বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুসলিম দেশে ধ্বংসযজ্ঞ

আ ব দু ল কা দে র

মুসলিম দেশে ধ্বংসযজ্ঞ

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় ‘জঙ্গি সংগঠন’। এসব উগ্রবাদীর কাছে অনেক দেশের হার মানার নজিরও রয়েছে। যাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর-পরাশক্তির দেশগুলো। তবুও এমন সন্ত্রাসী সংগঠনের কালো থাবা থেমে থাকেনি। তারা ধ্বংস করে চলেছে মুসলিম দেশ ও জনপদ। এমন কিছু দেশ নিয়ে আজকের রকমারি...

 

দুই দশকে আফগানকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র

আফগানিস্তান

২০ বছর যুদ্ধের পর আমেরিকা ও ব্রিটিশ সৈন্যরা বলতে গেলে শূন্য হাতেই আফগানিস্তান ছেড়ে যান। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী (ন্যাটো) আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ওই সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক কোয়ালিশন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আল কায়েদাকেও সাময়িকভাবে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। কিন্তু ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্য বিশেষ করে আমেরিকাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষ। দুই দশক ধরে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সৈন্যদের তালেবান ও আল-কায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গত ৩১ আগস্ট, শেষ মার্কিন সামরিক বিমান আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দর ত্যাগ করার মাধ্যমে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। এখন পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। জখম হয়েছে ২০ হাজার। সেই সঙ্গে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেছে। আরও কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে দুই দশকের এই যুদ্ধে। তবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছে আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সুতরাং অপ্রিয় হলেও এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এই প্রাণহানি আর বিপুল অর্থ খরচের আদৌ কি কোনো প্রয়োজন ছিল? তবে এই প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর মেলা শক্ত। আল-কায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটো লক্ষ্য ১০ বছর আগে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এতদিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যা অনেকটা ঔপনিবেশিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় একরকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স নামে একটি গবেষণা সংস্থার হিসাব মতে, ২০২০ সালেও বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল কায়েদা, ইসলামিক  স্টেটসহ আরও অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সে দেশে নির্মূল হয়নি।

 

ভুল তথ্যে ইরাক যুদ্ধ, ঝরে গেল লাখ লাখ প্রাণ

ইরাক

২০০৩ সালের ২০ মার্চ, একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনী। অভিযোগ দেশটিতে বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র আছে। তখন মার্কিন প্রশাসন জানায়, এসব বিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকের জনগণ ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য হুমকি। তৎকালীন বুশ-ব্লেয়াররা জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে এই আগ্রাসন চালায়। আর মাত্র ২০ দিনে বাগদাদ দখল করে ইরাক বিজয় ও যুদ্ধ অবসানের ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। আগ্রাসনে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের শাসনের পতন হয়। এরপরই ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের নতুন আতঙ্কের উত্থান ঘটে। সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের ১৮ বছর পার হলেও ইরাকিরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা কোনোটাই পায়নি। বরং তারা হারিয়েছে স্বাধীনতা, পেয়েছে পরাধীনতা। তখন থেকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ ৩৪টি দেশ। অবৈধ আগ্রাসনে দেশটির সবকিছু ধ্বংস করার পর ১৮ বছর পর মার্কিনিরা অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করলেও এখনো ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের একটি বড় দল অবস্থান করছে। এ ছাড়া আছে কিছু বিশেষ বাহিনীর সদস্য, যাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা অজানা। তবে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। বছর কয়েক আগে ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) ইরাক সরকার পরাজিত করার ঘোষণা দিলেও দেশটিতে এখনো জঙ্গিগোষ্ঠীটির তৎপরতা রয়েছে। বিভিন্ন সময় আইএসের চালানো রক্তক্ষয়ী হামলা তার প্রমাণ। ফলে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা একদিকে যেমন আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে, অন্যদিকে ইরাকি বাহিনীকে জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়ে সক্ষম করে তুলছে। তবে বাগদাদভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রাসনের কারণে প্রায় ৩ লাখের বেশি ইরাকি নাগরিক ও ৪ হাজার ৪০০ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। এরপর আইএসের সঙ্গে যুদ্ধে কমপক্ষে ৭ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এই যুদ্ধে দেশটির ২০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী নিহত হওয়ার পাশাপাশি প্রাণ গেছে ২৩ হাজার আইএস যোদ্ধার। প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে পুরনো শহর মসুলের অসংখ্য পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রায় ৩৫ লাখ ইরাকি পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিজ দেশেই উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ ইরাকি। ইরাক আগ্রাসনে এক মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং একজন মানবাধিকার সংগঠক এক অনুসন্ধানে জানিয়েছেন, গত ১৮ বছরে ২৪ লাখের বেশি ইরাকির মৃত্যু হয়েছে। তথ্য ভুল হোক বা সঠিক, মুসলিম দেশটির মুসলিম নাগরিকেরা ভয়াবহ এই আগ্রাসনে আজ বিপর্যস্ত। অন্যদিকে ইরাকে ‘যুদ্ধের দায়িত্ব সমাপ্ত’ করার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।  ফলে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে চলা এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

