বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নির্বাসিত যত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

রণক ইকরাম

নির্বাসিত যত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

যে কোনো মানুষের কাছেই মা-মাটি আর মানুষের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একটি মানুষকে যখন নিজের দেশ থেকেই বিতাড়িত করা হয়, তখন এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। বিশেষত একজন সৃজনশীল মানুষ কিংবা রাজনৈতিক নেতা যাকে তার মুক্তমত প্রকাশ কিংবা সামাজিক চেতনা বদলানোর চেষ্টা থেকে বিরত রাখতেই নির্বাসনে পাঠানো হয়। নির্বাসনের এই রীতি সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে।  সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি বহু বিখ্যাত মানুষ নিজের জন্মভূমি ও দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন।  ঐতিহাসিক এরকম কিছু নির্বাসনের ঘটনা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন-

 

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত সেনাপতি ও সম্রাট। ইউরোপীয় ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। তখন ফরাসি বিপ্লব তুঙ্গে। ফরাসি বিপ্লবে তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হন। তাঁর যুদ্ধকৌশল সবার নজর কাড়ে। নেপোলিয়ন তখন একজন জেনারেল। যোদ্ধা নেপোলিয়নের উত্থান সে সময়। তিনি ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। এ ছাড়াও শাসন করেছেন ইতালি। তাঁর রাজত্বকালেই ফ্রান্স ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাঁকে বলা হয় ‘ফরাসি বিপ্লবের শিশু’। দিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নির্বাসন তো ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ফরাসি সম্রাট  নেপোলিয়নকে ১৮১৩ সালে এলবা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এখানে কিছু দিন রাখার পর তাঁকে পুনরায় নির্বাসনে পাঠানো হয় সেন্ট  হেলেনা দ্বীপে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই নির্বাসিত দিনাতিপাত করেছিলেন এই দিগি¦জয়ী বীর। সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত অবস্থায় ১৮২১ সালের ৫ মে মারা যান নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নেপোলিয়নের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল, পাকস্থলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান তিনি। তবে সব পাল্টে যায় যখন সামনে আসে নতুন তথ্য। মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে নেপোলিয়ন একটি ইচ্ছাপত্র (উইল) লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘সময়ের আগেই মারা যাচ্ছি আমি, আমাকে হত্যা করেছে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের গুপ্তহত্যাকারীরা।’ ধারণা করা হয়, নেপোলিয়নকে খুবই পরিকল্পিতভাবে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। মৃত্যুর ১৯ বছর পর ১৮৪০ সালে প্যারিসে মর্যাদাপূর্ণ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য নেপোলিয়নের মরদেহ কবর থেকে তোলা হয়েছিল। ওই সময় নেপোলিয়নের মরদেহ তুলনামূলক বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। কিছু বিজ্ঞানী বলে থাকেন, বিষ হিসেবে আর্সেনিক প্রয়োগের কারণেই নেপোলিয়নের মরদেহে নাকি স্বাভাবিক মাত্রায় পচন ধরেনি। তবে বছরের পর বছর ধরে নেপোলিয়নের মৃত্যুরহস্য নিয়ে  আলোচনা চললেও রহস্যের জট খোলেনি কখনই।

 

নেলসন ম্যান্ডেলা

দীর্ঘ সময় নির্বাসিত ছিলেন তবুও বর্ণবাদের সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি দক্ষিণ আফ্রিকার এই নেতা...

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাঁকে আদর করে ‘মাদিবা’ নামে ডাকে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর আগে তিনি অংশ নেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদবিরোধী নেতা নির্বাসনের আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে সশস্ত্র বিপ্লবের অভিযোগে রোবেন দ্বীপের কারাগারে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এর পরও বর্ণবাদের সঙ্গে আপস করেননি তিনি। অবশেষে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হন তিনি। এর পরও তাঁর বর্ণবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে। একই ধারাবাহিকতায় সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। কারাগারের  একটি প্রকোষ্ঠে ২৭ বছরের নির্বাসনে থেকেও অহিংসতার নিদর্শন দেখিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে  জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন তিনি।

 

তিব্বতের দালাইলামা

দালাইলামা তিব্বতের আধ্যাত্মিক প্রধান। তিনিই তিব্বতের শাসনতন্ত্রের শীর্ষ পদাধিকারী। তিব্বতিদের বিশ্বাস অনুসারে দালাইলামা করুণাময় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের অবতার। তিনি তিব্বতে রাজকীয় মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। বর্তমান চতুর্দশ দালাইলামা হলেন তেনজিন গিয়াৎসু। চীন কর্তৃক তিব্বত অধিগৃহীত হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে চতুর্দশ দালাইলামা তাঁর কিছু অনুগামীসহ গোপনে দেশত্যাগ করে ভারতে আগমন করেন এবং সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি তিব্বতে শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছেন। বর্তমান দালাইলামার জন্ম তিব্বতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আমদো প্রদেশের তাকসার গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে। সে দেশের বর্ষীয়ান ধর্মীয় নেতারা দুই বছর বয়সী এই শিশুর মধ্যে দালাইলামা এবং দেশের প্রশাসক হওয়ার মতো লক্ষণ খুঁজে পেলে তাঁকে প্রাথমিকভাবে দালাইলামা নির্বাচন করেন। দালাইলামার পারিবারিক নাম তেনজিন গিয়াৎসু। এরপর বর্ষীয়ান ধর্মীয় নেতাদের তত্ত্বাবধানে বৌদ্ধ আশ্রমে রেখে তাঁর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি বৌদ্ধ দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব, শান্ত সৌম্য মূর্তি, সদা স্মিত হাস্য বদন, মুখে শান্তি ও অহিংসার বারতা প্রভৃতি কারণে তিনি এখন শুধু তিব্বতিদের ধর্মগুরু নন, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সমীহ জাগানো এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি এ পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশ এক বা একাধিকবার চষে বেড়িয়েছেন। সেই যে ১৯৬৭ সালে বিদেশ ভ্রমণের সূচনা করেছিলেন অদ্যাবধি তা বিদ্যমান। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে তিনি সচরাচর মিলিত হন বা কখনো খোশগল্পে মেতে ওঠেন। এ ছাড়া বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আমন্ত্রণে বিভিন্ন সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। নানা দেশের জাঁদরেল বিজ্ঞানী-গবেষকদের সেমিনারেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদানে তাঁকে দেখা যায়।  কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও প্রদান করা হয়।

 

এডওয়ার্ড স্নোডেন

লাখো সাধারণ মানুষের ওপর মার্কিন গোয়েন্দাগিরির তথ্য ফাঁস করেন ফেরারি এডওয়ার্ড স্নোডেন। আমেরিকান এই যুবক মোটা বেতনের চাকরি, সুন্দরী মেয়ে বন্ধু এবং আয়েশি জীবন ছেড়ে স্বদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলা করেছে, তাঁর দেশের রাজনীতিক ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। আর তা হয়েছিল এ জন্য যে, তিনি আমেরিকার মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) এমন সব কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য তথ্য ফাঁস করেছেন, যা করার অধিকার ওই প্রতিষ্ঠানের নেই। মস্কো নির্বাসনে তাঁর জীবন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে বারবার নানা দেশে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন তিনি।  সবশেষ মস্কোয় রাজনৈতিক আশ্রয় পান স্নোডেন।

 

সালমান রুশদি

কাশ্মীরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান সালমান রুশদি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ নেন। কাজের ফাঁকে লেখেন উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’। বুকার জয় করে সেই বই। লেখক খ্যাতি আসে তাঁর জীবনে। ম্যাজিক রিয়েলিজম ও পোস্টকলোনিয়ালিজম নিয়েই তাঁর বেশির ভাগ লেখা। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বা ‘শয়তানের বাণী’ গোটা বিশ্ব তোলপাড় করে তোলে। ১৯৮৮ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই লেখকের স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশিত হয়। এটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে। বইটি  পোড়ানো হয় এবং বইয়ের দোকানও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুলিশি হেফাজতে প্রেরণ করে।  এরপর সেখান থেকে তিনি নিউইয়র্কে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।

 

অ্যারিস্টটল

প্রাচীন পৃথিবীর যে কজন ব্যক্তি সম্পর্কে না জানলেই নয় তাদের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল একজন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় তাঁর বিস্ময়কর অবদান তাঁকে পরিণত করেছে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্বে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে তাঁর সাবেক ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর মৃত্যুর পর এথেন্স থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলেন। সে সময় এথেন্সের বিধানসভা আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারী এন্টিপনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অ্যারিস্টটল-বিরোধী-এথেনিয়ান বিরোধী, ম্যাসেডোনিয়ান-বিরোধী বলে মনে করা হয়েছিল এবং তাই তিনি অনাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ফলে অ্যারিস্টটল আর এথেন্সে ফিরে না এসে তাঁর বাকি জীবন কাটিয়ে দেন চালসিস নগরীতে।  যেখানে ৬৩ বছর বয়সে অ্যারিস্টটল ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি ক্ষতিকারক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

 

লর্ড বায়রন

ইংরেজি সাহিত্যের সর্বকালের সর্বাধিক আলোচিত কবিদের একজন লর্ড বায়রন। ব্যক্তিজীবনে বায়রন ছিলেন প্রচণ্ড অগোছালো। জীবনে কতবার, কতজনের প্রেমে পড়েছেন হিসাব করে বলা মুশকিল। যা এক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায় বিখ্যাত এই কবির জীবনে। লর্ড বায়রন নিজের চারিত্রিক কারণে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। দূর সম্পর্কের এক বোনের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ও অন্যান্য স্ক্যান্ডালের কারণে কবিকে তাঁর নিজের শহর ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।  আর তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তাঁকে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দিতে পারত। এসব কারণে তিনি ইংল্যান্ড থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। একবার লর্ড বায়রনের এক সাবেক প্রেমিকা তাঁর লাগামহীন রোমান্সে বিরক্ত হয়ে জনসমক্ষে বায়রনকে ‘উন্মাদ, মন্দ ও বিপজ্জনক’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

 

ক্যাসানোভা

ক্যাসানোভা শব্দটি ‘বিশ্বপ্রেমিক’ হিসেবে দুনিয়া জুড়ে পরিচিত। ভেনিসের খুব সাধারণ এক পরিবারে তাঁর জন্ম। পুরো নাম গিয়াকোমো জিরোলামো ক্যাসানোভা। ইতিহাসের বিখ্যাত লেখক ও কূটনীতিক জিওকোমো ক্যাসানোভার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইতালিতে। ক্যাসানোভাকে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়েছিল। ১৭৫৬ সালে ভেনিসের  কারাগার থেকে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইউরোপে কিছু দিন নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে আরেকবার দেশে ফিরেন তিনি। কিন্তু এরপর একটি ব্যাঙ্গাত্মক লেখার কারণে আরও একবার সরকারের কোপানলে পড়েন ক্যাসানোভা। এরপর আবারও দেশ ছেড়ে নির্বাসিত জীবনযাপন শুরু করেন তিনি।  তিনি তাঁর ৭৩ বছরের দীর্ঘ জীবনে ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেছেন।

 

ভলতেয়ার

নিজের লেখনীর মাধ্যমে রাজা ও তাঁর আস্থাভাজনদের তীব্র সমালোচনার কারণে দার্শনিক ভলতেয়ারকে খুব কঠিন রকম বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি যখন রাজার বিরুদ্ধে কলম চালিয়েই যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে ইংল্যান্ডে নির্বাসনে পাঠানো হয়। অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ১৭২৬ সালে বিনা বিচারে তাঁকে ইংল্যান্ডে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেখানে তিন বছর নির্বাসনে থাকাকালে তিনি লোক, নিউটন ও ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে দারুণ রকমের একগুঁয়ে ও আদর্শবান ছিলেন তিনি। নিজের মত প্রকাশ ও অন্যান্য বিষয়ে কোনো আপস করেননি। ভলতেয়ারের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল তাঁর অসাধারণ বাকচাতুর্যে ও দার্শনিক ছলাকলায়। নাগরিক স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বিখ্যাত ছিলেন ভলতেয়ার।

 

অস্কার ওয়াইল্ড

অস্কার ওয়াইল্ডের নির্বাসনের ঘটনা অনেকটাই হৃদয়বিদারক। এই আইরিশ কবি ও লেখককে কারাবরণ করতে হয়েছিল এবং সেখানে তিনি আস্তে আস্তে মৃত্যুপথযাত্রীতে পরিণত হন। পরে তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে নাম, ধর্ম পরিবর্তন করে ফ্যান্সের প্যারিসে নির্বাসন গ্রহণ করেন। এই নির্বাসন তাঁর লেখনী ও পরবর্তী জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। অস্কার ওয়াইল্ডের এই নির্বাসন সাহিত্যিকদের নির্বাসনের একটি বড় উদাহরণ। বিখ্যাত এই কবির জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। তিনি বহু ছোট গল্পও রচনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি ফ্রিম্যাসন্স সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ভিক্টোরীয় যুগের লন্ডন শহরে তিনি অন্যতম সফল নাট্যকার হিসেবে পরিচিত হন। তিনি তাঁর চাতুর্যময় নাট্য রচনার মাধ্যমে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তবে এক বিখ্যাত বিচারের রায়ের ফলে তাঁর সাফল্যের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং তাঁকে বড় মাপের অশ্লীলতা এবং সমকামিতার দায়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৪৬ বছর বয়সে আইরিশ এই নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবি প্যারিস শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

 

টি এস এলিয়ট

টি এস এলিয়টের নির্বাসনটিও ছিল তাঁর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। কবি এলিয়ট মূলত নিজস্ব চিন্তা ও ভাবনার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করেন। এই নির্বাসন তাঁর ক্যারিয়ারে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। কারণ নির্বাসনের কারণেই তিনি কবি আজরা পন্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন এবং এর প্রভাব তাঁর পরবর্তী জীবনের সব সৃষ্টিতে পড়েছিল। টি এস এলিয়টের পূর্ণ নাম টমাস স্টার্নস এলিয়ট। মূলত কবি হিসেবেই বিশ্বে তাঁর পরিচিতি। তবে প্রাবন্ধিক, প্রকাশক, নাট্যকার, সাহিত্য ও সমাজ-সমালোচক হিসেবেও খ্যাতি কুড়িয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পচনশীল, ফাটল-ধরা সমাজের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে টি এস এলিয়ট নামের সঙ্গে। নিজস্ব সাহিত্যকর্ম, বিশেষত কবিতায় তৎকালীন মানুষ ও সমাজের  বাস্তব চিত্র পূর্ণাঙ্গরূপে তুলে ধরতে  পেরেছিলেন বলেই তাঁর নাম একটি যুগের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচিত কবি ও লেখক টি এস এলিয়টের জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেন্ট লুইসে।

 

বেনজির ভুট্টো

বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় কেটেছে লন্ডন এবং দুবাইয়ে নির্বাসিত থেকে। নির্বাসনে যাওয়ার আগে তিন বছর তিনি গৃহবন্দী ছিলেন। মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে রাজনৈতিক কারণেই নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে। এর পরও তিনি নিয়মিত ব্রিটেনে নানা লেকচার ও বক্তৃতা প্রদান করার জন্য উপস্থিত হতেন। প্রায় আট বছরের নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ২০০৭ সালের অক্টোবরে করাচিতে ফিরে আসেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। দেশে ফেরার দিনই করাচির বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর নিহত হন বেনজির ভুট্টো। তাঁর মরদেহ দাফন করা হয় নিজ শহর ঘারি খোদা বক্সে পারিবারিক কবরস্থানে।  মৃত্যুর আগ দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বার ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করছিলেন বেনজির।

সর্বশেষ খবর