বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসের উদ্বোধনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে তত মনে অনুরণন তুলছে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের পদ্মাপাড় নাটকের কালজয়ী গান ‘বাবু সেলাম বারে বার’। যেখানে পদ্মাপাড়ের গয়া বাইদা ও বেদেনী চম্পাবতীদের জীবন ও জীবিকার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে বড় মর্মস্পর্শী অবয়বে। ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট একনেক সভায় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য হিসেবে আমি পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রথম পাসের প্রস্তাব যখন উত্থাপন করেছিলাম সে মুহূর্তে গানটির-‘মোরা এক ঘাটে রান্ধি বাড়ি আর আরেক ঘাটে খাই, মোদের দুখের সীমা নাই’ আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অন্য ধরনের একটা প্রেরণাবোধ করেছিলাম পদ্মার পশ্চিম পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার কপোলে সৌভাগ্যের তিলক রেখা আঁকার আকিঞ্চন আকাক্সক্ষায়। ইতিহাসের পাতায় নিঃসন্দেহে পরিকীর্তিত হবে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, যেদিন বাংলাদেশ সরকার চিঠি দিয়ে বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ নেওয়া হবে না। যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি ঋণের পর্ব শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পালা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনগণ সারা জীবন অবহেলিত ছিল, পদ্মা সেতু হলে তারা অবহেলিত থাকবে না। কারণ, একটা জায়গায় যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়, তাহলে সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই উন্নত হয়। এটাই হলো বাস্তবতা। সেদিন সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতি জোরদারে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখবে’ এবং যে কারণে ‘দক্ষিণাঞ্চলের জনগণকে উন্নত জীবন উপহার দিতেই’ সেদিন এই দৃঢ়চিত্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। অনেক প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পদ্মা সেতু স্বপ্ন থেকে আজ বাস্তবতায় দেদীপ্যমান। সেতু নির্মাণের নানান দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু এর দ্বারা সেদিনের সেই ‘অয়োময় প্রত্যয় ও সাহসের সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন’কে সম্মান, স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে কার্পণ্য বা অবমূল্যায়নের কোনো অবকাশ নেই।
জাতীয় অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং উপযোগিতা অপরিসীম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশ্বের সেরা গহিন গড়ান বন সুন্দরবন : দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা ও পায়রা, তৃতীয়, চতুর্থ ও অষ্টম বৃহত্তম বিভাগীয় শহর খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর : বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগব্যবস্থার অনুন্নয়নের কারণে সদ্য ঘোষিত পদ্মা বিভাগের ৫টি, খুলনা বিভাগের ১০টি এবং বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ শিল্প স্থাপন খাতে তেমন কোনো উন্নতি সাধিত হয়নি। এক যুগ আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক নেটওয়ার্ক নির্মাণে ব্যাপক অগ্রগতি (বিশেষ করে ঢাকা-মাওয়া এবং জাজিরা ফকিরহাট ভায়া গোপালগঞ্জ মহাসড়ক নির্মিত) হলেও একই সঙ্গে পদ্মায় সেতু নির্মিত না হওয়ায় ওই অবকাঠামো যথা উপযোগিতায় আসছিল না। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মায় সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সমগ্র দেশের যে সংযোগ সংস্থাপিত হবে এবং এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের যে পরিবেশ সৃজিত হবে তাতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২% এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিআরডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫% বৃদ্ধি পাবে। স্বাভাবিক এবং সংগত কারণেই এ সেতু নির্মাণ দেশ ও জাতির কাছে ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প।
পদ্মা সেতু এখন শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি এখন বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। পরনির্ভরতা আর স্বনির্ভরতার সঙ্গে আত্মমর্যাদার, আত্মবিশ্বাসের আর আত্মশক্তির বিষয়টি পরস্পর প্রযুক্ত। পরনির্ভরতায় নিজেকে নতজানু হতে হয়। অধিকমাত্রায় পরনির্ভরতায় নিজের নেগোসিয়েশনের শক্তি অবদমিত থাকে। এটা ঠিক বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির উন্নতির সোপান সব সময় দেশি-বিদেশি পুঁজি বা আর্থিক সহায়তা। তাই ‘নিজস্ব অর্থায়নে’ কথিত ও নির্মিত পদ্মা সেতুর জন্য এর ভবিষ্যৎ যাত্রাপথের দিকনির্দেশনা নির্ভর করে বছর বছর দেশি-বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ সামলানোই হবে যাবতীয় সাফল্যের প্রতীক বা পূর্বশর্ত।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান।