মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

স্বদেশে ফেরা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

স্বদেশে ফেরা

বাংলার গণমানুষের নির্ভরতার প্রতীক, মাদার অব হিউমেনিটি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আজ ৪২ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৭৫ সালে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন প্রবাসে নির্বাসন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে আজকের দিনে স্বদেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। যেদিন প্রিয় নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথযাত্রী। দেশে ফিরে জাতির পিতাকে হারিয়ে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের সুবাদে আওয়ামী লীগ একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আর তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সারা বিশ্বে মর্যাদার আসন লাভ করেছে। সুতরাং শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন নয়, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্নিবীণার প্রত্যাবর্তন। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্ব^রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে হামলা চালিয়ে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন বিদেশে অবস্থানের কারণে তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। জাতির ইতিহাসের এ বিষাদময় ঘটনার সময় স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মসূত্রে স্বামী ও বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সে দেশেই তাঁর দুই সন্তানকে অবাঞ্ছিত করা হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ঠাঁই হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এরপর দীর্ঘদিন সেখানেই নির্বাসিত জীবন কাটান তাঁরা।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। ডুবন্ত আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকায় ফেরেন শেখ হাসিনা। বৃষ্টিমুখর দিনে বিকাল সাড়ে ৪টায় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিলেন। বিমানবন্দর থেকে প্রিয় নেত্রীকে নিয়ে যখন মানিক মিয়া এভিনিউয়ে যাওয়া হয় তখন রাস্তার দুই পাশে লাখ লাখ মানুষ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। সেদিনের প্রবল বর্ষণে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে কাছে পেয়ে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করছে আর মেঘের প্রচন্ড গর্জনে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের প্রতি ধিক্কার প্রদর্শন করছে। সেদিন আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম-‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, শেখ হাসিনা, আমরা আছি তোমার সাথে।’ সভামঞ্চে উঠে ক্রন্দনরত অবস্থায় সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সর্বহারা। আমার কেউ নেই। আপনাদের মাঝেই আমার হারানো পিতা-মাতা, আমার ভাই, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আমি খুঁজে পেতে চাই। আপনাদের কথা দিলাম-এই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব।’ মানিক মিয়া এভিনিউর জনসমুদ্রে সর্বস্তরের জনতার উদ্দেশে বক্তৃতায় জাতির কাছে যে অঙ্গীকার তিনি ব্যক্ত করেছিলেন পরবর্তী সময়ে সেসব প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে আজও তা অব্যাহত রেখেছেন।

দেশে ফেরার আগে শেখ হাসিনা জার্মানিতে অবস্থানকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রদূত ও স্পিকার) জার্মানিতে দায়িত্বরত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরির সহায়তায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অনুরোধ করলে ইন্দিরা গান্ধী তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যান। আগস্টের ২১ তারিখ শেখ হাসিনা দিল্লির উদ্দেশে জার্মানি ত্যাগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের মাতৃস্নেহে গ্রহণ করেন। তাঁদের নাম বদলে নাম রাখা হয় মি. ও মিসেস মজুমদার। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি গবেষণা ফেলোশিফের ব্যবস্থা করে দেন। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই ঢাকার পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনতে পান।

ততদিনে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে মোটামুটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করে ফেলেছেন। শাহ আজিজের মতো চিহ্নিত রাজাকারকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। ঘাতক আবদুল আলিমকে বানিয়েছেন মন্ত্রী। জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসতে দিয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না বলে একটি ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে উচ্চ পদে পদায়ন করেছেন। পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সেøাগান চালু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১১ হাজার পাকিস্তানি দালাল রাজাকার-আলবদর বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে ছিল। জিয়া তাদের মুক্ত করে দেন। যে দেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, তাঁদের আত্মত্যাগকে জিয়া পদদলিত করেছেন।

নিষ্ঠুর জিয়ার বাংলাদেশে শেখ হাসিনার থাকার জায়গাও নেই। উঠলেন এক ফুফুর বাড়িতে। স্বজনদের জন্য দোয়া করতে যেতে চাইলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্ব^রে নিজ বাড়িতে। অনুমতি মিলল না। সামনের রাস্তায় বসে দলের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে নিয়ে দোয়া পড়লেন। এক পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বে সামরিক শাসনবিরোধী দুর্বার গণ-আন্দোলন সংগঠিত হয়। অকুতোভয় শেখ হাসিনার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই অসীম সাহসী, চিত্ত তাঁর ভয়শূন্য! তাঁর নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন সফল হয় এবং ১৯৯০ সালের ডিসেম্ব^র মাসে এরশাদ একটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এই সরকারের একমাত্র কাজ ছিল একটি অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা আর নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তিনি দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে নানামুখী কার্যকর উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি জনগণের গণতান্ত্রিক এবং ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিরাম সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁরই উদ্যোগে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা দেখা দেয়। দেশবাসীও উজ্জীবিত হয় নতুন প্রেরণায়।

               

লেখক : শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক ও সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর