বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীর বিশেষ আয়োজন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীর বিশেষ আয়োজন

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর দেখা হয়েছিল। তখন ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয়কে দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।’ এই উপমহাদেশের বাঙালি মনীষীদের নিয়ে পরিচালিত বিবিসির এক জরিপে সবাইকে ছাড়িয়ে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তাঁর সংগ্রামী জীবন চিরঅম্লান।  তাঁর গৌরবময় জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন- তানভীর আহমেদ

 

বঙ্গবন্ধু উপাধির পেছনের গল্প

সংগ্রাম-আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে দমাতে বারবার কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা করা হয়। তেমনই এক মামলা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ আনে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং গুটিকয় সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। ৩৫ জন আসামির সবাইকে পাকিস্তানি সরকার গ্রেফতার করে। মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে সাজা দেওয়ার পরিকল্পনা টের পেয়ে বাঙালি জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্রজনতার মিছিলে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। গণআন্দোলনে নতিস্বীকার করে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সব আসামিকে মুক্তি প্রদানের ঘোষণা দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর ভিপি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।  বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’  উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিরল সম্মাননা

৮ জানুয়ারি ১৯৭২, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন।’ বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়। ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন, ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জানতে পেরে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি বঙ্গবন্ধু যে হোটেলে ওঠেন (ক্যারিজেস হোটেল) তা ঘিরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে তিনি তাঁর বাসভবনে ছুটে আসেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে দেখা করতে গেলে  প্রধানমন্ত্রী নিজে বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ নিয়ে পরবর্তীতে ব্রিটেনে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কোনো পদে অধিষ্ঠিত হননি। লন্ডনে একদিন ব্যস্ত সময় কাটানোর পর ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন  ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে।

 

সংগ্রামে সংগ্রামে কারাগারে

বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবন কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামে। ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা-সংগ্রামে বারবার কারাবন্দী হয়েছেন তিনি। ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন, বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তাঁর জেলে কাটে পাকিস্তান আমলে। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম কারাগারে যান। ওই সময় তিনি সাত দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর কারাগারে গিয়ে তিনি মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন থেকে মুক্তি পান ওই বছরের ২৮ জুন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি আবারও ২৭ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন তিনি কারাভোগ করেন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি টানা ৭৮৭ দিন বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়েছিল বলে জানান তোফায়েল আহমেদ। এ দফায় বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারাভোগ করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হন। এ সময়ে একটানা এক হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু একটানা সবচেয়ে বেশি সময় (৩ বছরের বেশি) কারাভোগ করেন। ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আবারও গ্রেফতার হয়ে ওই বছরের ১৮ জুন মুক্তি পান। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত ৬ দফা দেওয়ার পর এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করতে গিয়ে কয়েক দফায় বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন।

৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্র“য়ারি মুক্তি পান শেখ মুজিব। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। কারামুক্তির পর ছাত্র-গণসংবর্ধনায় তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তাঁকে পাকিস্তানের মিয়ানালি কারাগারে একটি সেলের মধ্যে রাখা হয়।  এ দফায় তিনি ছিলেন ২৮৮ দিন।

 

বিশ্ব মিডিয়ায়বঙ্গবন্ধু

ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব মিডিয়ার নজর কেড়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাঁকে তুলে ধরা হয়েছে ‘মহান নেতা’ ও ‘অসামান্য ব্যক্তিত্ব’ শিরোনামে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘটনার পর নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ আখ্যায়িত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ১৯৭৫ সালে তাঁকে নিয়ে লিখে- বঙ্গবন্ধু না থাকলে কখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিরোনাম করে- ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেইল টু পাওয়ার’। দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয়- ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় লেখা হয়- ‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি  এ দাবি করতে পারেন, আমি-ই রাষ্ট্র।’

সর্বশেষ খবর