রবিবার, ১২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে বিপদকালের হিরোরা

বিশ্বজুড়ে বিপদকালের হিরোরা

প্রায়ই খবরের শিরোনাম কেড়ে নেয় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।

হামলায় বিপদগ্রস্ত মানুষ প্রাণে বাঁচতে হয়ে পড়েন দিশাহারা। প্রাণ বাজি রেখে তখন এগিয়ে আসেন সত্যিকারের নায়করা।  বাস্তব জীবনের এমন হিরোদের দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযানের গল্প ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। তাদের কেউ কেউ অন্যের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে ত্যাগ করেন নিজের জীবন। দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলায় মিলেছে এমন কয়েকজন সত্যিকারের হিরোর দেখা।  তাদের কথা লিখেছেন- আবদুল কাদের

 

কার্লোস অ্যারেডন্ডো

দ্য বস্টন ম্যারাথন বোম্বিং

২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল। বস্টনে ম্যারাথনের শেষ পর্যায়ে। লাইন অতিক্রম শেষ হলে মিলবে বিজেতা। কিন্তু হঠাৎ প্রকান্ড বোমা হামলা। মুহূর্তে উল্লাসে ভরা মাঠ পরিণত হলো রণাঙ্গনে। ভয়াবহ সেই বোমা হামলায় তিনজন নিহত এবং আহত হন প্রায় ২৬৪ জন। সেদিন বেশির ভাগ মানুষই প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। এর মাঝেও কিছু মানুষকে দেখা যায় স্রোতের বিপরীতে। তারা ডানদিক দিয়ে ছোটেন ধোঁয়ায় ঘেরা হামলা প্রাঙ্গণে। তারা নিজের জীবনের চিন্তা করেননি। তখন তাদের মাথায় ছিল কেবল একটি কথা, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। কার্লোস অ্যারেডন্ডো ছিলেন সেই ভাগ্যবানদের একজন। হামলার শুরু থেকেই আহতদের উদ্ধারে কাজ করেন অ্যারেডন্ডো। জেফ বুমান ছিলেন অ্যারেডন্ডোর হাত পাওয়াদের একজন। যিনি ছিলেন ম্যারাথনের দৌড় শেষ করার লাইনের ডানে। বুমানের পা তখন বোমার আঘাতে জর্জরিত। তখন তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম এবং তিনি অ্যাম্বুলেন্সের হুইসেলও শুনতে পাচ্ছিলেন। তখন ভিড় ঠেলে অ্যারেডন্ডো তাকে কোলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন। এভাবেই বুমান সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন তার অসহায়ত্ব ও অ্যারেডন্ডোর বীরত্বের গল্প।  অ্যারেডন্ডো সেই হামলার পর গোটা রাজ্যের হিরো বনে যান। কেননা তার উদ্ধারের মুহূর্ত বহু ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় বন্দি হয়। তবে অ্যারেডন্ডো একা নন, সেদিন ম্যারাথনে এক দম্পতিও উপস্থিত ছিল। তারা মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাশের একটি কফি শপ থেকে ন্যাপকিন নিয়ে ছোটাছুটি করেন। এখানে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই।

 

রবার্ট অ্যাঙ্গল

ব্রুনেট চ্যাপেল চার্চ শুটিং

২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। ব্র“নেটের ‘চ্যাপেল চার্চ অব ক্রাইস্ট’-এর সামনে ইমানুয়েল স্যামসন গাড়ি পার্ক করেন। হাতে একটি পিস্তল। গাড়ি থেকে নেমেই পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে গুলি করেন। এরপর চার্চের পেছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আরও ছয়জনকে গুলি করে আহত করেন স্যামসন। শুনে মনে হতেই পারে, নিশ্চয় কোনো হলিউড মুভির জমজমাট সিক্যুয়াল ট্রেইলার। কিন্তু না, তেমন কিছু নয় আবার বেশি দিন আগেরও নয়, এমনই ঘটনা ঘটে গেল গেল ২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র্রের টেনিসির ন্যাশভিলে।

যদিও ঘটনাটি বেশ ভয়ানক সময় ছিল, কিন্তু অ্যাঙ্গল কয়েক গুণ বেশি খারাপ হয়ে যান স্যামসনের সামনে। তাও আবার নিরস্ত্র। অ্যাঙ্গল স্যামসনের দিকে ছুটে আসেন এবং হাতে থাকা পিস্তলটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। স্যামসন পিস্তল দিয়ে অ্যাঙ্গলের মাথায় ও শরীরে জোরে আঘাত করতে থাকেন। অ্যাঙ্গল নাছোড়বান্দা, কিছুতেই হার মানবেন না। শেষ পরিণতি ঘটল ঠিকই! বন্দুকধারী স্যামসনের হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল ও দুর্ঘটনাবশত তার বুকেও গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ না আসা পর্যন্ত অ্যাঙ্গল তাকে গাড়িতে আটকে রাখেন। মেট্রো ন্যাশভিল পুলিশপ্রধান স্টিভ অ্যান্ডারসন সাংবাদিকদের জানান, ‘সে হিরো, স্যামসনের মতো উন্মাদ ব্যক্তিকে আটক করেছে।’ রবার্ট অ্যাঙ্গল পরে সাংবাদিকদের জানান, ‘শুটার ও তার পরিবার এবং বন্ধুদের জন্য প্রার্থনা করুন। তারাও কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতি করতে পারে।’

 

মার্কুইজ মার্টিন

দ্য শার্লটসভিল অ্যাটাক

২০১৭ সালের ১২ আগস্ট। বিক্ষোভ চলছিল সেদিন। কারণ ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিল শহর থেকে মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়ের কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট ই লির মূর্তিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদে পথে নামে দক্ষিণপন্থিরা। সকাল থেকেই লি প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়েছিল সবাই। কারও পরনে কালো টি-শার্ট আর কারও পায়ে বুট। প্রতিবাদ মিছিলে হঠাৎ গাড়ি হামলা। আর হামলার মূল হোতা ২০ বছরের শ্বেতাঙ্গ তরুণ জেমস অ্যালেক্স ফিল্ড জুনিয়র। হামলায় নিহত হন ৩২ বছর বয়সী হিথার হেইরি। বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশে নিহত হেইরির বন্ধু মারিসা ব্লেয়ার ও মার্কুইজ মার্টিন। বিক্ষোভের দিন তারা একসঙ্গেই ছিলেন। তারা ছিলেন হেইরির ডানে। হঠাৎই একটি গাড়ি উঠে যায় হেইরির ওপর। হেইরি তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু পাশে বান্ধবী মারিসা বেঁচে যান। কারণ মার্টিন মারিসাকে বাঁচান। মার্টিন যখন দেখেন গাড়িটি তাদের দিকে ছুটে আসছে তখন তিনি মারিসাকে লাইন থেকে বের করে দেন। কিন্তু হেইরিকে সরাতে পারেননি। ততক্ষণে হেইরি অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। রাস্তা তখন রক্তাক্ত। মার্টিন গাড়িটি ভাঙতে গেলে গাড়িটি তার ওপরে উঠিয়ে দেন ভিতরে থাকা জেমস। মার্টিন বেঁচে যান ঠিকই কিন্তু পা ভেঙে যায়। মার্টিন নিজে আহত হলেও হবু স্ত্রী মারিসার জীবন বাঁচান। হেইরির শেষ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মারিসা মার্টিনকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে আসেন। মারিসা গণমাধ্যমকে জানান, ‘সেদিন যদি মার্টিন আমায় বের করে না দিত তবে আজ নিজের পায়ে হেঁটেই আসতে পারত।’

 

অ্যালেক্স তেভেজ

দ্য অরোরা থিয়েটার শুটিং

২০ জুলাই ২০১৭। কলোরাডোর অরোরা শপিং মলের সেঞ্চুরি সিনেমা হল। চেয়ার খালি নেই একটিও। শুরু হলো ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’। মন্ত্রমুগ্ধ ৫০০ দর্শক কখনো হাততালি, কখনো মুখের অর্থহীন শব্দ। কিন্তু হঠাৎ জেমস হোমস ছবির প্রিমিয়ারে ডেনভার শহরে ঘটল কান্ডটা! জেমস একটা ব্যাকপ্যাকে টিয়ার গ্যাস ও মারণাস্ত্র নিয়ে ঢুকে গেলেন হলের ভিতরে। গ্যাসমাস্ক পরিহিত জেমস এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করেন। নিমেষেই লুটিয়ে পড়ে ১২ প্রাণ। ভয়াল সেই মুহূর্ত। ভয়াল সেই হামলার সাক্ষী আমান্ডা লিডগ্রেন। কীভাবে তার প্রেমিক অ্যালেক্স তেভেজ তার প্রাণরক্ষা করেছিলেন সে গল্পটি নিজেই জানান সাংবাদিকদের। ‘যখন গোলাগুলি শুরু হয়, আমি প্রচ- ভীত ছিলাম। চোখের সামনে নিথর দেহ দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে যাই। তখন অ্যালেক্স মোটেও দ্বিধা করেনি। অ্যালেক্স আমাকে টেনে তার নিচে নিয়ে আবৃত করে রেখেছিল।’

গার্লফ্রেন্ডকে বাঁচিয়ে নিজের শরীরে গ্রহণ করে ঘাতক বুলেট। শুধু অ্যালেক্সই নন, সে মুহূর্তে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন আরও কয়েকজন। জন লারিমার, ম্যাথু ম্যাককুইন ও জন ব্ল্যাক প্রেমিকার জীবন বাঁচাতে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয়। শুধু তাই নয়, কলিজার টুকরা কন্যাকে বাঁচাতে এক বাবাও নিজের জীবন বিলিয়ে দেন সেদিন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে অ্যালেক্সসহ আরও চারজন সেদিন সত্যিকারের নায়ক হন।

 

জেসুস ক্যাম্পস

লাস ভেগাস স্ট্রিপ শুটিং

২০১৭ সালের ঘটনা। মঞ্চে তখন গায়ক জেসন অ্যাল্ডিন। গিটারের সুরে উত্তাল আনন্দে ভাসছে লাস ভেগাসের ম্যান্ডেলে বের বাইরে হাজার হাজার দর্শক। হঠাৎ গিটারের শব্দ ছাপিয়ে মেশিনগানের আওয়াজ! টানা ৯ সেকেন্ড অবিরত এলোপাতাড়ি গুলি। মানুষের ছোটাছুটি আর চিৎকার। থেমে গেল সংগীত। সেই কনসার্টে স্টিফেন প্যাডক ম্যান্ডেলে বের ৩০ তলা থেকে গুলি করে ৫৮ জনকে হত্যা করেন। হামলায় পাঁচ শর বেশি আহত হন। এটি আমেরিকার ইতিহাসে ভয়াবহ বন্দুক হামলা। যে হামলার ভিলেন ছিলেন স্টিফেন প্যাডক এবং পুরো লাস ভেগাসের মানুষ ছিল হিরো। তাদের মধ্যে একজন জেসুস ক্যাম্পস। ক্যাম্পস মান্দালায় বে হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনিউর সিকিউরিটি গার্ড। গুলি শুরু হতেই তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে হত্যাযজ্ঞ বন্ধের চেষ্টা চালান। তার হাতে ছিল না কোনো অস্ত্র এবং তিনি জানতেন বন্দুকধারী প্যাডকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। ক্যাম্পস দ্রুত প্যাডকের রুম খুঁজে বের করে দরজা ভাঙার চেষ্টা চালান। কিন্তু রুমটি ভিতরে ব্যারিকেড দেওয়া। দরজায় আঘাতের শব্দ শুনে প্যাডক ভিতর থেকে দরজায় গুলি চালান। গুলি লাগে ক্যাম্পসের পায়ে। রক্ত ঝরছিল, তবুও ক্যাম্পস থেমে যাননি। দরজায় দাঁড়িয়ে স্পেশাল পুলিশ ‘সোয়াত’কে দেখিয়ে দেয় প্যাডকের অবস্থান। ক্যাম্পস বন্দুকধারীকে থামাতে পারেননি, কিন্তু কিছু সময়ের জন্য তার দিকে ব্যস্ত রাখেন। তাতেই বেঁচে যান অসংখ্য মানুষ।

 

ইমরান ইউসুফ

অরল্যান্ডো পালস নাইটক্লাব অ্যাটাক

অরল্যান্ডোর পালস নাইটক্লাব তখন বেশ জমজমাট। ক্লাবের বাইরে গার্ড দিচ্ছিলেন ইমরান ইউসুফ। শুধু তিনি নন, অনেক বাউন্সারই সেদিন দায়িত্বে ছিলেন। সিকিউরিটি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ২৯ বছর বয়সী নিরাপত্তাকর্মী ওমর মতিন। সব বাউন্সারের পাশ কাটিয়ে মতিন ক্লাবের ভিতরে ঢুকে যান। তবে তখন যদি ক্লাবের দরজা দিয়ে মতিনকে ভিতরে ঢুকতে না দেওয়া হতো, সম্ভবত এই রক্তাক্ত পালস ক্লাব দেখতে হতো না। কিন্তু ভাগ্য! ২০১৬ সালের ২ জুন, অরল্যান্ডোর ইতিহাসে দিনটি কালো হয়ে থাকল। হঠাৎ ভিতর থেকে গুলির শব্দ শুনে বাউন্সার ইউসুফ সদর দরজার দিকে দৌড় দিলেন। দরজার কাছে যেতেই ইউসুফ তখন তার হ্যান্ডগানের মুখোমুখি। ভাগ্যক্রমে মতিন তাকে খেয়াল করেননি আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউসুফ পালস ক্লাবের পেছনের গেট দিয়ে ৬০-৭০ জনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলে আসেন। সিকিউরিটি মতিনের শটগানের ঘাতক বুলেট ইতোমধ্যে প্রাণ কেড়ে নেয় ৪৯ জনের। আর সেই হামলায় আহত হন প্রায় ৫৮ জন। এ হামলায় ইউসুফ নিজের জীবন বাজি রেখে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন অনেকের। অতর্কিত এ হামলা সম্পর্কে ইউসুফকে স্থানীয় সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, আপনি সেদিন কী করেছিলেন? প্রশ্নের জবাবে ইমরান ইউসুফ তখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আরও অনেককেই বাঁচাতে পারতাম। পারিনি, সময়ই পাইনি, এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়’। পালস ক্লাবের সেই রাতে ৩২০ জন লোক ছিলেন। হামলায় হ্যান্ডগান ও এআর-১৫ অস্ত্র দুটি ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে মতিন প্রাণ হারান।

 

লাসানা বেথলি

দ্য লি ডি ফ্রান্স অ্যাটাক

সময়টা ছিল ৭ জানুয়ারি ২০১৫। অন্যান্য দিনের মতোই ফ্রান্সের হাইপার চেকারের কোশার সুপার মার্কেটটি চালু হয়। সেদিনও ভিড় ছিল ক্রেতাদের। হঠাৎই বদলে যায় দৃশ্যপট। গুলির শব্দ ও ভীত মানুষের ছোটাছুটিতে মার্কেট প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এবদোর কার্যালয় থেকে এর ভয়াবহতা শুরু। চলে তিন দিন; ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। তিন মুখোশধারী ওই তিন দিনে হত্যা করে ১৭ জনকে। ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের মাঝেও সেদিন দেখা গিয়েছিল মানবতা। সেদিন পর্দার মতো বাস্তব জীবনের হিরো হয়ে যান সুপার মার্কেটটির এক মুদি দোকানের কর্মচারী লাসানা বেথলি। একা জীবন বাজি রেখে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচান। বেথলি যখন সন্ত্রাসীর গুলির শব্দ শোনেন, তখন নিরাপত্তার জন্য অন্য দোকানিদের একত্রিত করে সবাইকে নিয়ে যান মার্কেটের বেসমেন্টের এক কোল্ড স্টোরেজ রুমে। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরবর্তীতে সাংবাদিকদের জানান, বেথলি অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেদিন। কোল্ড স্টোরেজ রুমে আমাদের রেখে বলে, ‘তোমরা সবাই এখানে চুপ করে বস, আমি বাইরে যাচ্ছি এবং ফিরে আসব।’ আতঙ্কিতরা সবাই গাদাগাদি করে রুমে বসে ছিল। বেথলি রুমের ফ্রিজার ও আলো বন্ধ করে পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য যায়। পুলিশ খুঁজে পেতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। লিফট দিয়ে মার্কেটের বাইরে বেরিয়ে আসতেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে এবং তার হাতে হাতকড়া লাগায়। বেথলি মনে করেছিলেন, পুলিশকে বোঝাতে পারবেন যে তিনি  জঙ্গি নন। পরে বেথলি পুলিশকে দোকানের ম্যাপ ও কোলিবেলির সন্ধান দেন যেখানে আতঙ্কিতরা ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন। পুলিশ বেথলির সাহায্যে ফ্রিজার রুম থেকে ১৫ জন বন্দিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

 

রয় লার্নার ও ইগনাসিও ইচিভেরিয়া

লন্ডন ব্রিজের সন্ত্রাসী হামলা

সন্ত্রাস যেন পিছু ছাড়ছে না ব্রিটেনের। ৩ জুন ২০১৭। লন্ডন ব্রিজ কেঁপে উঠেছিল সন্ত্রাসী হামলায়। অন্যান্য দিনের মতোই জমজমাট ছিল রাস্তাঘাট, রেস্তোরাঁ ও নাইটক্লাব। লন্ডন ব্রিজে তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল একটি ভ্যান। আচমকাই তা উঠে যায় ফুটপাথে থাকা পথচারীদের ওপর। কিছুদূর যাওয়ার পরই ভ্যান ছেড়ে লাফিয়ে নামে তিন আততায়ী। প্রত্যেকের হাতেই ছুরি। পাব রেস্টুরেন্ট এবং বারে ঢুকে এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে থাকেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এক ফুটবলপ্রেমী রয় লার্নার। তিনি তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন দুর্বৃত্তদের ওপর। লার্নারকে দুর্বৃত্তরা পাঁচবার ছুরিকাঘাতে আহত করেন। লার্নার তবুও থেমে যাননি। তিনি সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থামাতে পুরোপুরি সমর্থ হননি। এরপর সন্ত্রাসীরা কাছাকাছি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছুরিকাঘাত করতে থাকেন। সন্ত্রাসীদের থামাতে শুধু লার্নারই নন, ৩৯ বছর বয়সী স্প্যানিশ ইগনাসিও ইচিভেরিয়াও ছিলেন সেখানে। অসহায় নারীদের ওপর যখন হামলা হচ্ছিল তখন ইচিভেরিয়া দৌড়ে আসেন এবং তার হাতে থাকা স্কেটবোর্ড দিয়ে দুর্বৃত্তদের মারা শুরু করেন। এক দুর্বৃত্তকে তিনি আটকালেও অন্য দুর্বৃত্তরা পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করেন। ইচিভেরিয়া দুর্বৃত্তদের সঙ্গে লড়াই করে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যাওয়ার আগেই পুলিশ তিন দুর্বৃত্তকে গুলি করে মেরে ফেলে। সেদিন ইচিভেরিয়া ও লার্নার সন্ত্রাসীদের দেখিয়েছিলেন যে, তারা নিরস্ত্র হলেও তাদের শহরে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিহত করতে তারা প্রস্তুত।

 

কেলি ব্রিউস্টার

ম্যানচেস্টার অ্যারিনা বোম্বিং

২০১৭ সালের ২২ মে। ব্রিটেনের ইনডোর স্টেডিয়াম ম্যানচেস্টার অ্যারিনায় অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে। শ্রোতাদের দিকে উড়ে যাচ্ছে বেলুন। আর তা হাতে নিয়ে দর্শকরা বেরিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ। মানুষের আর্তচিৎকার আর কান্নার রোল। মুহূর্তেই বদলে গেল দৃশ্যপট। এ হামলায় নিহত হন ২২ জন। আহত হন ৬০ জন। নিহতের মধ্যে ৩২ বছরের কেলি ব্রিউস্টার রয়েছেন, যিনি ১১ বছরের ছোট ভাতিজিকে বাঁচিয়ে নিজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন। অ্যারিনার গ্র্যান্ড কনসার্টে কেলি ও তার ছোট বোন ক্লেলায়ার এবং ভাতিজি হোলি বোথ একসঙ্গেই ছিলেন। বোম্ব ব্লাস্টের সময় কেলি বোথের সামনে এসে দাঁড়ান। বোথ আঘাত পেলেও বেঁচে যায়। কেলি ঘটনাস্থলেই মারা যান। প্রতিদিনের মতো ক্রিস পার্কার সেখানে যান সাহায্যের জন্য। ক্রিস সেদিন ইনডোর স্টেডিয়ামের ভিতরে ফ্লোরে ছিলেন। বোমার আঘাতের পর তিনি দ্রুত আতঙ্কিত অসহায় মানুষগুলোকে বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ক্রিস পার্কার সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি সেখানে একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখি। ওর পা ছিল না। মেয়েটির রক্তাক্ত পা টি-শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ ভয়াল সেই মুহূর্তে কনসার্ট হলের বাইরে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছিলেন পাওলি রবিনসন। বোমার শব্দ শুনে তিনি ও তার স্বামী দৌড়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। পাওলি ৫০ জন অল্প বয়সের বাচ্চাকে স্টেডিয়ামের বাইরে বের করে আনেন।

 

ভিক্টোরিয়া সতো

স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুল শুটিং

১৪ ডিসেম্বর ২০১২ সাল। অন্যদিনের মতো সেদিনও স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে ছিল ছোট্ট ছোট্ট সোনামণিদের হৈহুল্লোড়। হলিউডের মুভিতে দেখা যায় যেমনটি। ঠিক তেমনি ছিল পরিবেশ। হঠাৎ বছর কুড়ির বন্দুকধারী অ্যাডাম লাঞ্জা কানেক্টিকাটের ওই স্কুলে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করেন ২০ শিশুসহ মোট ২৮ জনকে। হত্যার সেই তালিকায় অ্যাডামের জন্মদাত্রী মা-ও ছিলেন। হত্যা হওয়া সেই অভাগাদের তালিকায় রয়েছেন প্রথম শ্রেণির শিক্ষক ভিক্টোরিয়া। তিনি হয়তো বেঁচে যেতেন, কিন্তু তার স্কুলের ছোট্ট সোনামণিদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই জীবন বিসর্জন দেন। স্কুলে গুলি শুরু হলে, ভিক্টোরিয়া দ্রুত বাচ্চাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভয়াল সেই মুহূর্তে কাউকে স্কুলের বাথরুমে, কাউকে ক্লাসের আলমারিতে লুকিয়ে রাখেন। বন্দুকধারী অ্যাডাম তার ক্লাসের কাছে আসার আগেই ভিক্টোরিয়া তার স্কুলের সোনামণিদের চোখের আড়াল করেন এবং সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। ক্লাসরুমের দরজা তখন বন্ধ। অ্যাডাম জোরপূর্বক দরজা খোলেন এবং ভিক্টোরিয়াকে জিজ্ঞেস করেন বাচ্চারা কোথায়? ভিক্টোরিয়া বোঝানোর চেষ্টা করেন বাচ্চারা স্কুলের জিমে চলে গেছে। এর পরই অ্যাডাম ভিক্টোরিয়াকে গুলি করে হত্যা করেন। পুরো স্কুলে হত্যা তান্ডব চালিয়ে অ্যাডাম নিজেও আত্মহত্যা করেন। ভিক্টোরিয়ার শেষ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে সবাই বলেন, ‘ভিক্টোরিয়া সন্তানদের জন্য তার জীবন বাজি রেখেছিলেন। তার শেষ কাজটি ছিল নিঃস্বার্থ, খ্রিস্টের মতো।’

সর্বশেষ খবর