শিরোনাম
রবিবার, ৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
রানি এলিজাবেথের প্লাটিনাম জুবিলি

সিংহাসনে ৭০ বছর

রণক ইকরাম

সিংহাসনে ৭০ বছর

এক সময় যে রাজত্বের সূর্য কখনো ডুবত না, সেই রাজত্বের অপার ক্ষমতা এখন না থাকলেও এখনো অনেকটাই রয়ে গেছে পুরনো শান-শওকত।  সেই শান-শওকতের পুরোটাজুড়েই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। মাথায় মুকুট পরেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কখনো দায়িত্ব থেকে সরে যাবেন না। তিনি কথা রেখেছেন। ৯৬ বছর বয়সেও কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর কন্যা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সে হিসেবে গত ফেব্রুয়ারিতে রানির শাসনকালের ৭০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর মাসে বর্ষপূর্তি পালন করতে চাননি রানি। পরে জুন মাসকে উদ্যাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়।

 

এক বৈশ্বিক রানির গল্প

১৯৩৭ সালে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজার আসনে বসেন। আর সে সময় ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী ছিলেন রাজকুমারী এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের অদ্ভুত একটি দিনে জীবনটা বদলে যায় সেই রাজকন্যার। সুদূর কেনিয়ায় বসে সেদিন শোনেন পিতা ব্রিটিশরাজ ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু সংবাদ। সেই দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেদিনই তিনি জেনে গিয়েছিলেন রানি হওয়ার সংবাদ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তাঁর মাথায় ওঠে রাজমুকুট। রানি হলেন এলিজাবেথ। সেই থেকেই ব্রিটেনের জনগণের হৃদয়ে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় রানি হয়েই কাটিয়ে দেন এতগুলো বছর।

১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অদ্যাবধি রাজ সিংহাসনে আসীন মহামান্য রানি এলিজাবেথ। তিনি সফর করেছেন পৃথিবীর শতাধিক দেশ। এলিজাবেথের দাম্পত্যসঙ্গী হলেন প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা। তাঁদের চার সন্তান রয়েছে- চার্লস, অ্যানি, অ্যান্ড্রু এবং এডওয়ার্ড। ১৯৪০ সালে এলিজাবেথ প্রথম রেডিও বিবিসিতে শিশুদের উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৪৩ সালে ১৭ বছর বয়সে এলিজাবেথ প্রথম জনসম্মুখে আসেন। ১৯৪৫ সালে তিনি সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করেন। দীর্ঘ সাত দশকের পথচলা তাঁর জন্য খুব মসৃণ ছিল না। টেমসের জলধারার সঙ্গে সঙ্গে অনেক চড়াই-উতরাই ছিল। সব কিছুর পরও রানি হচ্ছেন ব্রিটিশ জাতির ঐক্য আর ঐতিহ্যের প্রতীক।

‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ সাইমন হেফার লিখেছেন, ৭০ বছর ধরে রাজনীতিকরা তাঁকে যতই খাটো করার চেষ্টা করুন, আজো ব্রিটেনের সবচেয়ে দামি সম্পদ রানি! উৎসব আনন্দে এ কঠিন সময়েও আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে ইংল্যান্ড। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ বাংলাদেশেও এসেছিলেন। দুবার ঢাকায় এসেছেন তিনি। প্রথমবার এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আমলে। ১৯৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রানির বিমান নেমেছিল পুরনো বিমানবন্দরে। রমনা পার্কের সামনে একটি পুরনো বাড়ি সাজানো হয়েছিল তাঁর জন্য। সে বাড়িটিই এখন বঙ্গভবন। স্টিমারে বুড়িগঙ্গা ভ্রমণসহ আদমজী জুটমিলেও ভ্রমণ করেছেন রানি।

সাধারণ হিসেবে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের শীর্ষ তালিকায় রানির নাম না থাকলেও স্বমহিমা আর সম্পদের দিক থেকেও তিনি মোটেও পিছিয়ে নেই। তবে রাজকীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কর দিতে হয় রানিকে। আবার অনেক দেশের রানি হলেও দেশগুলোতে চলছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। আগের দিনের রাজা-রানিদের মতো নিজস্ব কোষাগারে সব ধন-সম্পত্তি পুরে রাখার কোনো সুযোগ এখন নেই। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০১৫ সালে ক্রাউন এস্টেট থেকে ২৮ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড পেয়েছিলেন। সরকারি কোষাগার থেকে পাচ্ছেন ২০ লাখ পাউন্ড। কিন্তু কথা হলো রানি ঠিক কত ধন-সম্পদের মালিক। আসলে তাঁর ধন-সম্পদের পরিমাণ কখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এর কারণ হলো- রানিকে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ কত, তা ঘোষণা করতে হয় না।

রানির বয়স এখন ১০০ ছুঁই ছুঁই। তাই রানির মৃত্যু হলে কী কী হবে সেটাও আগে থেকেই ঠিক করা। রানির মৃত্যু হলে লন্ডনে পররাষ্ট্র দফতরের গ্লোবাল রেসপন্স সেন্টার থেকে এ খবর যুক্তরাজ্যের বাইরে ১৫টি দেশের সরকারের কাছে পাঠানো হবে। এ ছাড়া রানির প্রভাব রয়েছে কমনওয়েলথভুক্ত এমন ৩৬টি দেশেও খবরটি পাঠানো হবে। এসব দেশের প্রধানমন্ত্রী, গভর্নর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূতরা শোক প্রকাশ করতে হাতের বাহুতে কালোব্যাজ পরবেন। বাকিংহাম প্যালেসের ফটকে কালো নোটিস টাঙানো হবে। আর গণমাধ্যমের মধ্যে সর্বপ্রথম রানির মৃত্যু সংবাদ জানতে পারবে বিবিসি। পরবর্তীতে অন্যান্য মাধ্যম। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অধিবেশন ডাকা হবে, সাধারণ মানুষকে কাজ থেকে দ্রুত ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো হবে।

 

দীর্ঘতম রানি

ব্রিটেনের হাজার বছরের ইতিহাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দীর্ঘ সময় সিংহাসনে থাকার রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আজ অবধি রানির আসনে আসীন মহামান্য রানি এলিজাবেথ। সিংহাসনে তাঁর সত্তর পেরিয়ে গেছে। এর আগের রেকর্ডটি রানি ভিক্টোরিয়ার। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত ৬৪ বছর রাজত্ব করেন ভিক্টোরিয়া। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। তাঁর পিতা ষষ্ঠ জর্জ ও মাতা এলিজাবেথ বউয়েস। তিনি বিশ্বের ১৬টি সার্বভৌম রাষ্ট্র, অর্থাৎ কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান রানি ও রাষ্ট্রপ্রধান। কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে : যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা, বারবাডোস, বাহামাস, গ্রানাডা, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, টুভালু, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইন, বেলিজ, অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা এবং সেন্ট কিট্স ও নেভিস। কমনওয়েলথপ্রধান ছাড়াও তিনি ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমনওয়েলথ অব নেশনসেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুক্তরাজ্যের শাসনকর্তা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডেরও প্রধান। সুদীর্ঘ সাত দশক প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থেকে রানি এলিজাবেথ মানুষের কল্যাণে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।

 

২ জুন থেকে শুরু হয়েছে রানির সিংহাসনে আরোহণের রাজকীয় উদ্যাপন, যেটি শেষ হচ্ছে ৫ জুন রবিবার।  রানির শাসনামলের প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে চার দিনের ছুটি চলছে যুক্তরাজ্যে।

রাজপরিবারের আয়োজন সফল করতে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ও। ঐতিহাসিক স্টোনহেঞ্জে ১৯৫৩ সালে রানির অভিষেকের ছবি প্রজেক্টরের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে পাথরের গায়ে।

‘ট্রুপিং দ্য কালার’ প্যারেড, রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ফ্লাই-পাস্ট, যা বাকিংহামের বারান্দা থেকেই উপভোগ করেছে রাজপরিবার। এবার অবশ্য রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যকে বারান্দায় দেখা যায়নি।

৫ জুন সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘জুবিলি পেজেন্ট’। সামনে থাকবে রানির রাজকীয় রথ। বয়সের কারণে রথে না থাকলেও রানির ৭০ বছরের জীবন প্রজেক্টরের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে।

 

 

যে তথ্যগুলো আপনাকে বিস্মিত করবে

রানির কোনো পাসপোর্ট নেই। রাজপরিবারের সদস্য হওয়ায় তাঁকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয় না। এটি ছাড়াই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরতে পারেন।

টেমস নদীর সব রাজহাঁসের মালিক রানি এলিজাবেথ। এ নদীর মুক্ত পানিতে যেসব হাঁস ঘুরে বেড়াবে তা সব রানির। যখন এই হাঁসগুলোকে মানুষ ধরতে শুরু করে, তখন এই তথ্য উঠে আসে।

যুক্তরাজ্যে একমাত্র রানিই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারেন। তাঁর গাড়ির কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর দরকার নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ড্রাইভিং শিখেছেন।

রানির ব্যক্তিগত কবি আছে। ব্রিটিশ সোসাইটির মাধ্যমে তিনি রাজকবির নিয়োগ দেন। কবির বাৎসরিক বেতন ২০০ পাউন্ড। সঙ্গে এক পিপে ক্যানারি ওয়াইন বোনাস।

প্যালেসের ভিতরে কিংবা ক্যামেরার বাইরে একসঙ্গে থাকলেও জনসম্মুখে ও ক্যামেরার সামনে স্বামীর সঙ্গে রানি এলিজাবেথের হাঁটা নিষেধ। জনসম্মুখে স্বামীর থেকে দুই কদম আগে চলতে হয়।

রানি এলিজাবেথের ক্ষেত্রে কোনো ডিনার বা পার্টিতে খাওয়ার সময় কথা বলা নিষেধ। যদি তিনি কথা বলতে চান, তাহলে তাঁর ডান পাশের অতিথি কারও সঙ্গে কথা বলা শুরু করতে হবে।

রানির পক্ষ থেকে কোনো পার্টি রাখা হলে সেখানে কখনো ১৩ জন অতিথি থাকতে পারবেন না। ১৩ জনের কম অথবা বেশি হলে সমস্যা নেই।

রানি বড় সেলিব্রিটি হলেও তিনি কখনো অটোগ্রাফ দিতে পারবেন না। শুধু তিনি নন, রাজপরিবারের সবার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।

রাজপরিবারের সদস্য হলেও তাঁরা চাইলেই পছন্দমতো যে কোনো খাবার খেতে পারেন না। রানি এলিজাবেথসহ রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য চিংড়ি, আদা, পিঁয়াজ, ট্যাপের পানি খাওয়া নিষেধ।

হাতমোজা ছাড়া রানি কোথাও যেতে পারেন না। সব সময় বাইরে তাঁকে হাতমোজা পরে থাকতে হয়।  মূলত জীবাণু থেকে সুরক্ষার জন্যই রাজপরিবারের এই নিয়ম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর