বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
জন্মশতবার্ষিকীর শুভেচ্ছা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির স্বপ্নস্মারক

ড. আতিউর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির স্বপ্নস্মারক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার সত্তার সমান। আমার স্বপ্ন জাগানোর উৎসভূমি। আমি এখান থেকেই আমার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির সন্ধান পেয়েছি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে নানা ধরনের নেতৃত্ব বিকাশের কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে জীবনকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর সুযোগ আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকেই খুঁজে পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবেও নানা কাজে যুক্ত থেকে আমার প্রাণের টানের অনেক কিছুই করতে পেরেছি। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মেধাবী তরুণ-তরুণীর সঙ্গে মেশার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছি। সেই অর্থে আমাদের মতো অনেকের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয় এক সামাজিক সংশ্লেষের আধার। ইংরেজিতে বলা যায়, ‘মেল্টিং পট’। আর সে কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে পেরেছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের অসামান্য এক বিকাশ কেন্দ্র।

পৃথিবীর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির স্বপ্ন নির্মাণে এমন ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের জাতীয়তাবাদের আর্থ-সামাজিক যে ভিত্তি তার শিকড় একই সঙ্গে গ্রাম-বাংলা ও নগরে প্রোথিত। পূর্ব-বাংলার মানুষের স্বতন্ত্র আত্ম-আবিষ্কারে ভাষা আন্দোলন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর এই আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আজও তাই একুশে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় অনুষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। এই আন্দোলনের সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করা হয়েছিল তাই পরবর্তী সময়ে পল্লবিত হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টির ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত রূপ পায়। শুরু থেকে এই জাতি বিনির্মাণের নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি অন্যদের সঙ্গে সেই ১৯৪৮ সালের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। তারও আগে থেকে তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে প্রথম পা রেখেছিলাম ১৯৭০ সালের শেষ দিকে। তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্র-শিক্ষক সবাই আশাবাদী ছিলেন, এবার বাঙালি গণতান্ত্রিক অধিকারের বলেই তার ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ পাবে। বঙ্গবন্ধু তদ্দিনে একক নেতা। ডিসেম্বরের নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেছেন। নৌকার পক্ষে জোয়ার তোলার জন্য তাদের অবদান ছিল অনন্য। আমি গ্রামের ছেলে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের মানুষ জড়ো হতেন রাজনীতির আলাপ করতে। খুব কম মানুষই ছিলেন আওয়ামী লীগের বাইরে। নির্বাচনের ফলাফল প্রায় জানাই ছিল। তাই অবাক হইনি। কিন্তু শঙ্কাও ছিল। এত ভালো কি সহ্য হবে পাকিস্তানি এলিটদের? নির্বাচনের পরপরই একাত্তরের প্রথম দিকে ক্লাস শুরু হলো। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের একই আলাপ। পাকিস্তানিরা কি এত সহজে বাঙালির হাতে ক্ষমতা ছাড়বে? ছয় দফার প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়- এই বার্তা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত প্রাদেশিক ও জাতীয় সংসদের সব সদস্যকে নিয়ে জানুয়ারির প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু শপথ নিলেন।

এর পরপরই ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে নির্বাচনের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর এলেন ভুট্টো। তখন বোঝা যাচ্ছিল তারা ঘোঁট পাকাচ্ছিল। তবু ধৈর্য ধরে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে খসড়া সংবিধান প্রস্তুতির কাজ করে যাচ্ছিলেন। আমাদের শিক্ষক-অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, খান সারওয়ার মুর্শিদসহ আরও অনেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফাভিত্তিক খসড়া সংবিধান প্রস্তুতে অংশ নিচ্ছিলেন। হঠাৎ ১ মার্চ প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশন স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। মিছিল করে পূর্বাণী হোটেল পর্যন্ত গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার সাহস জোগালেন। এরপর শুরু হলো ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই রমনা রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। সেদিন বঙ্গবন্ধু দিলেন গেরিলা যুদ্ধের ডাক। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব। অসহযোগের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাংলাদেশের অঘোষিত দন্ডমুন্ডের কর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (এখন জহুরুল হক হল) ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মূল ঘাঁটি। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো গণহত্যা। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। একবার পঁচিশে মার্চ, আরেকবার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বক্ষণে আমাদের বরেণ্য শিক্ষকের অনেককে হত্যা করা হয়। অনেক শিক্ষক আটকও ছিলেন। আর রণাঙ্গনে প্রাণ দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র। কত ছাত্রীকে হতে হয়েছে বীরাঙ্গনা। তাদের সবার এই আত্মত্যাগ এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

বাহাত্তরে স্বাধীন দেশের নয়া পরিবেশে শুরু হলো পাঠদান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈরি কূটনীতি, খাদ্য ঘাটতি, ষড়যন্ত্র, প্রতিবাদ সব মিলিয়ে এক চ্যালেঞ্জিং সময়। এমন সময়েও নতুন দেশ গড়ার কত আয়োজন। সদ্য স্বাধীন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বইছিল প্রাণের জোয়ার। সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি এসেছিলেন ক্যাম্পাসে। নতুন করে বটের চারা লাগালেন কলাভবনের সামনে। সন্ধ্যায় বসত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একবার কলকাতা থেকে সুচিত্রা মিত্রসহ আরও অনেকে এসেছিলেন ক্যাম্পাসে গান গাইতে। আমাদের ছাত্রছাত্রীও গাইতেন প্রাণের টানে। আমরা নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। সম্মিলিত কণ্ঠে গানও করেছি। আর বিতর্ক অনুষ্ঠান তো প্রায়ই হতো। আমি অনেক অনুষ্ঠানেই অংশ নিতাম। শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই শক্তিশালী ছিল। এখনো অনেকটাই আছে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের কথা। আমরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। আগের দিন সন্ধ্যায় টিএসসিতে এক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলাম। হলে ফিরে ঘুমাতে গেলাম। আর ভোর রাতে ঘুম ভাঙল ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত খবর পেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবাই হতভম্ব। সারা দেশ হতচকিত। জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবার নৃশংসতার শিকার। ক্যাম্পাসের কোনো কোনো অংশে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। কিন্তু দারুণ এক শঙ্কার পরিবেশ বিরাজ করছিল সর্বত্র।

যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতা হিসেবে তাঁর শুভাগমন প্রত্যক্ষ করতে পারল না। আগেই বলেছি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশের উৎসভূমির নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচন- প্রতিটি পর্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান একেবারে কেন্দ্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার সবচেয়ে সুখস্মৃতি বাংলা ১৩৮০ সালের সাহিত্য প্রতিযোগিতা। ডাকসু আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পেয়েছিলাম স্বর্ণপদক। শিক্ষক হিসেবে আমার সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়টি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন সত্যি সত্যি আমাদের বিভাগের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্সটি শুরু হলো তখন প্রথমবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের দেখে প্রাণ ভরে গেল। প্রথম ব্যাচের অনেকেই এখন আমার সহকর্মী। অনেকে সফল উদ্যোক্তা। তাদের সাফল্য মনে হয় আমারই সাফল্য।

এর পর হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে চলে গেলাম। তবে আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তাই সাত বছর পরে যখন ফিরে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে মনে ছিল না কোনো দুঃখ বা কোনো ক্ষোভ। নিজের ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে পেরে আমি ছিলাম খুবই সন্তুষ্ট। আমার ছাত্রছাত্রীদের সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আমার সন্তুষ্টি আরও বেড়ে যায়। সেই সন্তুষ্টি নিয়েই আছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চলছে মুজিববর্ষ। এই সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর করায় আমি সত্যি খুবই কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করছি। লিখছি। বলছি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘ক্যারাস’ (কলা ও সমাজবিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র)-এর নির্বাহী কমিটির সভাপতি করেছেন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের শূন্যস্থান পূরণ কি আমার পক্ষে সম্ভব! তবু চেষ্টা করছি কেন্দ্রটির গবেষণা সক্ষমতা যতটা সম্ভব বাড়ানোর। তবে করোনা বাদ সেধেছে আমাদের চলার পথে।

সত্তরের শিক্ষা কার্যক্রম ছিল পুরনো ব্যবস্থায়। সেমিস্টার চালু হয়নি। নিয়মিত ক্লাস হতো। গ্রুপে গ্রুপে টিউটোরিয়াল হতো। প্রচুর বিতর্ক হতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ ঘটাত। আলাদা আলাদা ছাত্র রাজনীতি করত। অনেকেই আবার সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিল না। কিন্তু তাতে তাদের হলে সিট পেতে, কিংবা নির্ভয়ে ক্যাম্পাস জীবনযাপনে কোনো অসুবিধা হতো না। বিভিন্ন ছাত্র রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ভিন্ন মতপ্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হতে ততটা দেখিনি এবং তারা একসঙ্গে খেত, উঠবস করত। ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কোনো ব্যত্যয় ঘটত না। হলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভাগীয় পাঠ-বহির্ভূত কর্মকান্ডে একসঙ্গেই অংশগ্রহণ করত। ছাত্ররাজনীতির একই রকম ঐক্য দেখেছি আমরা নব্বইয়ের গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলনের সময়।

এখন অবশ্য পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। তবে পাঠদানের পদ্ধতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সময় মতো কোর্স শেষ হয়। এই করোনাকালে তা বেশ খানিকটা ব্যাহত হলেও এর আগ পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল পাঠদান কার্যক্রম। এ মুহুর্তে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। তবে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। এখন ক্লাসে পড়ানোর পাশাপাশি অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। তবে করোনাকালে অসচ্ছল ছেলেমেয়েদের আধুনিক ডিভাইস নেই। গ্রামে ইন্টারনেট কানেকশন দুর্বল। ডাটা কেনার পয়সাও নেই। তাই শিক্ষা কার্যক্রমে বৈষম্য দানা বাঁধছে। এই শিক্ষা ক্ষতি যে কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে তা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না।

এবার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বরাবরই খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। এখনো তাই আছে। আমার মনে আছে, অনার্স পাসের পর আমার দুই শিক্ষক, প্রফেসর এম এন হুদা এবং প্রফেসর মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনে পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি পেতে আমাকে খুবই সাহায্য করেছিলেন। তাঁরা ওই করপোরেশনের চেয়ারম্যান জনাব রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে মুখে বলেছিলেন। চিঠি লিখেছিলেন। চাকরি করতে করতেই আমি প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলাম। এখনো আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি সংগ্রহ, ইন্টার্নশিপ জোগাড় করে দেওয়াসহ নানা ধরনের সহযোগিতা দিয়ে থাকি।

তবে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত। যতই দিন যাচ্ছে ততই চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগ কমে আসছে। আমাদের সময়ে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানেই চাকরি পেয়ে যেত। বাদবাকিরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত। এখন সে তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে খুব বেশি সংখ্যায় চাকরি পায় না। তবে ব্যক্তি খাতে, বিশেষ করে করপোরেট, এনজিও, বিদেশি সংস্থায় বেশি করে এখন কাজ পায়। বাদবাকিরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে। অনেকেই বিদেশে চলে যায় পড়তে। তবে যে হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তাতে আমার ভয় হয়- পড়াশোনার কাক্সিক্ষত মান কী করে ধরে রাখা যাবে? ইতিমধ্যে শিক্ষা খাতে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে বলে মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার স্বপ্নের কথায় আসি। শুরুতে আমাদের স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন করব। স্বাধীনতা লাভের পর স্বপ্ন দেখতাম এমন এক বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থাকবে না। বঙ্গবন্ধু এক ভিন্নধর্মী সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। তিনি শহীদ হওয়ার পর ওই স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য কমলেও দুর্নীতি অনেকটাই বেড়ে গেছে। বেড়েছে বৈষম্য। তবে দেশের প্রবৃদ্ধি ও মানবসূচকে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এই করোনাকালেও আমাদের অর্থনীতির গতিধারা বেশ চনমনেই আছে বলা চলে। নিঃসন্দেহে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এখনো স্বপ্ন দেখি দেশের মানুষ সর্বত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিচার পাবেন। এখনো আশায় আছি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কতটা হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমি নিজে জীবনের বড় একটা সময় গবেষণায় যুক্ত ছিলাম। এখনো গবেষণা করছি। আমাদের প্রশাসন গবেষণাকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের গভীরভাবে গবেষণায় মগ্ন থাকা উচিত। সেই পরিবেশ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। এই খাতে সরকারি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। ব্যক্তি খাতকেও সামাজিক দায়িত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিত্তশালী অ্যালামনাইদের বড় ধরনের ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ব-র‌্যাংকিংয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। পরিকল্পনা ও সম্পদের অভাব যে আছে তা তো অস্বীকার করা যাবে না। তবে শিক্ষকরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এখনো অনেক ভালো ভালো গবেষণা করেন। প্রতি বছর কোন শিক্ষক কতটা গবেষণা করে ভালো মানের জার্নালে প্রবন্ধ ছেপেছেন, বই লিখেছেন সেসব খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলেই গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিংয়ে তার অবস্থান পাল্টে যাবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও একটু শক্ত হতে হবে। প্রকাশনার এই তালিকা ডিজিটালি জমা না করলে যে কোনো শিক্ষককে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে- এমন নীতি-উদ্যোগ নেওয়ার সময় যে বয়ে যাচ্ছে।

বড়ই সৌভাগ্য যে, আমাদের জীবদ্দশাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবর্ষ পালনের কর্মসূচি দেখে যেতে পারছি। আজই তার আনুষ্ঠানিক সূচনার দিন। তবে এই শতবর্ষ এমন এক সময় উদযাপিত হচ্ছে যখন সারা বিশ্বই এক মহাসংকটে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীও একই সংকটকালে উদযাপিত হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরও। মন খুলে এগুলোর উদযাপনে অংশগ্রহণ করতে না পেরে বেশ অস্বস্তির মধ্যেই আছি। তবুও অনলাইনে এ অনুষ্ঠানের চেষ্টা করে যেতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে খ্যাতিমান ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নামে স্মারক বক্তৃতার ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হয়। কিছু গবেষণার কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কয়েকটিতে আমিও অংশগ্রহণ করেছি। কিছু গবেষণাও করছি।

এত কিছুর পরও আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের বলব- তোমরা খুবই ভাগ্যবান। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমরা শিক্ষার্থী যার আছে শতবর্ষের এক উজ্জ্বল ইতিহাস। গর্ব করার মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সুন্দর ও সুদক্ষভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তোমাদের অবদান দেখার অপেক্ষায় রইলাম। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর অভাবনীয় অবদানের কথা মনে রেখে তোমরা গুণমানের শিক্ষা গ্রহণ কর এবং স্বদেশের কল্যাণে নিজেদের সমর্পণ কর- সেই প্রত্যাশাই করছি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

সর্বশেষ খবর