১৬৮২ সালে ডিউক অব ইয়র্ক জেমসকে নিয়ে যাত্রা করেছিল ‘দ্য গ্লুসেস্টার’। কিন্তু ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূল নরফোকের গ্রেট ইয়ারমাউথের কাছে এসে ঝড়ের কবলে পড়ে ইংরেজ নৌবাহিনীর রণতরী। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় সাগরতলে। ২০০৭ সালে সেই জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ মেলে নরফোকের উপকূলে। সম্প্রতি গবেষকরা সেই জাহাজের তথ্য উন্মোচন করেন। লিখেছেন - আবদুল কাদের
‘দ্য গ্লুসেস্টার’ মূলত ইংরেজ নৌবাহিনীর জন্য নির্মিত বিশাল যুদ্ধজাহাজ, যা ১৬৫৩ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৬৫৪ থেকে ১৬৬০ সালে অ্যাংলো-স্প্যানিশ যুদ্ধ এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে জাহাজটি অংশ নিয়েছিল। ১৬৮২ সালে জাহাজটি বালির ঢিবির সঙ্গে সংঘর্ষের পর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়...
যেভাবে খোঁজ মিলল জাহাজের
ভবিষ্যৎ রাজা জেমস স্টুয়ার্টকে বহন করার সময় ১৬৮২ সালে ডুবে যাওয়া ইংরেজ নৌ যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষ নরফোক উপকূলে আবিষ্কৃত হয়। ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূলের গ্রেট ইয়ারমাউথ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে জাহাজটির সন্ধান মেলে। চার বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে জুলিয়ান ও লিংকন বার্নওয়েল নামের দুই ভাই ২০০৭ সালে যুদ্ধজাহাজটি আবিষ্কার করেন। অনুসন্ধানে সহযোগিতায় ছিলেন তাদের প্রয়াত বাবা এবং দুই বন্ধু। এরপর থেকে এ জাহাজের তথ্য আড়ালেই রেখেছিলেন তারা। ৩৪০ বছর আগের পুরনো জাহাজটি তৎকালীন ইংরেজদের নৌবাহিনী ব্যবহার করত। জানা গেছে, ১৬৫২ সালে ব্রিটিশ নৌ-কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাহাজটি নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশরা ১৬৫৪ থেকে ১৬৬০ সালে অ্যাংলো-স্প্যানিশ যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে জাহাজটি ব্যবহার করেছিল। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে লেগে পরিবারের ক্রেস্টসহ সিলযুক্ত একটি কাচের বোতল। লেগে হচ্ছে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের পূর্বপুরুষ। জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া অন্যান্য প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে- নেভিগেশন সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, জামাকাপড় ও মদের বোতল। কিছু কিছু জিনিস এখনো অক্ষত রয়েছে। ডাইভিং বিষয়ে কাজ করা লিংকন বার্নওয়েল বলেন, ‘সমুদ্রতটে নামার পর সাদা বালুর ওপর বড় কামান পড়ে থাকতে দেখি, যা ছিল অনেক পুরনো।’ সামুদ্রিক ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্লেয়ার জোভিটের মতে, ‘দ্য গ্লুসেস্টার জাহাজটি দ্রুত ডুবে গিয়েছিল বলে কেউ কিছু উদ্ধার করতে পারেনি। ১৯৮২ সালে মেরি রোজ আবিষ্কারের পর থেকে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক আবিষ্কার।’
কীভাবে হারিয়ে যায়
১৬৮২ সালের ৬ মে; সময় তখন আনুমানিক সকাল ৫টা ৩০ মিনিট। ‘দ্য গ্লুসেস্টার’ ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে নরফোকের গ্রেট ইয়ারমাউথে এক বালুর ঢিবির সঙ্গে ধাক্কা খায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাহাজটি গভীর সাগরে হারিয়ে যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, পূর্ব দিক থেকে আসা একটি শক্তিশালী ঝড়ের কবলে পড়ে ‘দ্য গ্লুসেস্টার’। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জাহাজটি বালুর ঢিবির সঙ্গে ধাক্কা খায়। পরক্ষণেই জাহাজের মাস্তুল ভেঙে যায় এবং জাহাজটি ছিদ্র হয়ে সাগরে তলিয়ে যায়। জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশদের ভবিষ্যৎ রাজা ডিউক অব ইয়র্ক। তিনি কিং জেমস টু নামে বেশি পরিচিত। অল্পের জন্য বেঁচে যান ডিউক অব ইয়র্ক এবং জন চার্চিল। জাহাজটি ডুবে যাওয়ার আগেই রাজা ডিউক অব ইয়র্ক ছোট একটি নৌকায় করে তীরে আসেন। ওই দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেলে হয়তো ব্রিটিশ ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। কিন্তু সেদিন দুর্ঘটনায় জাহাজটির ১২০ জন নাবিকসহ আরও অনেক যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল। ডুবে যাওয়াদের মধ্যে ছিলেন রবার্ট কের, রক্সবার্গ আর্ল তৃতীয়, ডনাফ ও’ব্রায়েন, লর্ড ইব্রাকান এবং হোপেটাউনের স্যার জন হোপ এবং হোপ অফ ক্রেইঘল। ইতিহাসবিদদের মতে, ওই জাহাজ দুর্ঘটনায় ১৩০ থেকে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সামুদ্রিক প্রটোকলের অন্য যাত্রীদেরও ঘটনাস্থল পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যৎ রাজা ডিউকও সেদিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। কারণ জাহাজের কেমন ক্ষতিসাধন হয়েছিল তা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও ওই দুর্ঘটনার জন্য ডিউক জাহাজের ক্যাপ্টেন জেমস আইরেসকে দায়ী করেছিলেন।
কেমন ছিল সেই জাহাজ
ইংরেজ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস গ্লুসেস্টার। জাহাজটির অভ্যন্তরীণ ডেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৭ ফুট (৩৫.৭ মিটার) এবং উচ্চতা প্রায় ৩৪ ফুট ১০ ইঞ্চি (১০.৬ মিটার)। এর গোলাবারুদ বহনের স্থানের গভীরতা প্রায় ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি (৪.১ মিটার)। ১১/৯৪ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজে মূলত ৫০টি কামান বহন করা হতো। ১৬৬৭ সালের যুদ্ধে জাহাজে ৫৭টি কামান (১৯টি ডেমি-কামান, চারটি কালভারিন ও ৩৪টি ডেমি-কালভারিন) বহন করা হয়। জাহাজে প্রায় ২১০-৩৪০ জন অফিসার ও ক্রু নিয়োজিত ছিলেন।
রাজকীয় যুদ্ধজাহাজ
‘দ্য গ্লুসেস্টার’, ইংরেজ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। যা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজাকে বহনকারী জাহাজও। রাজকীয় এই জাহাজের নামকরণও করা হয়েছিল সে সময়কার বন্দর নগরী গ্লুসেস্টার-এর নামেই। ১৬৫২ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ নৌ-কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই যুদ্ধজাহাজটি নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ মাস্টার শিপরাইট ম্যাথিউ গ্রেভসের নির্দেশে পূর্ব লন্ডনের লাইমহাউসে জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল। ১৬৫২ সালে শুরু হওয়া জাহাজের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ সালের মার্চ মাসে। বিশালাকার এই জাহাজের নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৫ হাজার ৪৭৩ পাউন্ড।