সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

পাকিস্তানি শাসকদের ভয়াবহ পরিণতি

পাকিস্তানি শাসকদের ভয়াবহ পরিণতি

করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৭৫ বছর কেটেছে তাদের। এ সময়ে ক্ষমতায় বসেছেন ২২ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো শাসকই ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দেশটিতে বারবার এসেছে সামরিক শাসন।  সামরিক অভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। কখনো কোনো সরকারপ্রধানকে পরতে হয়েছে ফাঁসির দড়ি, কখনোবা ঘাতকের গুলি-বোমা কিংবা সাজানো বিমান দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু। আবার কখনো বিরোধী দলের অনাস্থার মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানি শাসকদের ভয়াবহ পরিণতির সে ইতিহাস জানাচ্ছেন - তানভীর আহমেদ

 

তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল সিআইএ

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৭ সালে তিনি এ পদে বসেন। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র চার বছর। পঞ্চাশের দশকের কথা। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানের তেল-সংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সঙ্গে তখন লিয়াকত আলী খানের সম্পর্ক ছিল দারুণ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। উল্টো পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। তারা কাজে লাগায় পাশের দেশ আফগানিস্তানকে। সিআইএর পরিকল্পনায় রাজি হয় তারা। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় ভাষণ দিতে ওঠেন লিয়াকত আলী খান।  সে সময় সৈয়দ আকবর নামের এক আততায়ী লিয়াকত আলী খানের বুক বরাবর দুটি গুলি করেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি লিয়াকত আলী খানকে। আলোচিত এই হত্যাকান্ডের ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত এক গোপন নথি থেকে পুরো ঘটনা জানতে পারে বিশ্ববাসী।


 

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। এ ঘটনার মাত্র ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং নিজেই প্রেসিডেন্টের পদে বসেন। লিয়াকত আলী খান যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে যে ভুল করেছিলেন, তা ভালোই মনে রেখেছিলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতবিরোধী কট্টর মনোভাব ছিল তাঁর। তিনি পেশোয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় একটি বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন।  সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনীর বৈমানিকরা বিমান চালাতেন। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার ভারতের সঙ্গে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ তাসখন্দ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিষ্পন্ন হয়। যুদ্ধের পরিণতিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।  তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচার, জনগণের অধিকার লুণ্ঠন ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৭৪ সালে তিনি দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন। 


 

গণহত্যার পর যুদ্ধে পরাজয় আত্মসমর্পণ করে বিদায় নেন

আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক নিযুক্ত হন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যার পথে হাঁটেন তিনি। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি তিনি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার পর সেনাবাহিনী সদর দফতরে ইয়াহিয়া খান এক সভায় সামরিক হামলার বিষয়ে নির্দেশ দেন। পরিকল্পনা হয় ২৫ মার্চ কালরাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছিল নয় মাস। এই মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করে। পরিণতিতে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া বুঝে যান, যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত। তাই তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজিকে ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। এর দুই দিন পর তিনি অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ বিষয়ক দলিলে স্বাক্ষর করেন।  ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়ে দিয়ে যান।


 

রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত চরিত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানের জায়গায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৩ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বস্তিতে ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, ভুট্টোর ‘একনায়কতান্ত্রিক’ আচরণের কারণে পাকিস্তানজুড়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও দুর্বল হতে থাকে। এই সুযোগে ১৯৭৮ সালে ভুট্টোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। অথচ জুলফিকার আলী ভুট্টোই তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।  শুধু ক্ষমতা হারানোই নয়, ভুট্টোর জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় দন্ড। ১৯৭৪ সালে এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বাবাকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন ভুট্টো। রায়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল মাঝরাতে রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে ভুট্টোর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। 


 

আকাশে ওড়ার পরই বিধ্বস্ত হয় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান

জেনারেল জিয়াউল হকের পরিণতিও ছিল ভয়াবহ। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন এই জেনারেল। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন তিনি। ক্ষমতায় ছিলেন ১০ বছর। ১৯৮৮ সালের ৭ আগস্ট রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন তিনি। পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসমও তাঁর সঙ্গে একই উড়োজাহাজে ছিলেন। স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে বাহওয়ালপুর থেকে আকাশে ওড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান। এতে উড়োজাহাজে থাকা ৩১ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। এই দুর্ঘটনা ঘিরে শুরু থেকেই রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে দাবি করেন পাকিস্তানের সিনেটর মুশাহিদ হোসেইন।  পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, জিয়াউল হককে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করেছিল।


 

নির্বাচনী জনসভায় গুলি, আত্মঘাতী বোমা হামলায় খুন হন

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো। বেনজির ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন। রাজনীতির মাঠে নেমে তাঁকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। তিনিও ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে তিনি বরখাস্ত হন। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সেবারও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। উৎখাত হন তিন বছর পরেই। এরপর একপ্রকার স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান বেনজির। ২০০৭ সালের অক্টোবরে পুনরায় পাকিস্তানে ফেরেন তিনি। তাঁর দেশে ফেরার দিনই করাচিতে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। সৌভাগ্যবশত ওই ঘটনায় বেঁচে যান বেনজির। কিন্তু দুই মাস পর সৌভাগ্য আর সঙ্গ দেয়নি তাঁকে। লিয়াকত আলী খানকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, রাওয়ালপিন্ডির  সেই এলাকাতেই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বেনজির। হামলাকারী প্রথমে তাঁর ঘাড়ে গুলি করে এবং পরে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।


 

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত, এখন দেশছাড়া

তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তখন ক্ষমতা ছাড়তে হয় আড়াই বছরের মাথায়। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে সেবারও ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের কারাদন্ড দেয় আদালত। একই মামলায় তাঁর মেয়ে মরিয়ম শরিফকেও সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। নওয়াজ শরিফ জেলে যান। পরে চিকিৎসার অজুহাতে দেশ ছাড়েন তিনি। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। আদালতের রায়ে তাঁকে দলীয় প্রধানের পদও ছাড়তে হয়।  ইমরান খানের বিদায়ের পর নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন- এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।


 

রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে এখন দেশছাড়া

সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার প্রায় এক বছর পর পারভেজ মোশাররফ নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কারিগর আল-কায়েদার তৎকালীন নেতা ওসামা বিন লাদেন দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে বসবাস করছেন এবং তার অবস্থান সেনা একাডেমি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তখন মোশাররফের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জেনারেল মোশাররফ দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকতে চেয়েছিলেন। মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যায় তাঁর দল। তার ছয় মাস পর অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ করেন তিনি। পাকিস্তানে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। আদালত মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেও পরে তা বাতিল হয়।  মোশাররফ ২০১৬ সালের মার্চে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তাঁকে দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। জেনারেল মোশাররফকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করার ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

 


বারবার সামরিক শাসন

পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই ক্ষমতার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি

লিয়াকত আলী খান : চার বছর

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

খাজা নাজিমুদ্দিন : দুই বছরের কম

১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল নাজিমুদ্দিনকে গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।

মোহাম্মদ আলী বগুড়া : দুই বছর

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা তাঁকে সরিয়ে দেন।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী : এক বছর

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দলের সদস্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র নিয়ে স্পষ্টবাদী হওয়ার কারণে চাপের মুখে পড়েন তিনি। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : এক বছর

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন।

ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার : দুই মাস

১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র দুই মাস।

ফিরোজ খান নুন : এক বছরের কম

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির সময় নুনকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করেন।

নুরুল আমিন : ১৩ দিন

দায়িত্ব পালনের ১৩ দিনের মাথায় ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর আমিনকে সরিয়ে দেন ইয়াহিয়া খান।

জুলফিকার আলী ভুট্টো : পৌনে চার বছর

জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক তাঁকে কারাবন্দি করেন। ১৯৭৯ সালে ভুট্টোর ফাঁসি হয়।

মুহাম্মদ খান জুনেজো : তিন বছর

১৯৮৮ সালের ২৯ মে জুনেজোর সরকারকে বরখাস্ত করা হয়।

বেনজির ভুট্টো : দুই বছর

১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক খান তাঁকে সরিয়ে দেন।

নওয়াজ শরিফ : তিন বছরের কম

সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান ওয়াহিদ কাকার ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই নওয়াজ শরিফ এবং প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

বেনজির ভুট্টো : তিন বছর

রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে বেনজির ভুট্টো সরকারকে বরখাস্ত করেন।

নওয়াজ শরিফ : দুই বছর

১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।

মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি : ১৯ মাস

জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাঁকে বরখাস্ত করার আগে তিনি মাত্র ১৯ মাস দায়িত্ব পালন করেন।

চৌধুরী সুজাত : দুই মাস

চৌধুরী সুজাত ২০০৪ সালের ৩০ জুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন সুজাত।

শওকত আজিজ : তিন বছর

শওকত আজিজ ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করেন।

ইউসুফ রাজা গিলানি : চার বছর

২০১২ সালে শীর্ষ আদালত অবমাননার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে গিলানিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

রাজা পারভেজ আশরাফ : এক বছরের কম

পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদ শেষ করতে গিলানির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজা পারভেজ আশরাফ।

নওয়াজ শরিফ : চার বছরের বেশি

২০১৭ সালের ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অভিশংসিত হওয়ার আগে তিনি চার বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।

শাহীদ খাকান আব্বাসি : এক বছরের কম

নওয়াজ শরিফকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে শাহীদ খাকান আব্বাসিকে ২১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৩১ মে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কারণ নতুন নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়।

ইমরান খান : ৩ বছরের বেশি

ছিলেন ক্রিকেট লিজেন্ড, হলেন প্রধানমন্ত্রী (আগস্ট ১৮, ২০১৮-এপ্রিল ১০, ২০২২)। জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়ে পদ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রীর।

 


রাতভর নাটকীয়তা পাকিস্তানি পার্লামেন্টে

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করেন স্পিকার আসাদ কাইসার। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব তোলার ওপর জোর দিলেও চার দফায় অধিবেশন মুলতবি করেন তিনি। ইফতার এবং মাগরিবের নামাজের জন্য অধিবেশন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়। তবে শেষ রক্ষা করতে পারেননি স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। পদত্যাগ করে পার্লামেন্ট ছাড়েন তাঁরা দুজন। স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিক। পার্লামেন্টে পাঁচ মিনিট ধরে বেল বাজিয়ে এমপিদের সতর্ক করেন নবনিযুক্ত স্পিকার। এরপর পার্লামেন্টের সব দরজা বন্ধ করে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এরপর আবার দরজা খুলে প্রস্তাবের পক্ষের এমপিদের বাইরে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। নিয়ম অনুযায়ী, ৪ মিনিটের জন্য পার্লামেন্ট মুলতবি করেন। এরপর আবার অধিবেশন শুরু করেন। নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রারে ভোটাররা স্বাক্ষর করার পর সেটির নথি স্পিকারের কাছে পাঠানো হয়। ভোট গণনা শেষে স্থানীয় সময় রাত ১টায় ফল ঘোষণা করেন আয়াজ সাদিক। ইমরান খান শেষবেলায় রাজনৈতিক নাটক জমিয়ে তোলেন। নিজ দলের আইনজীবীদের দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতেই আপিল আবেদন জমা দেওয়ান। কিছু সময় পর জানা যায়, সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ইমরান খান। বিষয়টি নতুন সংশয়ের জন্ম দেয়।  তবে শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটেই নির্ধারিত হয় ইমরান খানের ভাগ্য।

 


ইমরানই প্রথম সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিলেন

পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, দেশটির শাসকদের বিদায় সুখকর ছিল না। কেউ ক্ষমতা হারিয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে, কেউ হয়েছেন খুন।  কাউকে ছাড়তে হয়েছে দেশ। ইমরানই পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হয়নি। ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান খান। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া এ নেতা ৩ বছর ৭ মাস ২৩ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।  পার্লামেন্টের ৩৪২ আসনের মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। ইমরান খানকে পরাজিত করতে বিরোধীদের প্রয়োজন ছিল ১৭২ ভোটের।

সর্বশেষ খবর