বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

শতবর্ষের আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণে’ এই অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শতবর্ষের আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাঙালি জাতির গৌরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছে ১০০ বছর। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আলো ছড়িয়ে গত ১ জুলাই শতবর্ষ অতিক্রম করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আজ আয়োজন করা হচ্ছে পূর্তি উৎসবের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আজকের আয়োজনে লিখেছেন- আকতারুজ্জামাননাসিমুল হুদা। ছবি তুলেছেন জয়ীতা রায়

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ১০০ বছরের যাত্রা পূর্ণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পথচলা শুরু করা দেশের উচ্চশিক্ষার এ প্রতিষ্ঠানের বয়স এখন গোটা এক শতাব্দী। কেমন ছিল এ কালভ্রমণ, তা রীতিমতো একটি গবেষণার বিষয়। তবে বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে প্রসিদ্ধ হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদান-অংশগ্রহণের জন্য, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই নাম কুড়িয়েছে রাজনীতির পাতায় আঁচড় ফেলে।

১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণে’ এ অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১২ সালের নাথান কমিশনের ও ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পাস হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯২০’। পরে ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে শতবর্ষী এ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেসময় এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কলকাতার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও হিন্দু নেতারা। এ দাবিতে তারা স্মারকলিপি পেশ, প্রতিবাদ সভা থেকে শুরু করে র‌্যালি পর্যন্ত আয়োজন করেছিলেন।

মাত্র তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক,  ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। বর্তমানে ১৩টি ফ্যাকাল্টি, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট ও ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র ও ২০টি হল ও তিনটি হোস্টেল রয়েছে। নিয়মিত মোট ৩৭ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১ হাজার ৯৯২ জন। এ ছাড়াও অধিভুক্ত ১০৫টি কলেজ ও ইনস্টিটিউটে ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী আছেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অসামান্য অবদান। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ ভূখন্ডের মানুষের অধিকার আদায়ে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক প্রায় সবাই ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মূল্য দিতে হয়েছে চরমভাবে। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন দেশের তরে তাদের প্রাণোৎসর্গ করেন। এ ছাড়াও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার পি জে হার্টগ। এ ছাড়াও পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়।  সম্প্রতি ইলিশ মাছের জিন রহস্য উদঘাটন, শ্যাওলা থেকে ন্যানোফিল্টার ও একটি নতুন  অ্যান্টিবায়োটিক ‘হোমিকরসিন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে।

 

দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি

ড. মো. আখতারুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি। সময়োপযোগী কারিকুলাম ও পাঠক্রম উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে ইনশা আল্লাহ আমরা কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করব। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।

ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ এবং সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূরণ হয়েছে। এ জনপদের অধিবাসীদের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যেসব মহান ব্যক্তি এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের অবদান গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

তিনি বলেন, জ্ঞান আহরণ ও বিভরণের গৌরবগাথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় তিন দশক পরে ডাকসু নির্বাচন জাতির জন্য জ্ঞানদীপ্ত নতুন নেতৃত্ব তৈরির এক সুযোগ করে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় সর্বমহলের ঐকান্তিক সহযোগিতার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ চর্চায় জাতীয় উৎকর্ষ অর্জন অতীব জরুরি।

শতবর্ষে এসে শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ ‘মাস্টার প্ল্যান’ করা হয়েছে। গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম সহায়ক উপাদান জোগান দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণীত এ মাস্টার প্ল্যান আমাদের সার্বিক উন্নয়নের একটি মাইলফলক। শিক্ষার্থীদের আনা হয়েছে স্বাস্থ্য বীমার আওতায়। প্রথমবারের মতো ঢাকাসহ আটটি বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেশনজটের ঝুঁঁকি প্রশমনের লক্ষ্যে ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

উপাচার্য বলেন, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বরাদ্দ প্রত্যাশা করছি এই খাতে। গবেষণা ও উদ্ভাবন দুটি আবর্তন করেই আমাদের সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এগুলোই আমাদের এসডিজি-২০৩০ অর্জনে এবং রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে সাহায্য করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন, এর জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের বিকল্প কিছু নেই।

শিক্ষার্থীদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন ও শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশ নিশ্চিত না হলে বেশিদূর এগোনো যায় না। এ জন্য সরকারসহ অ্যালামনাই, শিল্প ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সবার সঙ্গে আন্তসম্পর্ক থাকা ও সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রাখতে হবে।

মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য পি জে হার্টগসহ যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছেন তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।  শত বর্ষপূর্তি উৎসবের এ মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

 

জাতি গঠনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, একটি জাতির উচ্চশিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, জাতিসত্তার বিকাশ, সাংস্কৃতিক বিকাশসহ জাতির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাঙ্গীণ ভূমিকা রেখে আসছে। জাতি গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন প্রয়োজন বৈশ্বিক মানের শিক্ষা। এর জন্য গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন। গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। আশা করি, আগামীর বাংলাদেশের যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে ও ২০৪১ সাল পর্যন্ত যে রূপকল্প রয়েছে, সেখানে পৌঁছে দিতে শিক্ষা ব্যবস্থার যে রূপান্তরের প্রয়োজন সে রূপান্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দেবে। আশা করি, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রসর হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান কারিকুলামের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে এসে সময়োপযোগী ও বাস্তবতাভিত্তিক করতে হবে। এ জন্য ইতিমধ্যেই একাডেমিক কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি আরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাসহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদির আলোকে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিনির্মাণ করা যায়- সেজন্য সামগ্রিক সহযোগিতা দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির পক্ষ থেকে।

উপ-উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বিভাগ রয়েছে এবং সেগুলোতে যত শিক্ষার্থী রয়েছে প্রকৃতপক্ষে এত বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাস কমিউনিকেশনে গ্যাপ থেকে যায়। বিভাগভিত্তিক শিক্ষার্থী যেন আর না বাড়ে, এটি একটি চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় নিরাপত্তার সংকট ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শব্দদূষণসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পাঠ ও গবেষণায় মনোনিবেশ সম্ভব হয় না।  এ বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

 

অধিকার আদায়ে ঢাবি শিক্ষার্থীরা

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র, ভাষা ও দেশের মানুষের যে কোনো অধিকার আদায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিলেন সোচ্চার। দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনন্য। দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাতিকে আলোর মশাল হয়ে পথ দেখিয়েছে। বাংলা ভাষা বলার অধিকার রক্ষার আন্দোলন থেকে এই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের পেছনের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই যৌক্তিক আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিয়েছে সামনের সারিতে থেকে।

১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় থেকেই বাংলা ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সেই ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শিক্ষার্থীরা জমায়েত হয়। সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। ভাষার দাবিতে নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার এমন নজির সারা বিশ্বে বিরল।

এরই পথ ধরে এগিয়ে চলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ’৬৬-এর ছয় দফা, আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ সব আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অগ্রগামী। বৈষম্য-অনাচার-শোষণ-অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার যে ডাক সে সময় বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, তার সেই আদর্শকে ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এরই পরিণতিতে ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায়।  নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। সাম্প্রতিক সময় অবধি নানান দাবিতে আন্দোলনে সারা বছর মুখর থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।


হল নয় কার্জন হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামটি শুনলেই শিল্পীর পটে আঁকা যে কয়টি চিত্র মানসপটে ভেসে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্যরীতির এক দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ- কার্জন হল। তবে নামে হল শব্দটি থাকলেও এটি কিন্তু শিক্ষার্থীদের থাকার হল নয়, আদতে পরীক্ষা-ক্লাস সবই হয়। লালচে-খয়েরি  রঙের এ স্থাপনা দেশের সবার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পোস্টার পিকচার’ হিসেবে পরিচিত।

১৯০৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায় তার নামেই এর নামকরণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে টাউন হল হিসেবে নির্মিত হলেও বঙ্গভঙ্গ রদের পর এটি ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সুদৃশ্য এ ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

ইতিহাসের এ বরপুত্র যেমন মনোরম স্থাপত্যশৈলীর অনন্য উদাহরণ, তেমনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য এক মোহনীয় আবেগের নাম। প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো সমাবর্তনে কার্জন হল প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের আবেগঘন বিচরণ স্মরণ করিয়ে দেয় এ কার্জন হল কতটা আপন করে নেয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থী ছাড়াও এ ব্রিটিশ স্থাপত্যের সৌন্দর্যে ডুব দিতে সবসময়ই এ প্রাঙ্গণে আনাগোনা থাকে অনেক দর্শনার্থীর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা এ স্থাপত্য শুধু ইট-পাথরের একটি ভবন নয়, বরং এটি যেন বাংলার ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন,  ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ ভবন যেন ঐক্যের প্রতীক, প্রতিবাদের ঝান্ডা।

গোটা পৃথিবীতে হয়তো এমন ভবন পাওয়া দুষ্করই হবে যার স্থাপত্যশৈলী একত্র করেছে দুটি ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশের রীতিকে, যা একই সঙ্গে আকর্ষণ করে হাজারও দর্শনার্থী, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মনে জন্ম দেয় উচ্চশিক্ষার স্পৃহা; প্রেমের আঁধার এ কার্জনেই জন্ম নেয় সংগ্রাম, স্বাধীনতা।


অনেক আন্দোলনের অলিখিত  কেন্দ্র মধুর ক্যান্টিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ পেরিয়ে কলা ভবনের কোনার রেস্তোরাঁ, মধুর ক্যান্টিন। নামকেও ছাড়িয়ে গেছে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই রেস্তোরাঁতেই জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম-কাহিনি। মধুর ক্যান্টিন নামটির সঙ্গে যে মানুষটি জড়িত তিনিও ইতিহাসের অংশ, মধুসূদন দে। মধুর ক্যান্টিনের মালিক ছিলেন তিনি। পিতামহের হাতে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে, তার পিতা আদিত্য চন্দ্রের মৃত্যুর পর। সমসাময়িক বাঘা বাঘা ছাত্রনেতাদের প্রিয় মানুষ, বিশ্বাসভাজন ছিলেন সেসময়ের মধুদা। এরই মূল্য বোধ হয় দিয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। ১৯৭১ সালে তাকে সপরিবারে হত্যা করে পাকসেনারা।

’৪৮-এর ভাষা আন্দোলন, ’৪৯-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ’৫২-এর আগুনঝরা দিন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী যুদ্ধ, ১৯৫৮-’৬০ সালের প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এ সবকিছুর সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনের নাম জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। উত্তাল সে সময়ের নানা সিদ্ধান্ত হতো মধুর ক্যান্টিনে বসেই। অনেক আন্দোলনের অলিখিত হেড-কোয়ার্টার এই মধুর ক্যান্টিন।

এত বছর পেরিয়েও মধুর ক্যান্টিনের সেই রাজনৈতিক আবেদন এতটুকু কমেনি। আজ ডান-বাম ছাত্রসংগঠনের স্লোগানে-বৈঠকে মুখর থাকে মধুর ক্যান্টিন। বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছেও এটি আড্ডা দেওয়ার অন্যতম প্রিয় জায়গা। আড্ডা দিতে দিতে মধুর ক্যান্টিনের ‘বাচ্চা সাইজে’র মিষ্টি, চিনি বেশি রং-চা, সাদামাঠা সমুচা-শিঙ্গাড়াও হয়ে ওঠে অমৃত।

মধুর ক্যান্টিন নিয়ে একটি মজার তথ্য দেওয়া যাক। মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের ভিড় ছিল সব সময়। আসত উঠতি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড়। অনেকেই দাম মেটাতেন, কেউ কেউ লিখে রাখতে বলতেন। মধুদার সেই খাতায় স্থান করে নিয়েছিলেন তৎকালীন বড় বড় রাজনীতিবিদরা।  ওই খাতায় এককালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান থেকে শুরু করে নাম ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও।

 

শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধাও কম নয়

যে যাই বলুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার তুলনামূলক ভালো একটি পরিবেশ পান ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকদের সাহচর্য, বিশাল দুটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি, সাইবার সেন্টার, বিনামূল্যে ওয়াই-ফাই সুবিধা; শিক্ষার্থীরা চাইলেই খুব সহজে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারেন। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয় ৩৫০টি ট্রাস্ট ফান্ড। কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণপদক নেওয়ার সুযোগ আছে শিক্ষার্থীদের জন্য। অনুষদগুলোতে রয়েছে ডিনস অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র টিএসসিতে বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, বাঁধন, বিতর্ক সংসদ, সাংস্কৃতিক সংসদ, ফিল্ম সোসাইটি, ট্যুরিস্ট সোসাইটি, আইটি সোসাইটির মতো প্রায় ৩০টির বেশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সংগঠন রয়েছে। নিজেকে দক্ষ-প্রাণবন্ত সাংগঠনিক মানসিকতার করে গড়ে তুলতে এসব সংগঠনের সহায়তা নেন শিক্ষার্থীরা। মানসিক সেবা নেওয়ার ব্যবস্থাও আছে এখানে।

এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য আছে জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুলসহ ইনডোর ও আউটডোর খেলাধুলার নানান ব্যবস্থা। হলগুলোর তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর আয়োজিত হয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এসবে কৃতিত্ব দেখানোর সুযোগ থাকে শিক্ষার্থীদের।

বিগত বছরে ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক ই-মেইল সরবরাহ করেছে প্রশাসন। এনেছে স্বাস্থ্যবীমার আওতায়। বার্ষিক মাত্র ২৭০ টাকার বিনিময়ে ৩০টি হাসপাতালে বছরে ৫০ হাজার টাকা সমপরিমাণের চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে থাকার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। গণরুমের অত্যাচারে খানিকটা মলিন হলেও হলজীবনও কম আনন্দের নয়। একজন ছাত্র যে কক্ষে থাকছেন, সেই কক্ষেই হয়তো থাকতেন হুমায়ুন আহমেদ।

ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগের কথা বোধ হয় আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঠাঁই করে নেওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কম গৌরবের নয়।  প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সারা দেশের নেতৃত্বস্থানীয় জায়গাগুলো দখল করে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্ক বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার স্থল।

সর্বশেষ খবর