যুদ্ধ, মৃত্যু ও হাহাকারের দেশ সিরিয়া

সিরিয়া

১০ বছর ধরে চলছে সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দেশটির সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান থেকে ঘটনার সূত্রপাত। ২০১১ সালের মার্চে আসাদবিরোধী গ্রাফিটির কারণে চারজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায় সরকারি বাহিনী। এ ঘটনার প্রতিবাদে দেশটির ডেরা শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে সরকারি বাহিনী গুলি ছোড়ে, বহু বিক্ষোভকারী মারা যান। বাশার আল-আসাদ বাহিনী দেশব্যাপী অপারেশন চালায়। মাত্র তিন মাসে ১৬ হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হন। বাশার সরকার পতনের লক্ষ্যে ২০১১ সালের জুলাইয়ে সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহীদের ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠনের মধ্য দিয়েই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপর সশস্ত্র সংঘাত ভয়ংকর রূপ নেয়। একই বছরের অক্টোবরে সরকারি সেনার ওপর ট্যাংক এবং হেলিকপ্টার সহযোগে প্রথম হামলা চালায় কোম শহর দখল করার জন্য। এরপর থেকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি দেশের অনেক অংশ দখল করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদেশিদের নগ্ন হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ২০১৫ সালে রাশিয়ার সরব উপস্থিতি। ইরান, ইরাক ও লেবাননের হিজবুল্লাহ বাশার আল-আসাদকে সমর্থন-সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে তুরস্ক, কাতার এবং সৌদি আরব আসাদবিরোধীদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। ২০১৬ সালে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সিরিয়ায় পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই অস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করে আসছে। ২০১৪ সালে তারা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে। বিশ্লেষকরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আইএস প্রতিষ্ঠা করে সিরিয়ায় নিজেদের প্রবেশ নিশ্চিত করে। এরই মধ্যে ইসরায়েল সিরিয়ায় বোমা হামলা চালায়। পক্ষান্তরে সিরিয়ান সেনাবাহিনী ইসরায়েলের বিমান ভূপাতিত করে। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, শহর দখল, দখল থেকে মুক্ত, আবার পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে ১০ বছর কেটে যায়। এক দশকের এই সংঘাতে ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তালিকায় আছেন নিরীহ জনগণ, সেনাসদস্য, বিদ্রোহী এবং সরকারি সমর্থকরাও। ভয়ানক এই যুদ্ধে দেশটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে সিরিয়ার ষাট লাখ মানুষ। জাতিসংঘের তদন্তকারী দল বলেছে, সিরিয়ায় গত ১০ বছরে আটক হওয়া লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক এখনো নিখোঁজ। এই যুদ্ধে মুসলিম দেশটি আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সিরিয়াকে ঘিরে কেউ কেউ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন। তবে এ আশঙ্কা সত্য হবে না বলেই মনে হয়।  কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া দুই পক্ষই জানে, যুদ্ধের পরিণতি ভয়াবহ।

 

গৃহযুদ্ধের পর এক দেশে দুই সরকার

লিবিয়া

আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে লিবিয়ায় গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। দেশটির একাংশ সরাসরি বিদ্রোহে নামে সরকারপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। তাদের সহায়তা করতে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ন্যাটো জোট। ২০১১ সালের অক্টোবরে গাদ্দাফির স্বৈরাচার সরকারকে ফেলে দেওয়া হলো। এরপর থেকেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০১৫ সালে গঠিত লিবিয়ার জাতিসংঘ-সমর্থিত ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার (জিএনএ) দেশটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। পরবর্তীকালে ফায়েজ আল সারাজের নেতৃত্বাধীন জিএনএ সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয় খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ)। জিএনএকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রধান সমর্থক হলো ইতালি, তুরস্ক ও কাতার। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ফ্রান্স ও রাশিয়ার কিছু অংশ দলত্যাগী সেনা কমান্ডার খলিফা হাফতারকে সমর্থন করে আসছে, যিনি ২০১৪ সালের পর থেকে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে লিবিয়ার ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে ত্রিপোলিতে অবস্থিত জিএনএর দখলে আছে সমুদ্রতীরবর্তী ত্রিপোলি, মিসরাতার মতো জনবহুল শহর, অন্যদিকে হাফতারের এলএনএর নিয়ন্ত্রণে আছে পূর্ব ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ জনবিরল অঞ্চল ও সির্ত, তর্বুক, ডের্না এবং বেনগাজির মতো বড় শহর। প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে দুটি আলাদা সরকার যাদের অধীনে রয়েছে আলাদা সেনাবাহিনী। গত বছর খলিফা হাফতার লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজধানী ত্রিপোলি দখলের ঘোষণা দিলে নতুন করে অস্থিতিশীলতার সূত্রপাত ঘটে। এরপর তুরস্ক জিএনএর সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। বিপুল গোলাবারুদ, অত্যাধুনিক ড্রোন আর সিরিয়া থেকে বিদ্রোহীদের এনে হাফতার বাহিনীর ত্রিপোলি অভিযান রুখে দিতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালেই লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে দুই লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে ও প্রাণ হারায় হাজার হাজার লোক।  এক সময়ের শান্তিপূর্ণ সম্পদশালী দেশ লিবিয়াও এখন পরিণত হয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্রে।

 

ইয়েমেনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়

ইয়েমেন

ইয়েমেনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইন্ধন জুগিয়েছিল আরব বসন্ত। ক্ষমতার পালাবদলের আগে ইয়েমেনের দীর্ঘকালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একনায়ক আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালে আবদ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন হাদি। একদিকে জঙ্গিদের তৎপরতা অন্যদিকে ইয়েমেনের দক্ষিণে বিস্তার লাভ করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর হুতি বিদ্রোহীরা তো ছিলই। দুর্বল ইয়েমেন সরকার এবং হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে এই সংঘাতের শুরু ২০১৪ সালে। এ সময় সুন্নিসহ অনেক সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিকও হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সানা দখল করে নেয় হুতিরা। ফলে ইয়েমেনে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি সরকার পক্ষ, আরেকটি হুতি বিদ্রোহীরা। আলী আবদুল্লাহ সালেহর সমর্থক সেনারাও হাত মিলিয়েছিল হুতিদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সমর্থনে এই বিমান হামলা শুরু হয়। নির্বাসনে থেকেই ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হাদি এই অভিযানে সমর্থন দেন। শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সহযোগিতা করছে- এমন অভিযোগ তুলে এর পরপরই দৃশ্যপটে আসে সৌদি আরব। সৌদিদের পক্ষে যোগ দেয় আরব বিশ্বের সুন্নিপ্রধান আরও ৮টি দেশ। শুরু হয়ে যায় হাদির পক্ষে জোটগত সামরিক অভিযান। এই জোটকে গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ছয় বছর ধরে চলতে থাকা এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইয়েমেন। দেশটির জনসংখ্যার ৮০ ভাগেরই সহায়তা বা সুরক্ষা প্রয়োজন। শহর দখল, দখল থেকে মুক্ত, আবার পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে ছয় বছর। ইয়েমেন যুদ্ধে পরাশক্তিতে লড়াই, মাঝখানে সাধারণ মানুষ পড়ে চেপ্টা  হয়ে যাচ্ছে।

 

অস্থিতিশীল সোমালিয়ার জন্য দায়ী আল-শাবাব

সোমালিয়া

সোমালিয়াও আরব দেশ। অথর্ব সরকারের কর্মকান্ড ও নিজের ভোগবিলাসের লালসা এর সমস্যা ও দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বপরিমন্ডলে সোমালিয়া জলদস্যুর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজ ও তেলের ট্যাংকারে নির্মম অভিযান চালায় ওরা। গত ৪০ বছরে সোমালিয়ায় ডজনখানেক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। নিকটাতীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল ২০১০-১২ সালে, ২০১৪ ও ২০১৬-১৭ সালে। খরা ও জাতিগত বিরোধে সোমালিরা মানবিক সহায়তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। খাবারের দাম আকাশচুম্বী, লাখ লাখ সোমালি জানেন না তাদের পরবর্তী আহার কোত্থেকে আসবে। ২০১১ সালে দুর্ভিক্ষে ২ লাখ ৬০ হাজার জনের মৃত্যু হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সোমালিদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে দেশটির রাজধানী মোগাদিসুতে দুই ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃত্বের জন্য লড়াই করে আসছে। এক দল সুফি ভাবধারার এবং তারা মধ্যপন্থি; অপর দল আল শাবাব ‘মৌলবাদী’ ও উগ্র। কোনো বিরতি ছাড়াই পক্ষদ্বয় ১৯৯১ সাল থেকে লড়াই করে আসছে, যা আজও চলছে। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের নামে আল শাবাব সন্ত্রাসী গ্রুপ দেশটির সাধারণ মানুষের ওপর প্রায়ই হামলা চালিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র আল শাবাবকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। আল শাবাব তাদের ঘোষণা মতে, শরিয়া আইন পুরোপুরি চালু করতে চায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল শান্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এমন ভয়াবহ রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে সোমালিয়ার এক বিরাট অংশ ‘সোমালিল্যান্ড’ নামে স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। আন্তর্জাতিক বাহিনী সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতাবিরোধী টহল দেয়। এদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সোমালিয়া থেকেও সেনা প্রত্যাহার করবেন। যদিও আল শাবাবের সঙ্গে যুদ্ধ ও সংঘাত চলছে, তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আর সেনা পাঠাবে না বলে জানিয়েছে।

 

ফ্রান্সে বধ হলেও মালির যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি

মালি

২০১২ সালে, মালির জিহাদি সমস্যা মূলত দেশটির উত্তরের দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল। মালির পাশেই রয়েছে সাহারা মরুভূমি, প্রতিবেশী হিসেবে সাহারা খুব সুখকর জায়গা নয়। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির পতনের পর মালির সেনাবাহিনীর পক্ষে এই বিশাল মরু অঞ্চল এককভাবে পাহারা দেওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠেছে, যাদের হাতে আবার পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রও নেই। এর ফলে দেখা গেল, মালিতে সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতাশূন্যতা সৃষ্টি হলো, যার মধ্যে তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদী এমএনএলএও তাদের জিহাদি সঙ্গীরা ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সের সেই হস্তক্ষেপের আড়াই বছর পর মালি ও তার আন্তর্জাতিক সঙ্গীরা দেশটি পুনর্নির্মাণে কাজ করছে। ফরাসি সেনাদের ওই এলাকার সিংহভাগ পুনর্দখল করতে মাত্র ২৩ দিন সময় লেগেছিল। এরপর দেশটিতে ২০১৩ সালে নির্বাচন হলো, তার মাধ্যমে ক্যারিশম্যাটিক ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক ইব্রাহিম বুবাকার কেইতা আবারও ক্ষমতায় আসেন। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে বিদ্রোহী জোট ও সিএমএর মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি হয়। কিন্তু মালির অবস্থা ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো নয়, সেখানকার দ্বন্দ্ব পুরোপুরি শেষ হয়নি। দেশটির উত্তরে এখনো বিভিন্ন নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, একিউআইএম ছাড়াও জিহাদি আল-মুরাবিতুন ও আনসার দ্বীন সেখানে রয়েছে, আবার সেখানে সরকারপন্থি জঙ্গি বাহিনীও রয়েছে। ফলে সেখানে জাতিসংঘের কাজও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে জিহাদিরা এসব হামলা চালালেও সব সময় যে তারাই এই হামলা চালায়, ব্যাপারটা সে রকম নয় যে জিহাদিদের সঙ্গে একিউআইএমের সম্পর্ক আছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই যোদ্ধারা অনায়াসে এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীতে চলে যাচ্ছে, তারা জিহাদি গোষ্ঠী থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যাচ্ছে আবার ফেরতও আসছে,  তা সেসব গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর