ্লেস, ফ্যাশন ডিজাইনার ও লেখিকা এলিজাবেথ কেকলি, ব্যবসায়ী নেত্রী লড়াই কোপেন হেভার, শিক্ষাবিদ ভার্জিনিয়া ই রেল্ডফ, শিল্পী অ্যাডেলস ক্লার্ক প্রমুখ। এসব মহীয়সী নারীর ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য বেছে নেওয়া হয় ভাস্কর নির্মাণের কাজে পারদর্শী আমেরিকার ব্রুকলিনে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডিও ই আইএস’কে। এ প্রতিষ্ঠান একে একে ৪টি অঙ্গরাজ্য থেকে বাছাই করা এসব নারীর ভাস্কর্য নির্মাণ করে। স্মৃতিসৌধের মাঝখানে রয়েছে গ্রানাইড পাথর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি বেইজ। এই বেইজে খোদাই করা হয়েছে ভার্জিনিয়া রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার নাম। স্থাপিত ভাস্কর্যের দুই পাশে রয়েছে সুদৃশ্য দুটি বেঞ্চ। বেঞ্চের পেছনে সহজে ভাঙবে না এমন টেম্পার করা গ্লাস বা কাচে লেখা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা দুই শতাধিক নারীর নাম, এই কাচের দেয়ালকে  বলা হয় ‘দ্য-ওয়াল অব অনার’।

 

আরও কিছু স্মৃতিসৌধ

১৮৯১ সালের কথা, তখনো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের নারীদের ভোটের অধিকার ছিল না। তাই মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ভোটের অধিকার দাবি করে ৩০ হাজার নারী একত্রে আবেদনপত্র জমা দিলেন। প্রায় ২০ বছর আন্দোলনের পর কর্তৃপক্ষ নারীদের ভোটের অধিকার দিতে বাধ্য হয়। তবে এই অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়াকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সেই আবেদনপত্রগুলো আঠা দিয়ে কাপড়ের সঙ্গে সংযুক্ত ও সংরক্ষণ করা হয়। এই কাপড়ের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২৬০ মিটার, যা মেলবোর্নের পাবলিক রেকর্ড অফিসে সংরক্ষিত আছে। অন্যদিকে এই আন্দোলন স্মরণে ‘দি গ্রেট পিটিশন’ নামে ২১০ মিটার প্রস্থের একটি বিশেষ আকৃতির ভাস্কর্য গড়া হয় মেলবোর্নের পার্লামেন্ট ভবনের কাছেই। ভাস্কর সুশান হিউইট ও পেনিলোপ লি-ইরের পরিকল্পনায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে ব্রিক নক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানকার নারীদের ভোটাধিকারে আন্দোলনের শত বছরপূর্তিতে ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘দি গ্রেট পিটিশন’ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়।

বর্তমানে গ্রিসের একটি পার্বত্য এলাকার নাম জালাংগো। ১৮০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যরা জালাংগো এলাকা দখল করে নেয়। এক পর্যায়ে একটি পার্বত্য গ্রামের প্রায় ৬০ জন নারী ও শিশু অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা উপলব্ধি করে পরবর্তীতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্যাতন ও দাসত্বের শৃঙ্খল। তাই তারা এভাবে নিজের সমর্পণের পরিবর্তে মৃত্যুকে বেছে নেয়। পরিকল্পনা মতো নারীরা শিশুদের নিয়ে খাড়া পাহাড়ে চূড়ায় উঠে যান এবং পাহাড়ি গান ও নৃত্য করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা একে একে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৭০০ মিটার উঁচু থেকে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। এই করুণ উপাখ্যানটি ইতিহাসের পাতায় ‘দি ড্যান্স অব জালাংগো’ নামে পরিচিত। এই নামে অনেক গান, নাটক ও ডকুমেন্টরিও নির্মিত হয় পরবর্তীকালে। ১৯৬১ সালে এই ঘটনাস্থলে ভাস্কর জর্জ জঙ্গো লোপুলত্তস নির্মাণ করেন ১৮ মিটার প্রস্থ এবং ১৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট একটি ভাস্কর, যা ‘মনুমেন্ট অব জালাংগো’ নামে প্রসিদ্ধ। এই ভাস্কর্যে স্থান পেয়েছে ছয় নারীর পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার প্রতিবিম্ব, যা চরম সংকটকালেও নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রেরণা দেয়।

১৯২৭-২৮ সালে কানাডার সুপ্রিম কোর্টের সিনেটর পদের জন্য নারীরা যোগ্য কিনা, এই প্রশ্নের ওপর নির্ভর করছিল ‘পারসন’ শব্দটির ব্যাখ্যার ওপর। একটি ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইনে ‘পারসন’ বলতে কেবল পুরুষদের বোঝায়, এমন আইনি ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুধু করেন কানাডার পাঁচজন নারী নেত্রী, সমাজকর্মী, বিচারক, কৃষক নেত্রী ও সমান অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের নেত্রী। এরা হলেন যথাক্রমে হেনরিত্তা মই এডওয়ার্ডস, নেলি ম্যাক ক্লাং, লুইস ম্যাক কিন্নি, এমিলি মারফে এবং ইরিনি পার্লবাই। এই পাঁচ সংগ্রামী নারীর সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ‘পারসন’ শব্দের ব্যাখ্যায় নারী-পুরুষ উভয়ের যোগ্যতাকে স্বীকার করে নেয় কানাডার উচ্চ আদালত। তাই পাঁচ নারীর সম্মানে তাদেরই অবয়বে কানাডার ক্যালগেরিতে ব্রোঞ্জ নির্মিত ‘দি ফেমাস ফাইভ’ স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠে মহিলা ভাস্কর  বারাবারা পিটারসনের হাতের ছোঁয়ায়।

সর্বশেষ খবর