বুধবার, ৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

খুলে গেল প্যানডোরার বাক্স

সাইফ ইমন

খুলে গেল প্যানডোরার বাক্স

এ যাবৎকালের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিশ্বের বড় বড় নেতা, রাজনীতিবিদ ও ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বাবিস, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার- এমন আরও অনেক নেতার গোপন সম্পদের তথ্য এতে প্রকাশ পেয়েছে। প্যানডোরা পেপারস নামে এসব দলিলপত্রে প্রায় ৩৫ জন বর্তমান ও সাবেক নেতা এবং ৩ শতাধিক সরকারি কর্মকর্তার নাম রয়েছে- যারা বিভিন্ন  বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট...

 

কী এই প্যানডোরার পেপারস

ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস সংস্থার উদ্যোগে অন্তত ৬৫০ জন সাংবাদিকের তত্ত¡ বধানে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাই প্যানডোরার পেপারস। মূলত বিবিসি প্যানোরমা, দ্য গার্ডিয়ানসহ অন্য বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ সংস্থার উদ্যোগে সাত বছর ধরে চলা এই গোপন তদন্তের নথি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস এবং লাক্সলিকসের ধারাবাহিকতায় এবার ৯৫ হাজার অফশোর ফার্মের ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি ফাঁস করা হলো। এতে বেরিয়ে আসছে বিশ্ব নেতা, রাজনীতিবিদ এবং ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তথ্য। বলা হচ্ছে, গোপন আর্থিক নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা এটি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে) এসব নথি হাতে পায়। ১১৭টি দেশের ৬৫০ জন সাংবাদিক এসব নথি বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে ধারাবাহিকভাবে এমন তথ্য প্রকাশ করছেন।  এসব নথিতে মোট ৩৫ জন রাষ্ট্রনেতার তথ্য মিলেছে।

 

বিশ্বজুড়ে নেটওয়ার্ক অফশোর কোম্পানির

ধনকুবেররা কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন পরিচয় গোপন করে। এসব কোম্পানি হলো অফশোর কোম্পানি।

এই কোম্পানিগুলোর জটিল নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে। অবৈধ টাকায় সম্পত্তি ক্রয় করতেই ব্যবহার করা হয় এসব প্রতিষ্ঠান। এই অফশোর কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কত টাকা গোপন রেখেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ফাঁস হওয়া নথি থেকে ধারণা করা হচ্ছে এর সংখ্যা প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার এসব প্রতিষ্ঠান মূলত বিশ্বের নামি ব্যক্তিত্বদের সম্পদ তাদের মালিকানায় কেনে এবং প্রকৃত ক্রেতার পরিচয় গোপন রাখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অবৈধ টাকায় কেউ সম্পত্তি কিনতে চাইলে সেটা যদি অন্য দেশে অবস্থিত অফশোর কোম্পানির চেইনের মাধ্যমে কেনে তাহলে পরিচয়ও গোপন থাকবে। একই সঙ্গে কর কমবে পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে কর মওকুফও হবে। কোন দেশ কিংবা অঞ্চলে অফশোর কোম্পানির বিস্তার বেশি হবে তার নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। কিন্তু সাধারণত যুক্তরাজ্যের কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, সুইজারল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের মতো অঞ্চলগুলোতে এর কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।  বিশ্বব্যাপী ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কর হারাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার।

 

পানামা পেপারসের সঙ্গে পার্থক্য যেখানে

পানামা কেলেঙ্কারির কথা অনেক আগেই ফাঁস হয়েছে। এবার এসেছে প্যানডোরার বাক্সের গুমোর। পানামা পেপারসের সঙ্গে প্যানডোরার পার্থক্য হলো মোসাক ফনসেকা নামে পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান কিছু গোপন কর ফাঁকি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেছিল পানামা পেপারসে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যক্তিত্ব কীভাবে সুকৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছেন তার উল্লেখ ছিল। অফশোর ট্রাস্টের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার পর এক নতুন পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ এর মাধ্যমে আর্থিক তছরুপ, জঙ্গি সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য ও কর ফাঁকি দেওয়া হতো। এবার সে কথাই উল্লেখ করা হয়েছে প্যানডোরা পেপারসে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও ধনকুবেররা নিত্য নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে।  পানামা পেপারসের পর এখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে প্যানডোরার পেপারস।

 

কর ফাঁকি দিয়ে এবার ফেঁসে গেছেন শচীন টেন্ডুলকার

কর ফাঁকির তদন্তমূলক রিপোর্টে জড়িয়ে গেল শচীন টেন্ডুলকারের নাম। তিনি ছাড়াও ভারতের ছয় রাজনীতিবিদের নাম রয়েছে সেই তালিকায়। বিদেশে অ্যাকাউন্ট খুলে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এমন তারকা এবং রাজনীতিবিদদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে প্যানডোরার পেপারস সেখানে রয়েছে ভারতীয় এই ব্যাটিং লিজেন্ডের নাম। ৯১টি দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার নামের সঙ্গে সেই তালিকায় রয়েছে ভারতের এ সাবেক ক্রিকেটারের নাম। যদিও শচীনের আইনজীবীর দাবি, সাবেক ভারত অধিনায়কের সব বিদেশি লেনদেন সম্পূর্ণ বৈধ। বিদেশে শচীন যা যা বিনিয়োগ করেছেন তার পুরো হিসাব কর কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়েছে। তদন্তমূলক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসিআইজের মোট ৬০০ সাংবাদিকের মিলিত প্রয়াসে ১১.৯ মিলিয়ন গোপন নথিপত্র ফাঁস হয়েছে।  যা সবই বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ ও গোপন সম্পদ লেনদেনের তথ্য তুলে ধরেছে।

 

আলোচিত এখন পুতিনের গোপন প্রেমিকা গোপন সম্পদ

একে একে বেরিয়ে আসছে অনেক থলের বিড়াল। এই ধারাবাহিকতায় এসেছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গোপন প্রেমিকার গোপন সম্পদের তথ্য। যা ফাঁস করেছে প্যানডোরা পেপারস। পুতিনের এই প্রেমিকার নাম সেভেৎলানা ক্রিভোনোগিখ। ইউরোপের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মোনাকোর মন্টে কার্লোতে সেভেৎলানার চার ফ্লোরের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ইয়াট। ৪৬ বছর বয়সী সেভেৎলানার ১০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি আছে বলে দাবি করেছে নিউইয়র্ক পোস্ট। সেভেৎলানার নিজ শহর সেন্ট পিটারসবার্গের ডেপুটি মেয়র ছিলেন পুতিন। সেসময় তারা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাদের একটি সন্তানও আছে। তবে পুতিন কখনই এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনেননি। এর পাশাপাশি এবার সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি ফাঁস হয়েছে তা হচ্ছে যুক্তরাজ্যে গোপনে সম্পত্তি কিনতে ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কীভাবে বৈধভাবেই নানা কোম্পানি গঠন করেছেন সেটি।  বিস্তারিতভাবে প্যানডোরার পেপারসে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

 

রেহাই পাচ্ছেন না বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি

রেহাই পাচ্ছেন না বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা। প্রায় ১০০টির বেশি দেশের মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, মিলিটারি জেনারেলসহ ৩০০-এর বেশি কর্মকর্তার হাঁড়ির খবরও রয়েছে প্যানডোরার পেপারসে। এতে রয়েছে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বৈশ্বিক কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাগুলো। লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তাঁর স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারের ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ডের কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য প্যানডোরার নথিতে এসেছে। তালিকায় আছেন জর্ডানের বাদশাহ। তিনি গোপনে মালিবু এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন এবং লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে আটটি সম্পত্তি কিনেছেন। ফাঁস হওয়া নথিতে রয়েছে আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন অলিয়েভ পরিবারের দুর্নীতি। এ ছাড়াও অন্যদের মধ্যে আছেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তাঁর পরিবারের ছয় সদস্য, যাদের অফশোর কোম্পানি আছে।  গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তালিকায় আরও আছেন সাইপ্রাস এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

 

১০০ বিলিয়নিয়ারের তথ্য তাদের শেল কোম্পানি

প্যানডোরা পেপারসে ১০০ বিলিয়নিয়ারের তথ্য এসেছে তাদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী নেতা, রক তারকা, বিনোদন জগতের তারকা। এদের অনেকের রয়েছে শেল কোম্পানি। এসব বিলিয়নিয়ার সম্পদ গড়েছেন, ইয়ট কিনেছেন, এমনকি পেইন্টিংও কিনেছেন। এই শেল কোম্পানি হচ্ছে একটি বৈধ ব্যবসার খোলস। মূল অর্থের মালিক কে, তা গোপন রাখার পাশাপাশি ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা করাই এ ধরনের কোম্পানির কাজ। সাধারণত আসল মালিকের নাম এসব কোম্পানির কোনো কাগজে থাকে না। শেয়ার মালিকদের মধ্যে থাকেন আইনজীবী ও অ্যাকাউনটেন্টরা। কখনো কখনো মালিকের অফিস সহকারীও এসব শেল কোম্পানির পরিচালক বনে যান। এখন গ্রিক উপকথায় বিশ্বের প্রথম মানবী প্যানডোরার বাক্সর মতোই এক এক করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিশ্বের প্রভাবশালীদের গোপন সম্পদের খবর। সাত বছর ধরে ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস এবং লাক্সলিকসের প্রতিবেদনে অনেকের গোপন সম্পদের অনেকটাই ফাঁস করে।  ২০১৬ সালে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির পর বলা হয়েছিল- ল’ ফার্ম মোসাক ফনসেকার কোটি নথি ফাঁস ‘গল্পের অর্ধেকটা’ মাত্র।

 

তালিকায় আরও রয়েছেন যারা

এই তালিকায় আরও রয়েছেন ব্রাজিলের কৃষিমন্ত্রী ব্লাইরো বোর্জেস মাজ, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ওয়েসলি কে ক্লার্ক, উগান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যাম কাহাম্বা কুতেসা, অস্ট্রিয়ার সাবেক চ্যান্সেলর আলফ্রেড গুজেনবাওয়ার, সৌদি আরবের সাবেক উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালেদ বিন সুলতান বিন আবদুল আজিজ, মন্টেনেগ্রোর সাবেক নেতা মিলো জুকানোভিচের বোন আনা কোলারেভিচ, ইরাকের সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য মুধার গাসান শওকত, ইউক্রেনের সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য আন্তন প্রিগোদস্কি, কেনিয়ার সাবেক কৃষিমন্ত্রী স্যালি কোসগেই,  কাজাখস্তানের সাবেক বাণিজ্য ও জ্বালানি মন্ত্রী মুখতার আবলিয়াজভসহ অনেকে।

 

প্যানডোরার পেপারসে যা উল্লেখ থাকে

প্যানডোরার পেপারস ঘটনায় ওলটপালট এখন অনেক কিছুই। এই পেপারসে উল্লেখ থাকে কীভাবে ধনী, বিখ্যাত ব্যক্তিরা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেক ধরনের ট্রাস্ট তৈরি করেন। তার মাধ্যমেই কর ফাঁকি দেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই এ ধরনের একাধিক ব্যক্তি তদন্তকারী সংস্থার নজরে রয়েছেন। বিভিন্ন দেশও ব্যবস্থা নিতে প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাস্ট তৈরি করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবানরা কর ফাঁকি দেন তা উল্লেখ থাকে প্যানডোরা পেপারসে।  নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করে যাতে কর ফাঁকি দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যেই এই ট্রাস্ট তৈরি করা হয়।

 

ব্রিটিশ গোপন নথি বাস স্টপেজে!

সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা আলোচিত হয়েছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপকূল অতিক্রমকারী ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার ডিফেন্ডার-এর তথ্য সংবলিত দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোপন নথি কেন্টের একটি বাস স্টপেজে পাওয়া গেছে। এসব নথির একটিতে ক্রিমিয়া উপকূল অতিক্রমের সময় রাশিয়া সম্ভাব্য কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে তা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য একটি নথিতে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেশটিতে সম্ভাব্য ব্রিটিশ সেনা উপস্থিতির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।  ব্রিটিশ সরকার বলছে, গোপন নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

সর্বশেষ খবর