সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

‘দাবায়া রাখতে পারবা না...’

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু

‘দাবায়া রাখতে পারবা না...’

একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে / লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে / ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : ‘কখন আসবে কবি?’ -নির্মলেন্দু গুণ

৭ই মার্চ, ১৯৭১। রাজনীতির কবি সেদিন এসেছিলেন, শুনিয়েছিলেন তার অমর কবিতা। এদিনই ছাত্ররা উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। সকাল ১০টা। সবাই তাকিয়ে আছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। এদিন একদিকে যেমন প্রিয় নেতার মুখ থেকে সবাই স্বাধীনতার ডাক শুনতে উদগ্রিব। অন্যদিকে এদিনও ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত আমেরিকা-পাকিস্তান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন ব্লিৎসের মতলব আঁটছেন। বাঙালির ভাগ্য তখন নির্ভর করছে রেসকোর্স ময়দানে। প্রিয় নেতা তখনো চিন্তাগ্রস্ত।

মুহূর্তটির বর্ণনা কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর লেখা বইয়ে এভাবে দিয়েছেন- ‘‘আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করেছো। কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো।’’

বেলা আড়াইটা। বঙ্গবন্ধুর সহকারী হাজী মোহাম্মদ গোলাম মোরশেদ গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে বসা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।  পেছনে আরও দুজন- মোস্তফা ও মহিউদ্দিন। সতর্কতার জন্য ভিন্ন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। রাজধানীর সাতরাস্তা এলাকা দিয়ে গাড়ি চালাতে বললেন বঙ্গবন্ধু। মাঝপথে আসার পর হঠাৎ করেই কৌতূহলবশত মোরশেদ জিজ্ঞেস করেলেন- ‘আজ ভাষণে কী বলবেন’? বঙ্গবন্ধুর সহজ উত্তর- ‘দেখি আল্লাহ মুখ দিয়ে কী বের করে।’

এর পরের ইতিহাস আমাদের কারোই অগোচরে নেই। রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সম্মুখে রাজনীতির এই অমর কবি পাঠ করলেন তার সেই মহাকাব্যিক শ্লোক-‘ভাইয়েরা আমার, .... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

ভাষণ শুরু হয় বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে। শেষ হয় বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে। ভাষণের স্থায়িত্ব ১৮ মিনিট। এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। হয়তো এ কারণেই এই ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন, যে কোনো সময় শত্রু ঘরে হানা দেবে। তাই নিজেও সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন প্রস্তুত ছিলেন। আবুল মনসুর লিখেছেন, ৭ই মার্চের ভাষণের পরে ওইদিন রাতেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে বসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু এখন থেকে একসঙ্গে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু গম্ভীর কণ্ঠে আরও বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সে জন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’ এভাবেই ৭ মার্চ ভাষণ-পরবর্তী ভাষণের প্রভাব অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বাঙালির জীবনে হঠাৎ করেই ৭ই মার্চ আসেনি। দীর্ঘ এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে এসেছিল এই দিবস। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ।

পাকিস্তান সরকার ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ভাষণটি প্রচার করার অনুমতি দেয়নি। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তৎকালীন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র করপোরেশন চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক একইসঙ্গে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনে সংসদ সদস্য এম আবুল খায়ের ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন। তাদের সঙ্গে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন। পরে, অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের একটি অনুলিপি শেখ মুজিবকে হস্তান্তর করা হয় এবং অডিওর একটি অনুলিপি ভারতে পাঠানো হয়। সঙ্গে অডিওর ৩০০০ অনুলিপি করে তা সারা বিশ্বে ভারতীয় রেকর্ড লেবেল এইচএমভি রেকর্ডস দ্বারা বিতরণ করা হয়।

কী ছিল না ১৯ মিনিটের সেই ছোট্ট ভাষণে? এখানে যেমন বাঙালির শত বছরের বঞ্চনার ইতিহাস ছিল, তেমনি ছিল আশা-প্রত্যাশা ও অধিকার আদায়ের গল্প। ছিল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ, আর্থ-সামাজিক মুক্তির অনন্য দলিল ও জোরালো যুক্তির উপস্থিতি। সব মিলিয়েই ভাষণটি মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব, গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা এবং নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার অর্জনের প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষণ করতে বোঝা যাবে, বঙ্গবন্ধু ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে ভাষণ শুরু করেছিলেন এবং শুরুতে সবাইকে ‘আপনি’ (আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন) বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর ভাষণের শেষে উপস্থিত লাখো মানুষকে এত আপন করে নিয়েছিলেন যে, সবাইকে ‘তুমি’ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। ... তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। ... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এর ৭ই মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২-এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তাহলে কী ঘটত?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিশ্বকে আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চেয়েছিলাম, তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করুক।’ অর্থাৎ ৭ মার্চের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালিকে প্রস্তুত করেছিলেন।

পরোক্ষ এই স্বাধীনতার ঘোষণাকে যদি আমরা চিত্রে রূপায়ণ করি। তবে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের উত্তাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমার চোখে এভাবেই ভেসে উঠে, মাতৃভূমি আজ শত্রু দ্বারা আক্রান্ত। দেশ স্বাধীন করার বাসনা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। রণক্ষেত্রও প্রস্তুত। সৈন্যরা সমবেত রণভূমিতে। তাদের সামনে প্রতিপক্ষের দুর্গ। সেই দুর্গকে ভেদ করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে হবে। অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে গেছে সৈন্যরা। সবাই তাকিয়ে আছে রাজনের ইশারার দিকে। অপেক্ষা শুধু অন্তিম নির্দেশের। পুরো এই প্রক্রিয়াকে প্রস্তুত করার অন্তিম নির্দেশই ছিল ৭ই মার্চ। অস্ত্রবিহীন, যুদ্ধজ্ঞানহীন একটি সহজ-সরল জাতির মনে ‘স্বাধীনতা’ নামক যে ক্ষুধা জাগিয়ে তোলার নাম ৭ই মার্চ। মাটির মতোই এদেশের মানুষের মন। সেই উর্বর মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করার নামই ৭ই মার্চ।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ই মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত মাত্র ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ আজও পর্যন্ত ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম সেরা সম্পদ, শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ বইয়েও স্থান পেয়েছে এই ভাষণ। পাঁচ বছর আগে ইউনেস্কো যখন এই ভাষণকে বিশ্বে প্রামাণিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন একে ‘ইতিহাসের প্রতিশোধ’ হিসেবে তুলনা করেছিলেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘ সময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।

এখন পর্যন্ত মোট ১৩টি ভাষায় এই ভাষণ অনূদিত হয়েছে। ১৩তম হিসেবে মাহাতো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর কুড়মালি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়, যা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় প্রথম অনুবাদ। এই ভাষণসহ বিভিন্ন কারণে নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

৭ই মার্চের ভাষণ যে প্রজ্ঞায় পূর্ণ, তা খোদ পাকিস্তানও স্বীকার করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এভাবে বলেছেন, ‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’

বাঙালি অদম্য জাতি। দমে যাওয়ার ইচ্ছে এই জাতির ধাতে নেই। দমে যায়ওনি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’ ভাষণে সাড়া দিয়ে ঠিকই ‘স্বাধীনতা’ এনে দিয়েছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত বাঙালি পেয়েছে সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত স্বাদ। ৭ই মার্চের মূল চেতনা এখানেই।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য উপদেষ্টা পরিষদ এবং চেয়ারম্যান, প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর