বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

২০ বছর আগে ফিরে গেল আফগান

সাইফ ইমন

২০ বছর আগে ফিরে গেল আফগান

আফগানিস্তান অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। প্রথমে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে বরাবরই লড়াই করে গেছেন আফগানরা। বিশ্বের সব পরাশক্তির সঙ্গে তালেবান গোষ্ঠীর লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ধ্বংসপ্রায়। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান কিংবা আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটি লক্ষ্য ১০ বছর আগেই অর্জিত হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, এত দিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তিঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল; যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো।  কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।  এর মধ্য দিয়ে ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটল। কিন্তু আফগানিস্তান ফিরে গেল সেই আগের সময়েই...

 

যেভাবে যুদ্ধের সূচনা

আফগানিস্তানের ইতিহাস থেকে জানা যায় দেশটির ইতিহাস, সাধারণ মানুষ আর ঐতিহ্যের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে বারবারই হতে হয়েছে বিদেশি পরাশক্তিগুলোর হামলার শিকার। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর উপযুক্ত জবাব দিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। পরের কয়েক মাসে আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। যদিও সে যুদ্ধ থেমে থাকেনি, চলেছে দীর্ঘ ২০ বছর। যুদ্ধে মূল টার্গেট তালেবান এবং আলকায়েদা হলেও দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে প্রাণ হারায় সাধারণ আফগান নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে তাদের মনোনীত হামিদ কারজাইকে ক্ষমতা প্রদান করে। হামিদ কারজাই পরিচিত ছিল ‘শাহ শুজা দ্য থার্ড’ নামে। এর আগে ব্রিটিশদের মনোনীত সরকারকে বলা হতো ‘শাহ শুজা’।  পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনোনীত সরকারকে বলা হতো ‘শাহ শুজা দ্য সেকেন্ড’ নামে।

 

যুদ্ধে বিপুল অর্থ খরচ করেও ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র

প্রচুর অর্থ খরচ করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য থেকে গেছে অপূর্ণ। আফগান যুদ্ধে গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি ডলার খরচ হয় সরাসরি যুদ্ধ খাতে, ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার গেছে আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে এবং এই বাহিনীর বেতনের জন্য বছরে গুনতে হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছে। এ তো গেল প্রত্যক্ষ খরচের হিসাব। পরোক্ষ ব্যয়ের তালিকাও দীর্ঘ। ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৪০০ সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রায় ৪ হাজার ঠিকাদার নিহত হয়েছে তালেবানদের হামলায়। যুদ্ধে আহত হয়েছে আরও ২০ হাজার সেনা। এই আহত সেনাদের চিকিৎসা ও অবসর ভাতা হিসেবে আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রকে গুনতে হবে আরও ৩০ হাজার কোটি ডলার।  এক কথায় পাহাড় সমান অর্থ খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

তালেবানদের হাতেই গেল আফগানিস্তানের ভাগ্য

তালেবানদের উৎখাত করতে এসে আবারও সেই তালেবানদের হাতেই ক্ষমতা ফিরে এসেছে আফগানিস্তানে। সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়েছে মার্কিন বাহিনী। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা থাকলেও স্থানীয় সময় ৩০ আগস্ট গত সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় সব শেষ মার্কিন বিমান ছেড়ে যায় কাবুল বিমানবন্দর। এর মধ্য দিয়ে যেন তালেবানদের মুক্তির স্বাদ মিলল ২০ বছর পর। মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছাড়তেই উল্লাসে মেতে ওঠে তালেবানরা। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে, বাজি ফুটিয়ে ‘স্বাধীনতা’ উদ্যাপন করল তালেবান যোদ্ধারা। তালেবানরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, ৩১ আগস্টের মধ্যেই আফগানিস্তানের মাটি ছাড়তে হবে মার্কিন বাহিনীকে। এর মধ্যেই উদ্ধার কাজ শেষ করতে হবে। সময়সীমা কোনোভাবেই বাড়ানো হবে না। তালেবানদের দেওয়া সেই সময়সীমা মঙ্গলবার শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সোমবারই সব কিছু গুটিয়ে স্বদেশে রওনা হয় আমেরিকার সেনাদল। মার্কিন শেষ বিমান আফগানের মাটি ছাড়তেই সেই মুহুর্তকে উপভোগ করতে বাজি, বোমা ফাটিয়ে, বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ে মুক্তির উল্লাসে মেতে ওঠে তালেবান সদস্যরা।  তার পরই তালেবানরা এই দিনটিকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

 

শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিযানে প্রাণ গেছে বহু বেসামরিক মানুষের

এই ২০ বছরের শান্তি প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে কত মানুষের প্রাণ গেছে তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। পশ্চিমা ন্যাটো জোটের কত সৈন্য মারা গেছে, ভালোভাবে তার হিসাব রাখা হয়েছে। কিন্তু তালেবান কিংবা আফগান বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব সেভাবে রাখা হয়নি। গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬৯ হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। অন্যদিকে আফগান বেসামরিক মানুষ মারা গেছে ৫১ হাজার। নিহত হয়েছে প্রায় একই সংখ্যক জঙ্গি। ২০০১ সালের পর থেকে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন জোটের সাড়ে ৩ হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে। এদের দুই-তৃতীয়াংশই মার্কিন সেনা। ২০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এই যুদ্ধে আহত হয়েছে।  জাতিসংঘের হিসাবে ২০১২ সাল থেকে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে গেছে।

 

মার্কিন সেনারা দেশ ছাড়ায় সংকটে আফগানরা

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রথমে তালেবানরা মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হতে চললেও ২০০৪/৫ সাল থেকেই তালেবান নামক সংগঠনটি পুনরায় সংগঠিত হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি মার্কিন সেনা ও আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এই যুদ্ধের বলি হতে হয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষকে। দুই দশক ধরে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সৈন্যদের তালেবান ও আলকায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। আফগান যুদ্ধে দেশটি তাদের হাজার হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটি লক্ষ্য ১০ বছর আগে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এত দিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে আফগান শরণার্থীর ঢল

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এতে প্রতি দুই সেকেন্ডে বাস্তুচ্যুত হয়েছে একজন। সব মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। জাতিসংঘ বলছে, এসব শরণার্থীর মধ্যে আফগান নাগরিকই বেশি। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত রাশিয়া ও আফগানিস্তানের বড় ধরনের সেই লড়াইয়ে ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ১০ বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া বিদায় নেয়। এরপর কেটে যায় আরও ১০ বছর। টুইন টাওয়ারে হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের উৎখাতের পর ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ দেশে ফিরে গেছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এখনো প্রায় ২০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। বর্তমান সহিংসতার কারণে যাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়।

 

দেশ রক্ষা হয়নি, যুদ্ধে ধ্বংস প্রচুর স্থাপনা

২০০১ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণের পরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তালেবান বাহিনী। সে সময়ও তারা একের পর এক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দেশটির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। আফগানিস্তানের গৌরবোজ্জ্বল অতীত এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নীরব সাক্ষী যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বুদ্ধের মূর্তি দুটি। আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান বাহিনী। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ইসলামিক এবং প্রাক-ইসলামিক বহু স্থাপনা ধ্বংসের খেলায় মাতে তালেবান বাহিনী। প্রথম অ্যাংলো-আফগান, দ্বিতীয় সোভিয়েত-আফগান এবং তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধে দেশটির বহু প্রাচীন স্থাপনার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির অনেক আধুনিক স্থাপনাও।

 

৯৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক যান ধ্বংস করে গেল মার্কিনিরা

আফগানিস্তান ছাড়ার আগে ৯৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক যান ধ্বংস করে গেল মার্কিন বাহিনী। তালেবানের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তাড়াহুড়া করে কাবুল ত্যাগের কারণে সব সামরিক বিমান নিজ দেশে ফেরত নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দর ত্যাগের আগে সেখানে থাকা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ৭৩টি সামরিক বিমান মার্কিন বাহিনী এমনভাবে নষ্ট করে রেখেছে, যাতে তালেবানরা আর এগুলো ব্যবহার করতে না পারে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছেন, কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য যেসব সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা ছিল, সামরিক বিমানগুলোর মতো সেগুলোও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কেনেথ ম্যাকেঞ্জি আরও বলেন, ফেলে রেখে আসা মার্কিন সামরিক বিমানগুলো আর কখনো আকাশে উড়বে না। এ ছাড়া ৭০টি সামরিক যান এবং ২৭টি হামরি টহল যান নষ্ট করা হয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য এক মিলিয়ন ডলার। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে ৩০ আগস্ট মার্কিন সামরিক বাহিনীর সর্বশেষ ফ্লাইটটি আফগানিস্তান ত্যাগ করে। এর মাধ্যমে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তালেবানরা যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক যান ব্যবহার করতে না পারে, তাই ধ্বংস করা হয়েছে।

 

৭৯ হাজার মানুষ কাবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন

মার্কিন সামরিক বাহিনীর জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছেন, তারা ৬ হাজার মার্কিন নাগরিকসহ ৭৯ হাজার মানুষকে কাবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন। ১৫ আগস্ট তালেবানরা কাবুল দখল করার পর অল্প সময়ের মধ্যে সব মিলিয়ে কাবুল থেকে ১ লাখ ২৩ হাজার সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন দেশ নিয়ে গেছে। অন্যদিকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী চূড়ান্তভাবে আফগান ভূখন্ড ছাড়লেও কাবুলে প্রায় ২০০ মার্কিন নাগরিককে ফেলে রেখে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক হাজার হাজার আফগান নাগরিককেও ফেলে রেখে গেছে দেশটি। কাবুল ছাড়ার জন্য তাদের এখন তালেবানের অনুমতির ওপর নির্ভর করতে হবে। এখন এসব হতভাগ্যদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এখনো এদের সম্পর্কে তালেবানদের ভূমিকা কী হবে তা বলতে পারছেন না কেউই।

 

২০ বছরের লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ : নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা

আলকায়েদা আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। চারটি যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে দুটি নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আঘাত হানে। আরেকটি আঘাত হানে ওয়াশিংটন ডিসির পেন্টাগনে। চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভেনিয়ার এক মাঠে বিধ্বস্ত হয়।

অক্টোবর ২০০১ : প্রথম বিমান হামলা

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোট আফগানিস্তানে তালেবান এবং আলকায়েদার স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলা শুরু করে। হামলা করা হয় কাবুল, কান্দাহার এবং জালালাবাদে। সোভিয়েত দখলদারিত্বের অবসানের পর ক্ষমতায় এসেছিল তালেবানরা।

১৩ নভেম্বর ২০০১ : কাবুলের পতন

আফগানিস্তানের তালেবানবিরোধী একটি জোট, নর্দার্ন অ্যালায়েন্স, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের সমর্থনে কাবুলে প্রবেশ করে। তালেবানরা কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর নাগাদ সব তালেবান হয় পালিয়ে যায় অথবা তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।

২৬ জানুয়ারি ২০০৪ : নতুন সংবিধান

আফগানিস্তানের সব জনগোষ্ঠীর নেতাদের নিয়ে লয়া জিরগা বা এক বিরাট জাতীয় সম্মেলনে বহু আলোচনার পর নতুন আফগান সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানের অধীনেই ২০০৪ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়।

ডিসেম্বর ২০০৪ : হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হলেন

আফগানিস্তানের পপালজাই দুররানি উপজাতির নেতা হামিদ কারজাই নতুন সংবিধানের অধীনে আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। পাঁচ বছর মেয়াদ করে দুবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

মে, ২০০৬ : হেলমান্দে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন

আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের হেলমান্দ প্রদেশে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন শুরু হয়। হেলমান্দ তালেবানের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। তাদের প্রাথমিক মিশন ছিল সেখানে পুর্নগঠন কাজে সাহায্য করা। কিন্তু শিগগিরই তারা তালেবানের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ : ওবামার নতুন কৌশল

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর এক নতুন কৌশল অনুমোদন করেন। এক পর্যায়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার। ইরাক যুদ্ধের কৌশলের অনুকরণেই প্রেসিডেন্ট ওবামা এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

মে ২০১১ : ওসামা বিন লাদেন নিহত

পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের এক বাড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী নেভি সিলসের হামলায় আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। বিন লাদেনের দেহ সেখান থেকে সরিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

২৩ এপ্রিল ২০১৩ : মোল্লা ওমরের মৃত্যু

তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যু হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় তার মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয়েছিল। আফগান গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের করাচির এক হাসপাতালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মোল্লা ওমর মারা যান।

২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ : ন্যাটোর যুদ্ধ মিশনের সমাপ্তি

কাবুলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ন্যাটো আফগানিস্তানে তাদের সরাসরি লড়াইয়ের সমাপ্তি টানে। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের হাজার হাজার সৈন্য প্রত্যাহার করা শুরু করে। যারা থেকে গিয়েছিল তাদের মূলত প্রশিক্ষণ এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা দেওয়ার কাজে লাগানো হয়।

২০১৫ : তালেবানের পুনরুত্থান

তালেবান একের পর এক আত্মঘাতী হামলা, গাড়িবোমা হামলা এবং অন্যান্য হামলা চালাতে শুরু করে। কাবুলে পার্লামেন্ট ভবনে এবং কুন্দুজ শহরে হামলা চালায়।

২৫ জানুয়ারি ২০১৯ : মোট নিহত সৈন্য সংখ্যা ঘোষণা

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি জানান, ২০১৪ সালে তিনি আফগানিস্তানের নেতা হওয়ার পর তার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫ হাজার সদস্য নিহত হয়েছে।

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ : তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি

কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানরা আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক চুক্তিতে সই করে। চুক্তি মেনে যুক্তরাষ্ট্র সব সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হয়।

৩০ আগস্ট ২০২১ : সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন

আফগানিস্তানে শেষ হয় মার্কিন অধ্যায়। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা থাকলেও স্থানীয় সময় ৩০ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৩টায় সব শেষ মার্কিন বিমান ছেড়ে যায় কাবুল বিমানবন্দর। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আফগানিস্তান অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর