বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখ স্থাপনা

সাইফ ইমন

পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখ স্থাপনা

পাকিস্তানের হিন্দু অধিকার আন্দোলনের এক জরিপে দেখা গেছে, তিন দশক আগেও সে দেশে ৪২৮টি হিন্দু মন্দির ছিল; যার মধ্যে মাত্র ২০টি অবশিষ্ট আছে। তবে মন্দিরগুলোর অবস্থা তেমন একটা সুবিধাজনক নয়। এর মধ্যে পাকিস্তানে বারবার বিভিন্ন হিন্দু স্থাপনার ওপর হামলা হয়েছে। ফলে পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুরা সব সময়ই নানা অধিকারবঞ্চিত বলে দাবি করে আসছে একটি পক্ষ।  আজকের রকমারিতে থাকছে পাকিস্তানে অবস্থিত কিছু হিন্দু ও শিখ স্থাপনা...

 

কটাস রাজ শিবমন্দির

হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপনা

পাকিস্তানের ঐতিহাসিক তীর্থস্থান কটাস রাজ শিবমন্দির। তাৎপর্যপূর্ণ এই স্থানটি দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের চাকওয়াল জেলায় অবস্থিত। এখানেই কটস গ্রামে খোঁজ মেলে প্রাচীন হিন্দু মন্দির কটাস রাজের। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, এই শিবমন্দির অন্তত ৯০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কারও কারও মতে, এই মন্দিরটি তার চেয়েও বেশি পুরনো। প্রচলিত আছে, এই শিবমন্দিরেই সর্বপ্রথম শিবলিঙ্গের পূজা হয়। আরও প্রচলিত আছে, পান্ডবরা নাকি তাদের ১৪ বছরের নির্বাসনের মধ্যে চার বছরই এই স্থানে কাটিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান মন্দিরটি বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য মন্দিরটি ফের খুলে দেওয়া হয়। হিন্দু পুণ্যার্থীদের কাছে ঐতিহাসিক মন্দিরটি আজও এক বিস্ময়। মন্দিরের হ্রদের অগভীর অংশের জল সবুজাভ, গভীর অংশের জল নীলাভ। পুরাণ মতে, মন্দিরের মধ্যে যে হ্রদ রয়েছে, তার জল শিবের অশ্রু থেকে তৈরি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভক্তদের বিশ্বাস, এই পুকুরে স্নান করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, ঐতিহাসিক কারণেই কটাস রাজ শিবমন্দির চত্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহু পুরনো যুগের স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে সেখানে। মন্দিরের গায়েই রয়েছে বৌদ্ধ স্তু‚প এবং শিখ প্রতিষ্ঠানও।

 

মনসেহরা শিবমন্দির

৩ হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্য দেখতে আসেন বহু পর্যটক

মনসেহরা শিবমন্দির পাকিস্তানের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক পর্যটন স্থান। এটি পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন হিন্দু মন্দির যা বর্তমানে ৩ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য বহন করে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মনসেহরা জেলার মনসেহরা শহর থেকে ১৫ কিমি দূরবর্তী চিত্তি পাত্তিতে মন্দিরটি অবস্থিত। বার্ষিক শিবরাত্রি উৎসবে সমগ্র পাকিস্তান ও বিদেশ থেকে বহু মানুষ এখানে আসেন। এখানে অবস্থিত শিবলিঙ্গটি ২ হাজার বছরের পুরনো। তাই এই শিবলিঙ্গটিও এখানে আসা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতাত্তি¡ক গবেষণা অনুযায়ী বর্তমানে যেখানে মন্দিরটি অবস্থিত সেখানে প্রাচীনকালে আরও বহু মন্দির ছিল। ১৮৩০ সালে জম্মুর রাজা তাঁর ভগবৎভক্তির পরিচয়স্বরূপ মন্দিরটি পুনরুদ্ধার করেন। ১৮৪৭-১৮৪৮ সাল নাগাদ কিছু মানুষ মন্দিরটি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছিল। ১৯৪৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মন্দিরটি বন্ধ ও পরিত্যক্ত ছিল। পাকিস্তানের হিন্দুরা মন্দিরটি খোলার দাবি জানালে এটি আংশিকভাবে খোলা হয়।

 

পেশোয়ারের কালী বাড়ি মন্দির

কালীবাড়ি মন্দির পেশোয়ার জেলায় অবস্থিত। পাকিস্তান হিন্দু কাউন্সিল এই কালীবাড়ি মন্দির দেখভাল করে থাকে। এই মন্দিরটি হিন্দু দেবী কালীর মন্দির। দুর্গাপূজা শুধু বাঙালিদের মধ্যে প্রধান উৎসব হলেও এই মন্দিরটির প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। পেশোয়ারে আরও কিছু মন্দির রয়েছে। গোর খাত্রির গোরক্ষনাথ মন্দির ও ঝান্ডাবাজারের দরগাহ পীর রতন নাথজি হল পেশোয়ারের অল্প কয়েকটি মন্দিরের অন্যতম। দরগাহ পীর রতন নাথজি মন্দিরে প্রতিদিন পূজা হয়ে থাকে। আদালত ইভ্যাকুই ট্রাস্ট প্রপার্টি বোর্ডকে আদেশ দেয় গোরক্ষনাথ মন্দিরটিকে খুলে দেওয়ার জন্য। এই মন্দিরটি শুধু দীপাবলি উপলক্ষেই খোলা হয়।

 

কলাতের কালী ও শিবমন্দির

কলাতে অবস্থিত এই কালীমন্দির। কালী ও শিব দুইয়ের একত্রে পূজা করা হয় এই মন্দিরে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের কলাত শহরে অবস্থিত এটি। কলাতের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ হিন্দু। এরাই মূলত এই মন্দিরে প্রার্থনা করে থাকেন। এই মন্দিরটি দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের আগমনের আগেই নির্মিত হয়েছিল। সেকালে এই মন্দিরটি কলাত-ই-সেবা ও কলাত-ই নিকারি নামে পরিচিত ছিল। সাধারণভাবে নিকারিরাই মূল নিবাসী ব্রাহুইদের সবচেয়ে পুরনো শাখা হিসেবে স্বীকৃত। কথিত আছে, স্থানীয় বেলুচদের কিংবদন্তি নায়ক সেওয়া কলাত শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁরই নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয় কলাত-ই সেওয়া।

 

গুরুদুয়ারা দরবার সাহেব কর্তারপুর

দুই দেশের পুণ্যার্থীদের মিলনমেলা যেখানে

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত ঐতিহাসিক দরবার (মাজার শরিফ) ‘গুরুদ্বার দরবার সাহেব’। শিখ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র স্থান এটি; যা পাকিস্তানে তো বটেই, ভারতের শিখ পুণ্যার্থীদের কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ এই স্থানটি পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তবর্তী স্থান কর্তারপুরের নারোয়াল জেলায় অবস্থিত। ভারতীয় সীমান্তের দিক থেকে মাজারটি দৃশ্যমান। ঐতিহাসিক স্থানটির প্রতিষ্ঠাতা শিখ ধর্মীয় গুরুদ্বার বাবা অটল নানক। যিনি শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে গুরুনানক, বাবা নানক হিসেবে পরিচিত। বাবা নানক শিখ ধর্মীয় গোত্রের প্রথম ১০ জন ধর্মগুরুর মধ্যে প্রথম। কথিত আছে, বাবা নানক দূর-দূরান্ত ভ্রমণ করে এশিয়ার মানুষের মাঝে ধর্মের প্রচার করতেন। তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য মক্কা-মদিনা, শ্রীলঙ্কা, বাগদাদ, কাশ্মীর এবং নেপাল ভ্রমণ করেছিলেন। জীবনের শেষ ১৮ বছর এই কর্তারপুরেই কাটিয়েছিলেন গুরুনানক। গুরুদ্বার বাবা নানকের জন্মদিন কিংবা অন্যসব উপাসনার দিনগুলোয় কর্তারপুরে প্রচুর শিখ ধর্মাবলম্বীদের সমাগম ঘটে। ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শিখ তীর্থযাত্রীদের ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে। পবিত্র স্থানটির পাশাপাশি এখানে আছে স্বর্ণমন্দির অমৃতসর এবং গুরুদ্বার জনম আস্থান। শিখ পুণ্যার্থীরা পবিত্র স্থানটিকে বিশ্বের বৃহত্তম গুরুদ্বার বলেও দাবি করে আসছেন।

 

শ্রী বরুণ দেব মন্দির

বর্তমানে মন্দিরটির অবস্থা খুবই জীর্ণশীর্ণ

শ্রী বরুণ দেব মন্দিরটি সাগর তীরে অবস্থিত একটি মন্দির। এটির শিলালিপি গবেষণা করে পাওয়া যায়, মন্দিরটি প্রায় ১ হাজার বছরের পুরনো। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের করাচি শহরের মনোরা দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের কাছে অবস্থিত মন্দিরটি হিন্দুধর্মের জলের দেবতা বরুণকে উৎসর্গকৃত। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে অগণিত বার তুর্কি আর মুঘলদের হাতে বিধ্বস্ত আর লুণ্ঠিত হওয়ার পরও টিকে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি। ষোড়শ শতাব্দীতে এক ধনকুবের হিন্দু নাবিক ভোজমল ন্যান্সি ভাটিয়া কালাতের খান সরদারের কাছ থেকে সমগ্র মনোরা দ্বীপটি ক্রয় করে নিয়েছিলেন। তখন তিনি প্রাচীন এই মন্দিরটি সংস্কার করেন। কালাতের খান সেই সময়ে উপকূল বরাবর বেশিরভাগ জমির মালিক ছিলেন ও তাঁর পরিবার মন্দিরটির দায়িত্ব নিয়েছিল। বর্তমান কাঠামোর পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯১৭-১৮ সালের দিকে। বর্তমানে এই মন্দিরটি পাকিস্তান হিন্দু পরিষদের অধীনে।

 

বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে বিখ্যাত হিংলাজ মন্দির

পাকিস্তানে অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় হিংলাজ দেবীর মন্দিরকে। ‘শক্তিপীঠ’ হিসেবে হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে এই তীর্থক্ষেত্রের। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের লাসবেলা জেলায় এই গুহা-মন্দির অবস্থিত। অনেকে এটিকে হিঙ্গুলা দেবীও বলে থাকেন। এটি নানিমন্দির হিসেবেও পরিচিত। করাচি থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই মন্দিরে কোনো মূর্তিপূজা হয় না। হিংলাজ দেবী হিসেবে একটি পাথরের পূজা করা হয়। এখানে সতীর মাথা পড়েছিল বলে হিন্দুধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস। শুধু হিন্দুরা নন, এই মন্দিরে নিয়মিত আরাধনা করেন অন্য ধর্মের লোকেরাও। পাকিস্তানের মুসলিমদের কাছে এটি পরিচিত ‘নানি’ অথবা ‘বিবি নানি’র মন্দির হিসেবে। প্রতি বছর এপ্রিল মাসে চার দিনের জন্য হিংলাজে তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়। সে সময় দূর-দূরান্ত থেকে নানা ধর্মের মানুষ এই মন্দিরে আসেন। মন্দিরের নামেই এখানকার গ্রামটির নাম হিংলাজ গ্রাম। বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া ও সিন্ধি ভাষায় দেবীর নাম হিংলাজ হলেও মূল সংস্কৃত শব্দটি হলো ‘হিঙ্গুলা’। এটিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বিষের ওষুধ বা অ্যান্টিভেনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বেলুচিস্তানের লাসবেলায় মাকরান উপকূলের কাছে গিরিখাতে থাকা হিংলাজে সতীর সিঁদুর বা হিংগুল মাখা মাথা পড়েছিল বলে কথিত আছে। তাই হিন্দুদের কাছে হিংলাজপীঠ খুবই পবিত্র। ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু প্রদেশ, বঙ্গদেশ ও আসামেই মূলত শাক্তদের বসবাস। তবে হিংলাজের তীর্থযাত্রীরা আসেন সারা ভারত থেকে। তীর্থযাত্রীরা সেকালে যেতেন উটের পিঠে চড়ে। যাত্রা শুরু হতো করাচি শহরের কাছে হাব নদীর কাছে। সঙ্গে থাকত এক মাসের রসদ। যেমন শুকনো খাবার, মরুদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্র, পানীয় জল ইত্যাদি। এ ছাড়া সঙ্গে থাকত হিংলাজ মাতার প্রসাদের জন্য শুকনো নারিকেল, মিছরি, বাতাসা ইত্যাদি। এক মাসের অত্যন্ত কঠিন যাত্রার পর তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন হিংলাজে।

 

শ্রী রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির

শিবরাত্রি উৎসবের জন্য প্রসিদ্ধ এই ভূগর্ভস্থ মন্দির

শ্রী রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। দেড় শ বছরের পুরনো মন্দিরটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচি ক্লিফটন সৈকতের কাছে ক্লিফটন গুহায় অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে, মন্দিরটি শিবরাত্রি উৎসবের জন্য প্রসিদ্ধ। এই উৎসবের সময় মন্দিরটিতে ২৫ হাজার হিন্দু পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটিকে শহরের অন্যতম সুন্দর স্থাপত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মন্দিরে ছয়টি ভূগর্ভস্থ স্তর রয়েছে। করাচির জাহাঙ্গীর কোঠারি প্যারেডের কাছে দুটি সিঁড়ি রয়েছে যা দিয়ে এই ভূগর্ভস্থ স্তরের দিকে যাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর