শুক্রবার, ২০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ

বিয়ে করার পর দেখলাম কবিতা আর গল্প লিখে সংসার চলবে না

বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ

ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে আপনাদের বিশাল আড্ডা হতো। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে!

বিউটি বোর্ডিংয়ের আগে এর অসাধারণ একটি ইতিহাস আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন ‘সোনার বাংলা’। সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নলিনী কিশোর গুহ। ওই সময় পত্রিকাটি দারুণ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমান বিউটি বোর্ডিংয়ের জায়গায় ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস ও প্রেস। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর পত্রিকাটি বিক্রি হয়ে যায়। তারপর সেখানে বিউটি বোর্ডিং হয়। আমার ভাই আসাদ চৌধুরীর বাবা আরিফ চৌধুরী ছিলেন মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি। তার সঙ্গে প্রথম বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়েছিলাম। কলতাবাজার থেকে হেঁটে যেতাম শিরিষ দাশ লেনের ওই বাড়িটায়, সেখানে আমাদের আড্ডা হতো। বিউটি বোর্ডিংয়ের মালিক আমাদের সবাইকে জড়ো করেছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, কাইয়ূম চৌধুরী, হাসান আফিজুর রহমান, কায়সুল হক, মুর্তজা বশীর, দেবদাশ চক্রবর্তী প্রমুখ। পঞ্চাশের দশকের যত লেখক-সাহিত্যিক ছিলাম সব আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতাম। বিনা পয়সার চা সিঙ্গারা খেতাম। প্রতিদিন রাত ১০টা/১১টা পর্যন্ত আড্ডা হতো। তখন একদিকে ছিল সওগাতের আড্ডা অন্যদিকে ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা। দুটোই ছিল তরুণ সাহিত্যিকদের গড়ে ওঠার প্রধান কেন্দ্র।

কৈশোরে তো আপনি কবিতা লিখতেন?

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে আমার কবিতা লেখার শুরু, তারপর গল্প। স্কুলজীবনে ১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত কলকাতার মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘স্বাক্ষর’ নামে আমার গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পটির বিষয়বস্তু ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন গ্রামবাংলার পটভূমি। ‘শিশু সওগাত’-এ প্রকাশিত হয় আমার প্রবন্ধ ‘যুগধর্ম’। সাহিত্যিক বিমল ঘোষ ওরফে মৌমাছির নেতৃত্বে সারা অবিভক্ত বাংলায় গড়ে ওঠা কলকাতার ‘আনন্দবাজার’। পড়াশোনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প লিখে আমি আনন্দ পেতাম।

 

আপনার ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘সুন্দর হে সুন্দর’-এর মতো গল্পগ্রন্থ; কিংবা ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘তিমির-সঙ্গিনী’, ‘নীল যমুনা’ নামে অসাধারণ কিছু উপন্যাস রয়েছে। গল্প, উপন্যাস থেকে আপনার পাঠকদের বঞ্চিত করলেন কেন?

বাঁচার তাগিদে। তখন একটা গল্প লিখলে একশ টাকা দিত। সেটা আদায় করতে আবার একশ টাকার রিকশা ভাড়া লাগত। তারপরও লিখতাম। কিন্তু বিয়ে করার পর দেখলাম কবিতা আর গল্প লিখে সংসার চলবে না। এরপর সাংবাদিকতায় চলে আসি। সাংবাদিকতায় টাকা ছিল। বেতন তো আছেই, রাজনৈতিক কলাম লিখেও টাকা পেতাম। আমি এখনো পাঁচটি কাগজে লিখলে যে টাকা পাই একটি উপন্যাস লিখলে তো সে টাকা পাব না।

মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভূমিকা প্রসঙ্গে।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকা-লেখক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও কাজ করেছিলাম।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখন?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখেছিলাম চল্লিশের দশকে ঢাকার তাঁতীবাজারে নিকটাত্মীয় বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরীর বাসায়। ১৯৫৪-এর দিকে ‘সওগাত’ পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখি। ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত একটি কুৎসামূলক সম্পাদকীয়-বক্তব্য খন্ডন করে আমি ‘মিল্লাত’-এ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে এর জবাব লিখেছিলাম। এই সম্পাদকীয়টি শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরে ‘ইত্তেফাক’ ভবনে আমাকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব পার্কার কলম উপহার দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। এ ছাড়া ষাটের দশকে আমার ‘দশ দিগন্ত’ কলামও বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৬৭-তে ‘আজাদ’ পত্রিকায় ‘তৃতীয় মত’ কলামে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা দাবির সমর্থনে কলাম লিখেছিলাম যা তিনি জেলখানায় বসে পড়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ (ন্যাম) সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম।

 

আপনি অনেক মহান নেতা, লেখক, শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিশেষভাবে কারও কথা মনে পড়ে?

অনেকের কথা মনে পড়ে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ মুজতবা আলী, শওকত ওসমান, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি আবদুল কাদির, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদসহ অনেকেই।

 

আমাদের দেশে নারীর কাক্সিক্ষত ক্ষমতায়ন কতখানি হয়েছে বলে মনে করেন?

এটা সত্যি যে, আমাদের দেশের সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় প্রধান দুজনই নারী। তারপরও বাংলাদেশের নারীর কাক্সিক্ষত ক্ষমতায়ন আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আবার এটাও ঠিক, অনেকাংশে নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক দূর যেতে হবে। শ্রদ্ধেয় নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে আজকের মালেকা বেগম, আয়েশা খানম সবাই এ নিয়ে লড়ছেন। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার কিছুটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে বহু গ্রামীণ নারী কাজ করছেন। অফিস-আদালতেও অনেক নারী বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। তবুও পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আজও পুরুষ পক্ষপাত থাকে।

 

আপনারা যে কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা কতখানি পূরণ হয়েছে?

আমাদের দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। যে মাত্র বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে তখনই আমরা বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করেছি। ওটা ছিল আমাদের ক্ষমতা দখলের অস্ত্র। আবার যে মুহূর্তে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেছি তখনই আমরা পাকিস্তানি হয়ে গেছি। পাকিস্তান আমলে যে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ছিল তা অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে। হেফাজত, জামায়াতের যে প্রতাপ বেড়েছে তা ভাবা যায় না। গোটা পাকিস্তান আমলে ওদের শাসন-শোষণ ছাড়া বাংলা ভাষাকে তারা গুরুত্ব দিত। তখন বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ ছিল। জাতির উন্নয়নে কিছু নৈতিক মূল্যবোধ লাগে, যা আমাদের কমই আছে। সুতরাং আমি দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী কিন্তু এ মুহূর্তে খুব আশাবাদী নই।

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ মেহেদী হাসান

সর্বশেষ খবর