সোমবার, ১৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

গুজবের কারখানা

তানভীর আহমেদ

গুজবের কারখানা

হিটলার গুজবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। গুজবের কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আজকাল ভুল তথ্য, সত্য-মিথ্যার মিশেল, অসম্পূর্ণ ও বানোয়াট খবর শেয়ার করেন অনেকেই। অনলাইন ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন গুজব ছড়ায় বাতাসের গতিতে। কিছু নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালও ভুয়া খবর পরিবেশন করে।  যে কোনো খবর, তথ্য পরিবেশনা, প্রচার ও শেয়ার করার আগে তা যাচাই করে নেওয়া উচিত। বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে গুজব থেকে বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে।

 

করোনা নিয়ে গুজবের শেষ নেই

বিশ্বসেরা চিকিৎসকদের নামে ভুয়া ব্যবস্থাপনাপত্র : বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ চিকিৎসকদের নাম, পদবি ব্যবহার করে অনলাইনে ভুয়া চিকিৎসাপত্র পাওয়া যায়। করোনা রোগীর চিকিৎসাপত্র হিসেবে এগুলো প্রচার করেছেন অনেকেই। এ ধরনের উন্মুক্ত কোনো চিকিৎসাপত্র ডাক্তাররা প্রদান করেন না। করোনার ভয়াবহতায় আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই এসব ভুয়া চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী ওষুধ কিনে রাখার খবর ফলাও করে প্রচার করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। প্রকৃতপক্ষে কোনো কভিড-১৯ রোগী (মৃদু, মাঝারি ও সংকটময়) কী চিকিৎসা পাবে তা নির্ধারিত হয় রোগীর অবস্থা বুঝে এবং তা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা গাইডলাইন ও ব্যক্তিগত দক্ষতা দ্বারা নির্ধারণ করেন।

শরীরে গোবর দিয়ে করোনা চিকিৎসা কার্যকর নয় : পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের অনেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে কিংবা করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হতে সাহায্য করবে এই বিশ্বাসে সপ্তাহে এক দিন করে বিভিন্ন ‘গো আশ্রমে’ হাজির হয়ে নিচ্ছেন ‘গোবর চিকিৎসা’। তবে সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ড. জে এ জয়লাল বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলায় রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে গরুর মলমূত্র কার্যকর, এর সপক্ষে দৃঢ় কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটা পুরোপুরি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে চলছে। এগুলোর ঘ্রাণ নেওয়া বা ব্যবহারে প্রাণী থেকে মানুষে অন্য রোগ ছড়িয়ে পড়াসহ নানান স্বাস্থ্যঝুঁকিও আছে।’

অনলাইনে কভিড-১৯ সারাতে অ্যালকোহল কার্যকর নয় : বিবিসির একটি খবরে জানা যায়, অনলাইনে কভিড-১৯ সারাতে অ্যালকোহল কার্যকর- এমন গুজব ছড়ানোর পর ইরানে মদ্যপানজনিত বিষক্রিয়ায় শত শত লোক মারা গেছে। এপ্রিল মাসের শেষে ইরানের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাস সারাতে মদ খেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৯৬। তিনি আরও বলেন, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া খবরই এর কারণ।

মশা থেকে করোনা ছড়ায় না : চিকিৎসকরা বলছেন ডেঙ্গুর মতো করোনা মশার কামড়ে ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। একই কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। এ নিয়ে গবেষণা চলছিল বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস প্রদেশের ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে দাবি করেছে তা আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করতে তথ্য জোগাড় করছি। গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির দেহ থেকে যে মুহূর্তে মশা রক্ত নিজের শরীরে শোষণ করে সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মশার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানো সম্ভব নয়।

ফাইজারের টিকা হালাল : করোনা টিকা নিয়ে বন্ধ্যত্ব ও পশুর চর্বি ব্যবহার নিয়ে অনেক ধরনের ভুল তথ্য, গুজব প্রচারিত হয়েছে। অথচ এ ধরনের সব তথ্যই ভুল। ব্রিটেনে প্রয়োগ শুরু হওয়া ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন হালাল বলে জানিয়েছে দেশটির চিকিৎসকদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন ও একদল ইসলামী বিশেষজ্ঞ। দ্য ব্রিটিশ ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিমা) এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রকাশিত সব তথ্য যাচাই করে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে ভ্যাকসিন উৎপাদনে কোনো পশু পণ্য বা পশু থেকে সংগৃহীত কোনো কোষ ব্যবহার করা হয়নি।

গুজব ছিলপৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে!’

২০১৬ সালের ঘটনা। বিশ্বজুড়ে চাউর হলো, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে প্লানেট এক্স ও প্লানেট নাইন। খবরে বলা হচ্ছিল, এই গ্রহ দুটোর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ হতে যাচ্ছে। গ্রহগুলোর সংঘর্ষ হলে, নিশ্চিতভাবেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মারা যাবে পৃথিবীর সব মানুষ ও প্রাণীকুল। খবরটি কোথা থেকে পেলেন? বলা হলো, নাসা সতর্কতা জারি করেছে। পুরো খবরটি যে ভুল ও ভুয়া সেটা নিশ্চয়ই পাঁচ বছর পর পৃথিবীবাসী জানেন। ২০১৬ সালে তেমন কিছুই ঘটেনি। তবে গুজবের চাপে দিশাহারা হয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। সে সময় মোবাইল মেসেজ, অনলাইনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে নানা খবর পাওয়া যেত। সবারই আশঙ্কা, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! নাসার বরাত দিয়ে প্রায়ই এমন ভুয়া খবর প্রকাশ করে কিছু অপ্রতিষ্ঠিত মিডিয়া, অনলাইন পত্রিকা, ম্যাগাজিন কিংবা ইউটিউব ভিডিও। যার কোনোটিরই গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিছু মানুষ পুরো খবরটি না জেনেই স্রেফ কৌতূহল ও অজ্ঞানতাবশত এসব শেয়ার করেন।

 

একজন গুজব মন্ত্রী

মিথ্যাকে সত্যের মতো গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করা, গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কলাকৌশল দেখিয়েছেন জোসেফ গোয়েবলস। গুজব ছড়ানো ও বিভ্রান্ত খবর পরিবেশনার কথা উঠলে তার নাম উচ্চারিত হবেই। হিটলারের সময় তিনি ছিলেন নাৎসিদের প্রপাগান্ডামন্ত্রী ও প্রচারণা বিশেষজ্ঞ। মিথ্যাকে এমনভাবে প্রচার করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গোয়েবলস নাৎসিবাদ ও হিটলারকে জার্মানিতে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি দ্য লিটর ডক্টর নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে গোয়েবলস ডিক্টেশন দিয়ে একটি ডায়েরি লিখিয়েছিলেন। গোয়েবলস তার লেখনী, সভা-সমাবেশের পোস্টার, স্লোগান, বক্তৃতা, ছবি, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে ভুল তথ্য সংযোজন করে প্রচার করতেন।

আড়ালে গেলেই বিশ্বজুড়ে আলোচনা

উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং উন। গত বছর তিন সপ্তাহ ধরে জনসম্মুখে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। আর এতেই গুজব ছড়িয়েছিল, তিনি হয়তো মারা গেছেন। সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত হতে পারছিল না তার অবস্থান ও শারীরিক অবস্থা। যে কারণে কেউ কেউ প্রচার করে হয়তো হার্টের অপারেশনের জটিলতায় তিনি গুরুতর অসুস্থ কিংবা মারা গেছেন। যদিও খবরগুলোর সূত্র ও সত্যতার কেউ শতভাগ নিশ্চয়তা দেয়নি। কিম জং উনকে ঘিরে অনলাইনে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে গেলে তা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়।

 

যেসব গুজবে কেঁপেছিল বিশ্ব

রাজা অসুস্থ তাতেই তোলপাড়

সতেরশ শতকের মাঝামাঝিতে গ্রেট ব্রিটেনের রাজাকে নিয়ে ভুল খবর প্রকাশিত হয়। একটি পত্রিকায় রাজা জর্জ দ্বিতীয় অসুস্থ এমন খবর প্রকাশ হয়। খবরটি যাচাই-বাছাই না করে অন্য পত্রিকাগুলোও একই খবর প্রকাশ করে। দেশজুড়ে রাজার অসুস্থতা ও মৃত্যু আসন্ন এমন খবরে অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য তৈরি হয়। রাজা মারা যাচ্ছেন এই গুজবে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলার দিকে এগোচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল ডাডলি রাইডার এক বিবৃতির মাধ্যমে খবরটি ভুয়া ও গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করেন।

চাঁদে প্রাণ থাকার বর্ণনা!

১৮৩৫ সালের ২১ আগস্ট। দ্য নিউইয়র্ক সান একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ শুরু করে। সেখানে দাবি করা হয় চাঁদে প্রাণ আছে। এই ফিচারটি লিখতে গিয়ে একটি ভুল তথ্য সংযোজন করা হয়। বিখ্যাত নভোচারী স্যার জন হার্শেলের মন্তব্য হিসেবে সেখানে বলা হয়, চাঁদে প্রাণ থাকা বিষয়টি আবিষ্কৃত হয়েছে। কীভাবে নভোচারী চাঁদে প্রাণ খুঁজে পেয়েছেন সে বর্ণনাও ছাপা হয়। সঙ্গে ছিল পেইন্টিং। ৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথা বলা হয়। ছিল এল্ক, চিত্রা-হরিণ, শিংওয়ালা ভল্লুকসহ আরও প্রাণীর বর্ণনা। এ ছাড়া দুই পায়ে হাঁটতে পারে এমন প্রাণী যারা দেখতে মানুষের মতো-তাদের বিস্তারিত কথা ছাপা হয় ফিচারটিতে। এমন বিস্তারিত বর্ণনা পরে ‘ফেক মুন হোয়াক্স’ বা চাঁদে প্রাণ থাকার এই গুজবটি তখনই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের গতিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে এই গুজবটি ছড়িয়ে পড়লে পত্রিকাটি পরবর্তী সংখ্যায় এই খবরটি ভুল ও গুজব বলে স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

গুজবে বিশ্বযুদ্ধ!

১৯১৭ সালে ডেইলি মেইল ও টাইমসে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, তারা জার্মানির একটি ‘কাদাভের’ পরিদর্শন করেছেন। এটি এমন একটি কারখানা যেখানে নিহত সেনাদের দেহ গলিয়ে সাবান ও মাখনের মতো এক ধরনের খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। এমন গুজব ছড়িয়ে মূলত দেশগুলোর মধ্যে সংকট বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এ ধরনের বহু গুজব বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়ানোর হয়েছিল। এসব গুজবের সোর্স জানা না গেলেও সহিংসতা ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পেছনে এমন গুজবের সংখ্যা কম নয়।

টাকা চোর রেলযাত্রীর কান্ড

ফ্রান্সের এক রেলগাড়িতে অপহরণের পর টাকা চুরির গুজব ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় মারামারি ও হট্টগোল। ১৮৯০ সালের ডিসেম্বরে মন্টে কার্লো থেকে তোলুন যাচ্ছিলেন ম্যাডাম মার্কোয়েট। এই নারী ছিলেন আলজেরিয়ান ওষুধ ও মাদক ব্যবসায়ীর স্ত্রী। ট্রেনে হঠাৎ তিনি অভিযোগ করেন কেউ একজন তাকে অপহরণ করে, ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। তারপর তার কাছ থেকে ৭ হাজার ফ্রাঙ্ক চুরি করে পালিয়েছে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ট্রেনজুড়ে হইচই শুরু হয়। এদিকে এক ইতালিয়ান ভদ্রলোক হঠাৎ করে এক যাত্রীর ওপর ছুরি নিয়ে হামলে পড়েন এবং তাকে খুন করার হুমকি দেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার টাকা না দিলে এখুনি লাশ ফেলে দেব!’ লোকটি টাকা নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে চেইন টেনে ট্রেন থামানো হয়। ফলে তাকে পরে আটকাতে সক্ষম হয় রেলের লোকজন। মনে করা হচ্ছিল এই লোকটিই হয়তো ম্যাডাম মার্কোয়েটের টাকা চুরি করেছেন। এ ঘটনায় পূর্ণ তদন্ত চলে। টাকা চুরির গুজব প্রমাণিত হতে বেশ সময় লাগে। পরে জানা যায়, ম্যাডাম মার্কোয়েট ধারের টাকা আনতে মন্টে কার্লো গিয়েছিলেন। সে টাকা তিনি হাতেও পান। কিন্তু জুয়া ও মদের পেছনে সে টাকা খুইয়ে ফেলেন। স্বামীর কাছে বিষয়টি গোপন করতেই ট্রেনে টাকা চুরির গুজব ছড়িয়েছিলেন তিনি।

আইফেল টাওয়ারে আগুন

জঙ্গি সংগঠন আইএস ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারে আগুন দিয়েছে- এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। খবরটি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে খোদ ফ্রান্সের বাসিন্দারাই উদ্বিগ্ন হয়ে খবরটি শেয়ার করতে শুরু করেন। এই খবরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় একটি ছবি। যাতে দেখা যায় আইফেল টাওয়ারের কাছেই আগুনের লেলিহান শিখা। বাস্তবতা হচ্ছে, আইফেল টাওয়ার কাছেই দুর্ঘটনা থেকে আগুন লেগেছিল। যা দ্রুতই নিভিয়ে ফেলা হয়। তবে তার আগেই এমন ভুয়া ছবি জুড়ে দিয়ে ভুয়া খবরটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

 

ইন্দোনেশিয়ায় কাটা মাথার গুজব

অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ‘মানুষের কাটা মাথা’ সংগ্রহের গুজব দেশে দেশে রয়েছে। সবখানেই এ গুজবের গল্পটি একই রকম। এ ধরনের একটি গুজব শোনা যায়, ১৯৩৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায়। খবরের সোর্স হিসেবে বলা হয়, ‘স্থানীয় কিছু মানুষ, প্রকল্প কর্মচারী- এমন কেউ’- যদিও পুরোটাই মিথ্যা। গুজব ছড়ানো হয়, ইন্দোনেশিয়ার বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার সফলতা ও গতির জন্য মানুষের কাটা মাথার প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের একটি গোপন দল মানুষের কাটা মাথা সংগ্রহ করছে। কাটা মাথা কেন প্রয়োজন পড়ল, তার পেছনেও রয়েছে ভৌতিক গালগল্প। গুজব রটানো হয়, উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা অশরীরীর উপস্থিতি টের পান। পাওয়া যায় অ™ভুত শব্দ ও ডাক। লোহা-লক্কড় সরানো, ওয়েল্ডিং করা, ঢালাই দেওয়ার সময় এমন রহস্যময় ও ভৌতিক অভিজ্ঞতার গুজব ছড়ানো হয়। ১৯৭৯ এবং ১৯৮১ সালের দুটি উন্নয়ন প্রকল্পেও দেশটিতে এমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল।

লাখো মানুষ শেয়ার করে গুজবটি

সৌদি আরবের বিজ্ঞানীদের তথ্যসূত্র উল্লেখ করে ২০১৬ সালে অনলাইনে ভয়াবহ একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজবে বলা হয়, ‘সৌদি বিজ্ঞানীরা নারীকে স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।’ এ ধরনের অপমানসূচক খবরের কোনো সোর্স যাচাই না করেই অনলাইন ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষ শেয়ার করে ছড়িয়ে দেয়। প্রায় ৩ লাখ অনলাইন ব্যবহারকারী তখনই এই ভুয়া খবরটি শেয়ার করেন, মন্তব্য প্রকাশ করেন। কিছু ভুয়া সংবাদমাধ্যমেও খবরটি দেখতে পাওয়া যায়। ফেসবুকে লাখ লাখ বার শেয়ার হওয়া খবরটি যে পুরোটাই ভুয়া তা জানা যায় সেদিনই। তবে তার আগেই সৌদি শাসন ব্যবস্থা নিয়ে অনলাইনে মানুষের রোষানল ছড়িয়ে পড়ে। সে বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক আগের দিনই এ ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

অনলাইনে মৃত্যুর খবর অথচ মাঠে দিব্যি খেলছেন তিনি

ক্যারিবীয় তারকা পোলার্ডের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে এ বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার কাইরন পোলার্ড। অনলাইনে যখন তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে তখন তিনি মাঠে দিব্যি ক্রিকেট খেলছেন। হঠাৎ করেই কয়েকজন ইউটিউবার দাবি করতে থাকেন যে, ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে পোলার্ডের।

মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে খবরটি। কিন্তু আবুধাবিতে টি-টেন লিগে পোলার্ডের দল ডেকান গ্ল্যাডিয়েটর্স তখন পুনে ডেভিলসের বিপক্ষে ম্যাচ খেলছিল। পোলার্ড ছিলেন দলের নেতৃত্বে।

পোলার্ডের মৃত্যুর গুজব সংক্রান্ত মোট চারটি ভিডিও দেখা গেছে ইউটিউবে। ফেসবুকেও কয়েকটি ভিডিও পাওয়া যায়। টুইটারেও ছড়িয়ে পড়ে এই মারকুটে ব্যাটসম্যানের মৃত্যুর গুজব। তার মৃত্যুর ভুয়া খবর কিছু ভুয়া সংবাদমাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের খবর ও ভিডিও কয়েক লাখ বার শেয়ার করা হলে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়।

রসিকতা করে বললেন, ‘ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল

ভারতে করোনার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বহু তারকা। এমন পরিস্থিতির মাঝেই সম্প্রতি খ্যাতিমান অভিনেতা পরেশ রাওয়ালের মৃত্যুর গুজব অনলাইন প্ল্যাটফরমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হুট করেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু ৬৫ বছরের এই অভিনেতা জানান, তিনি একেবারে সুস্থ আছেন। আর গুজবের উত্তর দিলেন অনেকটা রসিকতা করেই। শুক্রবার (১৪ মে) সকালে একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে রসিকতা করে পরেশ রাওয়াল ফেসবুকে লেখেন, ‘৭টা বেজে যাওয়ার পরও ঘুমচ্ছিলাম, ভুল বোঝাবুঝির জন্য অত্যন্ত দুঃখিত।’ জনপ্রিয় অভিনেতা ও সংসদ সদস্য পরেশ রাওয়াল দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় দেড় শ সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

তিনি জনপ্রিয় কমেডি চরিত্রের জন্য। সম্প্রতি ‘শক্তিমান’খ্যাত অভিনেতা মুকেশ খান্নার মৃত্যুর গুজব রটেছিল।

তাঁর মৃত্যুর ভুয়া খবরে নাজেহাল বিশ্ব

মিস্টার বিন চরিত্রটির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন ব্রিটিশ অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসন। তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। এ কারণেই তাঁকে ঘিরে যে কোনো সংবাদে আগ্রহ মানুষের। মিস্টার বিন মারা গেছেন- এমন ভুয়া খবর যতবার অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে প্রতিবারই তা ভাইরাল হয়ে গেছে। মুহূর্তে তাঁর লাখ লাখ অনুসারী এ ধরনের ভুয়া খবর যাচাই না করেই শেয়ার করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদের মতো ভুয়া খবর সামলাতে হিমশিম খেতে হয় অনলাইনের প্রধান সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। বেশ কয়েকবার তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছে। ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যুর ভুয়া খবর পড়ার পর বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো পাঠকের চাপ সামলে উঠতে পারছিল না। একসঙ্গে কোটি কোটি অনুরাগী গুগল সার্চ ইঞ্জিনে খবরটি খুঁজতে শুরু করেন যে, সেটি যাচাই-বাছাইয়ের আগেই বহু সংবাদমাধ্যম ভুয়া খবরটি প্রকাশ করে। ২০১৮ সালেও তাঁর মৃত্যুর গুজব ভাইরাল হয়ে যায়। গুজবটি দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পরদিনই জানা যায়, মৃত্যুর খবর ভুল। কেউ বা কারা যেন নেট-দুনিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবেই ছড়িয়েছে তার মৃত্যু সংবাদ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘মিরর’-এর প্রতিবেদনে প্রকাশ, গুজব এই মর্মে রটে যে, রোয়ান অ্যাটকিনসন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রয়াত। সোশ্যাল মিডিয়া ফেক নিউজটি পরিবেশিত হয় ‘ফক্স ব্রেকিং নিউজ’ নামের কোনো নকল সংবাদ সংস্থার নাম দিয়ে। বহু মানুষ তাদের প্রিয় কমেডিয়ান রোয়ানের প্রয়াণ-সংবাদ শোনার পর  শোকবার্তা পোস্ট করতে শুরু করেন। অনেকেই এই লিঙ্কটি ক্লিক করতে গিয়ে বোকা বনে যান। তেমন কোনো খবরের অস্তিত্ব তারা খুঁজে পাননি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর