রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সিলোন থেকে শ্রীলঙ্কা এখন

এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল অন্যরকম; গৃহযুদ্ধের অবসানে দেশটি যেন উড়ছিল। পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠছিল; আসছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার; যার রোশনাই ছড়াচ্ছিল দোকানপাট আর সড়কে। কিন্তু দশককাল বাদে সেই শ্রীলঙ্কার সড়কে এখন জ্বলছে না বাতি, গাড়ি চালাতে মিলছে না জ্বালানি, ওষুধ ও দ্রব্যমূল্যও এখন আকাশছোঁয়া। বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারীর খাঁড়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়েছে এশিয়ার সমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্রটিকে...

তানভীর আহমেদ ও আবদুল কাদের

সিলোন থেকে শ্রীলঙ্কা এখন

চীনের সাদা হাতি পুষছে শ্রীলঙ্কা

চীনের দেওয়া ঋণে আকাশছোঁয়া উন্নয়ন যাত্রা শুরু করেছিলেন রাজাপক্ষে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে। ব্লুমবার্গের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ বিশ্লেষণ। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘দ্য গ্রেট চায়নিজ হোয়াইট এলিফ্যান্ট অব শ্রীলঙ্কা’।

ভারত সমুদ্রের এ দ্বীপরাষ্ট্রে দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপক্ষের উচ্চাকাক্সক্ষা। সঙ্গে যোগ হয়েছে পর্যটনশিল্পে ধস। করোনা মহামারিতে দেশটির পর্যটনশিল্প সংকটের মুখে পড়ে। কমে যায় ডলার আয়। বাড়ে সামাজিক ব্যয়। সাধারণ মানুষ আটকে পড়ে ঋণের চোরাবালিতে। এরপর এসেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। খাদ্য, জ্বালানি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংকট প্রবল হচ্ছে। বড় দেশগুলোর রাজনৈতিক নীতির কারণেই এ সংকট তীব্রতর হচ্ছে।

রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক দুর্দশার ধারাবাহিক পরিক্রমা জানেন। এর শুরু হয় ২০১৯ সালে। সে বছর তিনি ‘ট্যাক্স কাট’ বা ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেন। তিনি অরগানিক কৃষি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে চেয়েছেন। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে কৃষি উৎপাদনে। কমে যায় শস্য উৎপাদন। চা উৎপাদন কমে যাওয়া এর বড় উদাহরণ। এ সংকট মোকাবিলা করতে তিনি চীনের কাছ থেকে ঋণ নেন। তখন হয়তো ভেবেছিলেন, চীনের ঋণে গড়ে তোলা কলম্বো পোর্ট সিটি ও সমুদ্রবন্দর তাকে বিদেশি মুদ্রা আয়ের পথ খুলে দেবে।

শ্রীলঙ্কায় এখন এশিয়ার সবেচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, শতকরা প্রায় ১৯ ভাগ। সঙ্গে রয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা। এ বছর তো বটেই সামনের বছরের মধ্যেও ২ বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য নেই দেশটির। এ পরিস্থিতিতে দেশটি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। পুরো পরিস্থিতির পেছনে বড় ভূমিকা ছিল কলম্বো পোর্ট নির্মাণে চীনের কাছ থেকে নেওয়া বড় অংকের ঋণ। এই সমুদ্রবন্দর ও শহর নির্মাণ শ্রীলঙ্কার কাছে সাদা হাতি পালার চেয়ে কম কিছু নয়। স্রেফ অর্থের অপচয় ও বিলাসিতা ছাড়া এ মুহূর্তে এ প্রজেক্টকে আর কিছুর সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় না। কলম্বো পোর্ট সিটি প্রজেক্ট  ধনীদের পকেটে ডলার ঢোকানোর প্রজেক্ট বলে মনে করছেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। কলম্বো পোর্ট সিটিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বাসযোগ্য, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় শ্রীলঙ্কা। এ জন্য ২৬৯ হেক্টর জমি উদ্ধার করে দেশটির সরকার। আকাশছোঁয়া দালান দিয়ে এ শহর গড়ে তুলতে শুরু করে। দুবাইয়ের দ্বিগুণ বড় এ শহর বানাতে চীনের কাছ থেকে বড় ঋণ নেয় দেশটি। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। সে ঝুঁকি মাথায় রেখে সমুদ্রতীরে গড়ে তোলা এ শহরটি টেক্কা দিতে পারবে সিঙ্গাপুর, জাকার্তা কিংবা ম্যানিলার মতো প্রধান শহরগুলোকে।

ট্যাক্স ফ্রি এমন একটি বাণিজ্য শহর গড়া আসলে অলিক-বাস্তবতা। এর নির্মাণ শেষ হলেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের অবদান থাকবে না- এমনটাই মানেন বিশ্লেষকরা। ২০৪১ সাল নাগাদ এ শহর পুরো কার্যক্রমে এলেও শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোর মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ অবদান রাখতে পারবে। এখানে যে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলবে, সেখান থেকে যা আয় হবে তা দেশের অর্থনীতিতে তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে না। এর বড় কারণ চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা। বড় আকারের ঋণ চুকাতে গিয়ে বন্দর-তীরবর্তী শহরটি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে না শ্রীলঙ্কা। রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্ষেত্রেও সুফল মিলবে না। এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে আইএমএফ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে কর তুলে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা চালাতে পারে।

দেশে কর কমিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করা হলেও বড় ধরনের ঋণের বোঝা চাপিয়ে এ ধরনের প্রজেক্ট হাতে নেওয়া প্রশ্নবিদ্ধ একটি সিদ্ধান্ত। আইএমএফ এমনটাই মনে করে। শ্রীলঙ্কা এখন স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটছে।

ট্যাক্স ফ্রি দেশ ইউনাইটেড আরব আমিরাতও সামনের বছর থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের অংশ থেকে শতকরা ৯ ভাগ কর আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিঙ্গাপুরও তাদের নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। ‘টপ-আপ-ট্যাক্স’ চালু করেছে তারা। এখন থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ম মেনে লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নীতিগত সমন্বয় ঘটবে। যেসব ক্ষেত্রে ছাড়ের সুযোগ রয়েছে তার প্রধান লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা ও জীবনমান উন্নত করা। ২০৪১ সালের দিকে  এই সমুদ্র-তীরবর্তী শহর নির্মাণ শেষ হলেও সেখানে কর থেকে আয়ের নীতিতে আইএমএফ পরিষ্কার সুফল দেখছে না। তাদের প্রতিবেদন বলছে, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা ও রেভিনিউ দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা এ প্রজেক্ট শুরু করে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ের ভাই মাহিন্দ্রা সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় এ পরিবারটি বারবারই থেকেছে। পরিবারটি ভেবেছিল, সমুদ্রবন্দর ও       তীরবর্তী শহরের ব্যবহার বাড়িয়ে এ অঞ্চলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াবে। বিশেষ  করে চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতামূলক        সম্পর্ক থাকায় সমুদ্র-তীরবর্তী এ শহরটি         তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চীনের হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোং-কে ১১৬ হেক্টর জায়গা ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার সরকারের হাতে রাখে মাত্র ৬২ হেক্টর জমি।

চীনের এমন আগ্রাসী ভূমিকা ভারত আগেই আঁচ করতে পেরেছে। শ্রীলঙ্কার বেইজিংঘেঁষা সম্পর্ক ভারত টের পায় আরও কিছু বছর আগে। কলম্বো পোর্টের পূর্ব দিকের টার্মিনাল নির্মাণ কাজের সময় রাজাপক্ষে ভারত এবং জাপানকে সরিয়ে রাখে। দক্ষিণ দিকের টার্মিনালে চীনের আধিপত্য রয়েছে। ‘চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস কোং’-এর হাতে রয়েছে এ পোর্টের ৮৫ শতাংশ মালিকানা। শ্রীলঙ্কার সরকার চেয়েছিল অন্তত পূর্ব দিকের টার্মিনালের মালিকানা নিজেদের হাতে থাকুক। কিন্তু তারপরও শ্রীলঙ্কা এ পোর্ট নির্মাণের কাজ চীনের মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস কোং-এর হাতে তুলে দেয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে রাজাপক্ষে অন্য পরিকল্পনা নেন। তিনি ভারতের আদানি গ্রুপের হাতে নতুন পশ্চিম পোর্টের ৫১ শতাংশ মালিকানা দেন। কোনো পাবলিক টেন্ডার ছাড়াই রাজাপক্ষে ভারতকে তুষ্ট রাখতে এ কাজ করেন, ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন। শ্রীলঙ্কার আগের প্রশাসন চীনের মার্চেন্ট পোর্টসকে হামবানতোতা সমুন্দ্রবন্দরও লিজ দিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল ঋণের ভার কমানো। এলিভেটেড কলম্বো হাইওয়ে প্রজেক্টের কাজও ‘চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস কোং’-এর হাতে তুলে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এভাবেই দেশটির ২২ মিলিয়ন মানুষের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। চীন-ভারতের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব যেভাবেই বলা হোক, পুরো ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়ে। সাধারণ মানুষের আয় ও দেশের মুদ্রার মান কমে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে এক দিনে ৭ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত ইন্টারেস্ট বাড়িয়েও স্থানীয় রুপির মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শীতল অর্থনীতি যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে কোনো একটি পক্ষ নেওয়ায় শ্রীলঙ্কা ও তার অর্থনীতির ভরাডুবি দেখতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড কানেকশন প্রজেক্ট নিয়ে ওয়াশিংটন আগে থেকেই উদ্বিগ্ন। তারা ভাবতেই পারে চীন শ্রীলঙ্কার এ পোর্ট সিটি কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করবে।  ধনীদের হাতেই জমবে টাকার পাহাড়। কলম্বো পোর্ট সিটি ভারত সাগরে ‘ট্যাক্স হেভেন’ বা কর আদায়ের স্বর্গ হয়ে উঠতে পারে।  যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নেতৃত্বে ভাগ বসাতে এ সুযোগ কে ছাড়তে চাইবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

 

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আছে পরিবারতন্ত্র

প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাপট দেখিয়ে আসছে শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবার। রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি পদ দখল করে রেখেছেন তিন ভাই। গোতাবায়া রাজাপক্ষে (৭০) প্রেসিডেন্টের আসনে বসা, মাহিন্দা রাজাপক্ষে (৭৪) প্রধানমন্ত্রী। তাদের বড় ভাই চামাল রাজাপক্ষে (৭৭) লঙ্কার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষেও রাজনীতিক। ছিলেন মাহিন্দা সরকারের উপদেষ্টা এবং এমপি। এ ছাড়া পরিবারের অর্ধশত সদস্য বহাল আছেন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। রাজপক্ষে পরিবারের রাজনৈতিক উত্থান শুরু মাহিন্দা-গোতাবায়ার দাদা ডন ডেভিড রাজাপক্ষের হাত ধরে। ডেভিডের ছোট ছেলে তথা মাহিন্দা-গোতাবায়ার বাবার নাম ডন অলউইন (ডিএ) রাজাপক্ষে ছিলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী। অলউইনের বড় ভাই ডন ম্যাথিউ রাজাপক্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে তৎকালীন সিলোন আইনসভার সদস্য ছিলেন। এ পরিবারের তৃতীয় পুরুষ এখন লঙ্কায় রাজত্ব করছেন। গণমাধ্যম সূত্র জানায়, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটে বিক্ষোভ শুরুর আগ পর্যন্ত দেশটির মোট বাজেটের প্রায় ৭৫% রাজাপক্ষে পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, মাহিন্দার এক দশকের দীর্ঘ শাসনামল নির্লজ্জ স্বজনপ্রীতি  এবং দুর্নীতির কারণে দেশটির আজ এ দুরবস্থা।

 

এশিয়ার দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে ফিরে তাকাতে হবে পেছনে। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে শ্রীলঙ্কায় সিংহলি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য ছিল ব্যাপক। তারাই দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার মাত্র ১৫% ছিল তামিল, ৭৫% ছিল সিংহলি। এতে শিক্ষা, সংস্কৃতি এমনকি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হতো সিংহলি জনগোষ্ঠীকে। ১৯৫৬ সালে সিংহলা ভাষাকে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ভাষা  ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে তামিল ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ এর দশকে অনেকগুলো সশস্ত্র তামিল দল গড়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ‘তামিল নিউ টাইগার্স’ তেমনই একটি সশস্ত্র সংগঠন। মূলত তারা ছিল দেশটির উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। খুব দ্রুতই তামিল টাইগাররা ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের বাহিনীতে পরিণত হয়। শুরু হয় নৌ ও বিমান বাহিনীর কাজও। সেই সঙ্গে নিজস্ব নীতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের বিরাট নেটওয়ার্ক ছিল তাদের।তামিল টাইগাররা সর্বপ্রথম বড় আঘাত করে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে। যাকে এখনো শ্রীলঙ্কানরা বলে ‘ব্ল্যাক জুলাই’। সে সময় তামিল টাইগাররা দেশটির উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। এর মাধ্যমেই শুরু হয় শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাস। প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের উত্তেজিত জনতা পাল্টা হামলা চালায়। যার ফলে নিহত হয় তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। শুরু হয় লঙ্কান গৃহযুদ্ধ। নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয় তামিলরা। এরপর এই গৃহযুদ্ধ চলে দীর্ঘ ২৬ বছর। গৃহযুদ্ধে নিহত হয় প্রায় ১ লাখ মানুষ। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় হাজার হাজার তামিল। ২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন মাহিন্দার রাজাপক্ষে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সরকার ঘোষণা করে, দীর্ঘ বিরোধ ও যুদ্ধের অবসান হয়েছে।  পরদিন তামিল টাইগাররা নিজেদের ওয়েবসাইটে স্বীকার করে, শেষ হয়েছে গৃহযুদ্ধ। আত্মহত্যা করেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। তার মৃত্যুতে শেষ হয় শ্রীলঙ্কায় চলমান এশিয়ার দীর্ঘ  সময়ের এক গৃহযুদ্ধ।

 

ঋণখেলাপি ঘোষণা শ্রীলঙ্কার

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক ঋণ ৫১ বিলিয়ন ডলার, বিপরীতে রিভার্ভ রয়েছে একেবারেই কম।  দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ এর এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার মজুদ ছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার, যা করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে ক্রমশ কমতে থাকে। আর ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে ২০২২ সালের মার্চে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে তলানীতে। এমতাবস্থায় আর্থিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে। জানা গেছে, জরুরি ভিত্তিতে পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে আসায় এই উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে দেশটির সরকার।  এই উদ্যোগকে ‘শেষ ভরসা’ হিসেবে দেখছে শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয়। যাতে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি না হয়।

 

উপমহাদেশে শিক্ষায় প্রথম

সংবিধান মোতাবেক- ‘বিনামূল্যে শিক্ষা’ শ্রীলঙ্কার সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, শ্রীলঙ্কায় শিক্ষিতের হার ছিল ৯২.৬%, যার মধ্যে ৮৩ শতাংশ মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। পরিসংখ্যানটি বিশ্ব এবং আঞ্চলিক মান অনুসারে গড়ের ওপরে। এমনকি উপমহাদেশের শিক্ষার হার অনুসারে শ্রীলঙ্কা সবার ওপরে।  ২০১৫ সালে এগোতে থাকে সেই পরিসংখ্যান। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিকস কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় শিক্ষিতের হার ৯৬.৩%। তালিকায় পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ভারত ৭৪.৪%, বাংলাদেশ ৭৩.৯%, ভুটান ৬৪.৯%, নেপাল ৬৪.৭% এবং পাকিস্তান ৫৯.১%। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় কম্পিউটার সাক্ষরতা ২৮.৩% এবং ফোন ব্যবহারকারী ১০৫%, ওয়েবসাইট ব্যবহারকারী ৩২%। শ্রীলঙ্কায় প্রত্যেক শিশুর ৯ বছর মেয়াদি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ১৯৪৫ সালে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. সি. ডব্লিউ. ডব্লিউ কান্নানগারা প্রণীত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা শ্রীলঙ্কার শিক্ষার হার ও সাক্ষরতায়  বিরাট অবদান রাখে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় বেশির ভাগ বিদ্যালয়ই ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে  গড়ে তোলা হয়েছে।

 

বিদ্যুৎহীন জনজীবন

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা স্মরণকালের কঠিন সময় পার করছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশটিতে দেখা দেয় জ্বালানির মারাত্মক ঘাটতি। আর তাতে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত হচ্ছে না বিদ্যুৎ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন জীবন পার করছে দীপরাষ্ট্রটির সাধারণ মানুষ। এদিকে দেশটির সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ড (সিইবি) ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের প্রস্তাব করে, তাতে অনুমোদন দেয় পাবলিক ইউটিলিটিজ কমিশন (পিইউসি)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোতে জ্বালানি সংকটের কারণে আজকের অচলাবস্থার সৃষ্টি। জানা যায়, শ্রীলঙ্কার মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে। এরইমধ্যে মৌমুমি বৃষ্টি না হওয়ায় দেশটির বেশির ভাগ জলাধারের পানি বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। তাতেই ভাটা পড়েছে জলবিদ্যুতে। অন্যদিকে জ্বালানির অভাবে জেনারেটরে উৎপাদন করা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ। এমনকি দেশটির সাধারণ মানুষও জ্বালানির অভাবে কাঠ কয়লা দিয়ে রান্না করছে। এর আগে দেশটির সিইবি ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিয়ন সতর্ক করে বলেছিল, প্রতিদিনই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে পানির স্তর নিচে নামছে। বৃষ্টি না হওয়া এর অন্যতম কারণ। বিপরীতে ৭৫০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।  পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাবে সম্ভব হচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন। আর এ কারণে ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কাবাসীর  বিদ্যুৎহীনতা আরও বাড়তে পারে।

 

ঊর্ধ্বমুখী খাদ্যপণ্যের দাম

আমদানিনির্ভর শ্রীলঙ্কা

কয়েক বছর আগেও মার্কিন ১ ডলারে পাওয়া যেত শ্রীলঙ্কান ১৯৯ রুপি। যা এখন ছাড়িয়েছে ৩০০ রুপি। বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে থাকায় মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দামকে করেছে আকাশচুম্বী এবং আমদানিনির্ভর হওয়ায় বেশ বেকায়দায় আজ দেশটির অর্থনীতি। গণমাধ্যম সূত্র জানায়, এক কাপ চায়ের দাম এখন ২৯ টাকা। এমনকি একটি ডিমের দাম ৩৪ টাকা। দেশটির সুপার মার্কেটগুলোয় গম ও চাল বিকিকিনি হচ্ছে যথাক্রমে কেজিপ্রতি ২৫১ টাকা এবং ২১৭ টাকায়। প্রতি কেজি চিনি ২৭৪ টাকা, প্রতি লিটার নারিকেল তেল ৯৭১ টাকা। এ ছাড়াও এক কেজি গুঁড়ো দুধের প্যাকেটের দাম এখন ২১৭২ টাকা। প্রতি কেজি মাছ ও মুরগি বিকিকিনি হচ্ছে যথাক্রমে ৫৫০ এবং ৪০০ টাকায়। দ্বীপরাষ্ট্রটির খুচরা মুদ্রাস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়ায় ১৭.৫% এবং খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ২৫%-এর অধিক বেড়েছে, ফলে খাদ্যশস্য এবং ভোগ্যপণ্যের দাম অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে। এমনকি ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে তীব্রভাবে। দেশটিতে জ্বালানি তেলের দাম এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। জানা গেছে, দেশটিতে এক লিটার পেট্রোলের দাম ৩৫০ টাকা।  দ্রব্যমূল্যের এমন লাগামহীন দামের ফলে দ্বীপরাষ্ট্রটির সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না প্রতিদিনের  প্রয়োজন মেটানো।

 

করোনা মহামারির আঘাত যেসব শিল্পে ভালো ছিল শ্রীলঙ্কা

এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কার অবস্থা ছিল অন্যরকম। ব্রিটিশ উপনেবিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধের অবসান, সব মিলিয়ে পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক আমদানি-রপ্তানি আর পর্যটন ব্যবসায় সুখের দিন পার করছিল শ্রীলঙ্কার জনসাধারণ।  শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি মূলত গড়ে উঠেছিল পরিষেবা খাত এবং শিল্প খাতের ওপর। দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি পর্যটনশিল্প, চা রপ্তানি, টেক্সটাইল, চাল ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন। পাশাপাশি বৈদেশিক রেমিট্যান্সও দেশটির অর্থনীতির অন্যতম খুঁটি। প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের সিংহভাগই বসবাস করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। দেশটির অন্যান্য শিল্প-বাণিজ্যের মধ্যে অর্থনীতির চাকা সচলে ভূমিকা রাখে রাবার প্রসেসিং, টেলিযোগাযোগ, সিমেন্ট, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন শিল্প। অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে আখ, মসলা, শস্য, নারিকেল, গরুর মাংস এবং মাছ ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত দ্বীপরাষ্ট্রটি। পর্যটনশিল্প ও নানা পরিষেবা শিল্পে ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে থাকে শ্রীলঙ্কা। হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য গত ১৫ বছরে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেয় শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা প্রকল্প। দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে দেশটির সরকার ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে আনে। উদ্দেশ্য- অর্থনীতির গতি সঞ্চার। রাজ্য্যের ঘাতটি পূরণ এবং বৈদেশিক ঋণের কারণে কমতে থাকে রিজার্ভ। অর্থের অভাবে দেশটি কৃষিজ রাসায়নিক আমদানি বন্ধ করে চালু করে অর্গানিক কৃষি চাষ। যার ফলে উৎপাদন কমে যায় ২০ শতাংশ। এরই মধ্যে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী হানা দেয় করোনাভাইরাস।  ফলে পর্যটন ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স বাণিজ্যে আসে বড় ধরনের আঘাত। আর তাতেই চরম অর্থ  সংকটে পড়ে দেশটি।

 

পর্যটন ব্যবসায় ধস

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস দেশটির পর্যটন খাত। শ্রীলঙ্কার একটি সংস্থার দাবি, ইস্টার সানডের দিন বোমা হামলার পর এমনিতেই পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল ১৮ শতাংশ। আর  করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে পর্যটন থেকে দেশটির যে পরিমাণ আয় হতো, করোনা-পরবর্তী সময় সেটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসে। দীর্ঘ দুই বছর মহামারির কারণে পর্যটনশিল্পের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই চরম সংকটে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। করোনা-পরবর্তী সময় দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে হোটেল-লজে কাজ করার লোকের অভাব দেখা দেয়। যা দেশটির পর্যটন খাতের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হলো পর্যটন খাত। এক্ষেত্রে প্রবাসী আয় ও পোশাকশিল্পের পরই এ খাতের অবস্থান। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।  আমদানিতে বিধিনিষেধ কঠোর করে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি বাড়িয়েছে সরকার। ফলে দেশটিতে চলমান মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়েছে দেশটির সবকিছুর দাম। এসবই পর্যটকদের দূরে রাখছে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ থেকে। ফলে দেশটির পর্যটন ব্যবসায়  নেমেছে ধস।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর