মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস

রণক ইকরাম ও তানভীর আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস

৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস। এ দিনটিকে স্বাধীনতা দিবসও বলা হয়। মার্কিনিদের জন্য এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই উত্তর আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়ায় সম্মেলনের আয়োজন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেন। এ থেকে প্রতিপন্ন হয়েছে, উত্তর আমেরিকার উপনিবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে এ দিনটি নানাভাবে উদযাপিত হয়। সারা দেশের ছোট-বড় গির্জার ঘণ্টা একসঙ্গে বাজিয়ে ঘণ্টাধ্বনি শোনায়। সর্বপ্রথমে ফিলাডেলফিয়ার মুক্তি ঘণ্টা বাজানো হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা উদযাপনী শোভাযাত্রা করেন

 

স্বাধীনতার ঘটনা প্রবাহ

♦ ৪ জুলাই অনুমোদনের পর কংগ্রেস বেশ কটি আলাদা আকারে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। প্রাথমিকভাবে এটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়।

 

♦ এই সংস্করণটি ব্যাপকভাবে বিতরণ ও প্রচার করা হয়। মুদ্রণে ব্যবহৃত মূল কপিটি যেটি এটি জেফারসন নিজের হাতে লেখা কপি ছিল। তা কোনোভাবে হারিয়ে যায়।

 

♦  জন অ্যাডামসন ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের দ্বারা তৈরি চূড়ান্ত খসড়াটি অবশ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষিত আছে। সেখানে সংশোধন, টিকা পরিমার্জনগুলো ধরা আছে। যা আস্ত ইতিহাসের দলিল।

 

♦ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং স্বাক্ষর করা যে সংস্করণটি দফতরের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল আর্কাইভে প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে।

 

♦ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিভিন্ন দেশকে সাহস জোগায়। আরও অনেক এমন ভুক্তভোগী দেশগুলোকে স্বাধীনতার উৎসাহী করে তোলে পরে ক্যারিবিয়ান, স্প্যানিশ আমেরিকান, বলকান, পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত অনুসৃত হয়।

 

♦ ১৭৭৬ সালের জুলাইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার সময়, আমেরিকান দেশগুলোর ১৩টি উপনিবেশ ও গ্রেট ব্রিটেন এক বছরেরও বেশি সময় পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল। ১৭৬৩ সাল থেকে উপনিবেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করেছিল।

 

♦ যেমনটি রাজা তৃতীয় জর্জ ১৭৭৪ সালের নভেম্বরে নর্থকে লেখেন ‘নিয়তি অবশ্যই ঠিক করে দেবে তারা এ দেশের অধীন থাকতে চায় না নাকি স্বাধীন হতে চায়।’ অধিকাংশ উপনিবেশিক তখনো এমনকি ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে লেক্সিংটন ও কনকর্ডে আমেরিকান বিপ্লব যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে সমঝোতার আশা করেছিল। কিন্তু রাজা অনিচ্ছা প্রকাশ করায় আমেরিকার স্বাধীনতার পথ তখনই লেখা হয়ে যায়।

 

♦ যুদ্ধের অবসানের জন্য ব্রিটেন ও আমেরিকার মধ্যে ট্রিটি অব প্যারিস চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এ চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম হয়।

 

 

ছিল ব্রিটিশদের শাসন

১৬০৭ সালে জেমস টাউনে আমেরিকার প্রথম স্বীকৃত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশরা ওলন্দাজদের হটিয়ে দিয়ে ওলন্দাজ-অধিকৃত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এরপর স্পেন-অধিকৃত অঞ্চলেও ইংরেজরা নিজেদের শাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়। ১৭৩২ সালে পুরো অঞ্চলে উপনিবেশের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩টি। সব উপনিবেশই ছিল ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির দখল কর্তৃত্বে। ১৭৬৩ সালে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংরেজরা সমগ্র আমেরিকার ওপর নিজেদের দখল ও শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তবে ব্রিটিশ অধিকৃত সমগ্র আমেরিকায় উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেখানে তীব্র হয় স্বাধীনতার আন্দোলন, যা মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ভেঙে পড়ে ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে।

 

 

যেভাবে স্বাধীন হয় যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়কাল ধরা হয় ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত। গ্রেট ব্রিটেনের শাসনে থাকা মার্কিনিরা চায় স্বাধীনতা। ব্রিটিশদের অধীনে সে সময় ১৩ উপনিবেশ একযোগ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। সেই ১৩ উপনিবেশ হলো, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ডেলাওয়্যার, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়া। প্রথমে এই লড়াই শুধু উপনিবেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফরাসি ও স্প্যানিশদের আগমনের কারণে তা ইউরোপ, ক্যারিবীয় ও ইস্ট ইন্ডিজে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ অঞ্চলে কর আরোপের কারণে এই যুদ্ধ বেধে যায়। এই করকে মার্কিনিরা বেআইনি হিসেবে দেখত। ১৭৭৪ সালে সাফোক রিসলভস ম্যাসাচুসেটস বে প্রদেশের রাজকীয় সরকার অধিকার করলে বিদ্রোহ শুরু হয়।  পেট্রিওট মিলিশিয়া ও ব্রিটিশ নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে ১৭৭৫ সালে লেক্সিংটন ও কনকর্ডের যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহ দমন করতে বিশাল সেনা হাজির করে ব্রিটিশরা। শুরুতে তারা মার্কিন বিদ্রোহী সেনাদের পরাজিত করেছিল। ১৭৭৬ সালে নিউইয়র্ক ও ১৭৭৭ সালে ফিলাডেলফিয়া জয় করে তারা। কিন্তু ওয়াশিংটনের বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোনো হামলা করতে পারেনি ব্রিটিশ সেনারা। যুদ্ধগত কৌশলের কারণে ১৭৭৭ সালে আলবেনির বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। ফ্রান্স, স্পেন ও ডাচ প্রজাতন্ত্র ১৭৭৬ সালের শুরু থেকে গোপনে বিপ্লবীদের অস্ত্র, রসদ দিয়ে নানাভাবে সাহায্য  করে। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে ব্রিটিশ সেনারা। সারাটোগায় মার্কিনিদের বিজয়ের ফলে ব্রিটেন উপনিবেশে পূর্ণ স্বশাসনের প্রস্তাব করে। এ সময় ফ্রান্স যুদ্ধে সক্রিয় হয়। ১৭৭৯ সালে তাদের মিত্র স্পেনও এ যুদ্ধে যোগ দেয়। ফ্রান্স ও স্পেনের যোগদান ছিল বড় ঘটনা। তারা স্থল ও নৌ ক্ষেত্রে মার্কিনিদের সহায়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে উত্তর আমেরিকা থেকে পিছু হটে ব্রিটিশরা। কৌশল পাল্টে ১৭৭৮ সালের পর ব্রিটিশরা দক্ষিণ উপনিবেশগুলোতে মনোনিবেশ করে। ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে জর্জিয়া ও সাউথ ক্যারোলিনা জয় করে নেয় তারা। ১৭৮১ সালে তারা ভার্জিনিয়া দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল। এরই মধ্যে ফরাসি-মার্কিনিরা ইয়র্কটাউন অবরোধ করতে সক্ষম হয়। ৭ হাজারের বেশি ব্রিটিশ সৈনিক বন্দি হন। এর ফলে যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের ইচ্ছায় পরিবর্তন আসে। টানা কয়েক বছর যুদ্ধের পর ফরাসি বাহিনী ও জর্জ ওয়াশিংটনের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা চার্লস কর্নওয়ালিস। তবে আমেরিকার যুদ্ধ শেষ হলেও আমেরিকার যুদ্ধ সমর্থনকারী দেশ ফ্রান্স, স্পেন ও তৎকালীন ডাচ রিপাবলিকের সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ট্রিটি অব প্যারিসের মাধ্যমে ব্রিটেন আমেরিকার সার্বভৌমত্ব এবং সীমানা স্বীকার করে নেয়। সেই সঙ্গে পৃথক কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স, স্পেন ও ডাচ রিপাবলিকের সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধের অবসান হয়। এখানে মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক জন্ম ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই। কারণ দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি কংগ্রেসের অনুমোদন পেয়েছিল এ দিনে।

 

 

আবরাহাম লিংকনের নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ

১৭৭৬ সালের ঐতিহাসিক ঘোষণার পর গ্রেট ব্রিটেন থেকে উপনিবেশগুলো বেরিয়ে এসে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় যুক্তরাষ্ট্র। উপনিবেশে ১৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা ছিল কঠিন। ১৮৬১ সালের গৃহযুদ্ধে ফেডারেল বাহিনী প্রেসিডেন্ট আবরাহাম লিংকনের নেতৃত্বে জয়লাভ করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিরতরে বিলোপ হয় দাসপ্রথা। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীরা সেখানে গিয়ে দেশটির কৃষি, খনিজ, অরণ্য সম্পদকে কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রতীক্ষিত সংবিধান রচিত হলে প্রতিষ্ঠা পায় এক নতুন সরকার পদ্ধতি। প্রয়োজনে এর ছোটখাটো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অনুমতিরও ইতিহাস রয়েছে, যাকে বলে অ্যামেন্ডমেন্ট। চার বছর পর পর নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কৃষিপ্রধান সমাজে কৃষকদের সুবিধার কথা ভেবেই এটি লেখা হয়েছিল ১৮৪৫ সালে। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই শতবর্ষ ধরে চলছে এ নিয়ম। সিনেটরদের নির্বাচিত করা হয়। তারা জনগণের প্রতিনিধি। বিভিন্ন স্টেট বা অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তারা সংসদে যান এবং সত্যিকার অর্থেই তা করেন। এখন বিশ্বের এক নম্বর দেশ হিসেবে বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম যেখানে

যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাস্তবায়িত করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেসব প্রতিষ্ঠাতার মনে ও হৃদয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে জন্ম নিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যমান জন্মস্থান ফিলাডেলফিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স হল বা স্বাধীনতা মিলনায়তন, যেখানে ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়েছিল। নথিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তি এবং বিশ্বব্যাপী আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করেছে। স্বাধীনতা মিলনায়তন বা ইন্ডিপেন্ডেন্স হলে রয়েছে ‘লিবার্টি বেল’ বা ‘স্বাধীনতার ঘণ্টা’, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার সময় যে ঘণ্টা বাজিয়ে নাগরিকদের ডাকা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে যা আমেরিকার বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৭৯ সালে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স হল’কে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব হেরিটেজ সাইট’ কর্মসূচি বিশ্ব মানবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক স্থানের তালিকা করে থাকে।

 

 

সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র

উপনিবেশগুলোর বিজয়ের প্রাক্কালে ১৭৭৬ সালের ২ জুলাই দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে ভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর পাঁচজনের একটি কমিটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করে। টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সদস্য। টমাস জেফারসন ছিলেন মূল লেখক। তারা সম্মিলিতভাবে ‘ইউনাইটেড অব স্টেটস’ নামের দেশের ঘোষণা দেয়। সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়া লেখার পর তার প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য পরবর্তী দুই দিন ধরে সম্পাদনা করা হয়। ৪ জুলাই আমেরিকান কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস এই খসড়ার প্রতিটি শব্দ চূড়ান্ত অনুমোদন করে। দলিলটি এখন ওয়াশিংটন ডিসির জাতীয় সংরক্ষণশালায় প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এই ৪ জুলাইতে ফিলাডেলফিয়ার জন ডানল্যাপ সাহেব ‘ডিকেয়ার অব ইনডিপেনডেন্স’ ঘোষণাপত্রটি প্রথমবারের মতো তার ‘ডানল্যাপ ব্রডসাইড’-এ ছাপান। ব্রডসাইড হলো খবরের কাগজের মতো চওড়া একটা কাগজ, যা এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। অন্য পৃষ্ঠা খালি থাকে, যাতে এটাকে দেয়াল, বেড়া বা অন্য কোনো জায়গায় সটকানো (লাগানো) যায়। এই অরিজিনাল প্রিন্টেড কপির এক একটা তখনকার দিনের তেরোটি স্টেটেই পাঠানো হয়, যাতে তারা সবাই ঘোষণাপত্রের পুরো কথাগুলো সরাসরি জানতে পারে।

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতায় বদলে যায় বিশ্ব ইতিহাস

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। জনগণের সার্বভৌমত্বের আদর্শকে ভিত্তি করে এই প্রথম সৃষ্টি হয় এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার সমাজে অভিজাতদের প্রাধান্য হ্রাস পায়। সেখানে বুর্জোয়ারা এবং উঠতি ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীরা প্রাধান্য লাভ করে। আমেরিকার অর্থনীতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশের সুযোগ পায়। নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগও ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা উৎসাহিত হয়। অন্যদিকে লর্ডনর্থের নেতৃত্বে গঠিত টোরি-মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। পিটের নেতৃত্বে হুইগ দল ক্ষমতায় আসে। রাজার ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়। রাজা কেবল সাংবিধানিক প্রধানে পরিণত হন। আমেরিকা হস্তচ্যুত হওয়ার ফলে ইংল্যান্ডের মর্যাদা নষ্ট হয় ও ব্রিটিশ অর্থনীতি সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক নীতিতেও পরিবর্তন আসে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অত্যধিক গুরুত্বের নীতি পরিত্যক্ত হয়ে সহনশীলতার নীতি গৃহীত হয়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিকদের সাহায্য করায় ফ্রান্স অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ফলস্বরূপ সম্রাট ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলকে আহ্বান করেন। ঔপনিবেশিকদের সাহায্য করার জন্য লাফায়েতের নেতৃত্বে ফরাসি সেনা আমেরিকায় গিয়ে স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বদেশে ফিরে ফরাসিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচারে ব্রতী হয়। ফলে ফরাসি বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়। যুদ্ধের প্রভাবে আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে হল্যান্ডের দেশপ্রেমীরা তাদের রাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড প্রভৃতি দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানে বসবাস করতে যায়।

 

ফ্রান্সের উপহার স্বাধীনতার প্রতীক স্ট্যাচু অব লিবার্টি

স্ট্যাচু অব লিবার্টি এখন স্বাধীনতা ও মুক্তির একটি আন্তর্জাতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শন হয়ে উঠেছে। তামার তৈরি ৯৩ মিটার উঁচু এই মূর্তিটি ১৮৮৬ সালে ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে উপহারটি দেওয়া হয়। মূর্তিটি আমেরিকান বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠিত মিত্রতার স্মারক। ১৮৮৪ সালে ফ্রান্সে এই মূর্তি তৈরি করা হয়, এর পর মূর্তিটি কয়েক ভাগে আলাদা করে নিউইয়র্কে জাহাজে করে পাঠানো হয়, যেখানে মূর্তিটি আবার স্বরূপে সংযুক্ত করা হয়। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর হাজার হাজার উল্লসিত দর্শকের সম্মুখে মূর্তিটি স্থাপনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ককে দুই দেশেরই স্বাধীনতা ও মুক্তির আদর্শের একটি প্রতীক দ্বারা সমৃদ্ধ করতে ১৮৬৫ সালের দিকে ফরাসি আইনের অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ ও লেখক এডুয়ার্ড দ্য লাবুলে মূর্তিটির পরিকল্পনা করেন। বিশাল আকারের শিল্পকর্মের জন্য খ্যাত শিল্পী ফ্রেদেরিক-আগস্ট বার্থোল্ডিকে মূর্তিটি তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একটি মানানসই স্থান নির্বাচনের জন্য বার্থোল্ডি যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা করেন এবং নিউইয়র্ক বন্দরের বেডলোস আইল্যান্ড (১৯৫৬ সালে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় লিবার্টি আইল্যান্ড) নামক একটি ছোট দ্বীপ মূর্তিটির স্থাপনাস্থল হিসেবে নির্বাচন করেন। যেহেতু মূর্তিটি আমেরিকা ও ফ্রান্সের মধ্যকার একটি যৌথ উদ্যোগ ছিল এ জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আমেরিকানরা মূর্তিটির ভিত্তিস্তম্ভ গড়ে তুলবে এবং ফ্রান্সের জনগণ মূর্তি ও তার সংযুক্তকরণের দায়িত্ব নেবে। ফ্রান্সে নগর সরকারগুলোর কাছ থেকে, মূর্তিটির ক্ষুদ্র প্রতিকৃতির বিক্রয়মূল্য থেকে, লটারি থেকে এবং ফ্রান্সের স্কুলের শিশু ও অন্যদের অনুদানের মাধ্যমে মূর্তিটির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ২০ লাখ ফ্রাঁ (সে সময় প্রায় ৪ লাখ ডলার সমমান) সংগ্রহ করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ সংগ্রহ করাটা তুলনামূলক কঠিন ছিল। প্রকাশক জোসেফ পুলিৎজার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন এবং অনুদানের জন্য তার পত্রিকা নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে প্রচেষ্টা শুরু করেন। তিনি তার পত্রিকায় সব অনুদানকারীর নাম ছাপা শুরু করেন, এমনকি কয়েক পয়সা অনুদান দেওয়া স্কুলছাত্রদের নামও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অনুদানের দাতার তালিকা ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যাদের মধ্যে অনেকেই এক ডলারেরও কম প্রদান করেছিল। এভাবেই আমেরিকানরা মূর্তিটির ভিত্তিস্তম্ভের জন্য আড়াই লাখ ডলার অনুদান প্রদান করে। বার্থোল্ডি মূর্তিটি নির্মাণ করেন- মূর্তিটির পুরো নাম হলো ‘লিবার্টি এনলাইটনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’, মূর্তিটি যে তামা থেকে তৈরি তা পেটাতে পেটাতে ২.৪ মিলিমিটার পুরুত্বে নিয়ে আসা হয়। ফরাসি প্রকৌশলী আলেক্সান্ডার-গুস্তাভ আইফেল (আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনার) মূর্তিটির জন্য একটি অবকাঠামো তৈরি করেন। অবকাঠামোটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে মূর্তিটির তাম্রদেহটি আলাদাভাবেই নড়াচড়া করানো সত্ত্বেও তা সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হবে। এ জন্যই মূর্তিটি বন্দরের বাতাসে দোল খেতেও সক্ষম। লেডি লিবার্টি নামের পরিচিত মূর্তিটি এর ভিত্তিস্তম্ভের পাদদেশ থেকে এর হাতের মশালের মাথা পর্যন্ত ৯৩ মিটার উঁচু। মূর্তিটির গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত মূর্তির উচ্চতা ৩৪ মিটার। বছরের পর বছর প্যাটিনেশন নামক এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য এর তামার রং সবুজ হয়ে উঠেছে। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত করে। দুই বছর ধরে মূর্তিটির সংস্কারের কাজের পর ১৯৮৬ সালে আবারও দর্শকদের জন্য মূর্তিটি উন্মুক্ত করা হয়। এ বছরই মূর্তিটির ১০০তম বার্ষিকী পালন করা হয়। এই সংস্কারের প্রকল্পের সময় নতুন মশালটিতে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের পাতলা আবরণ দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিজার্ভেশনের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা মূর্তিটির ভিত্তিস্তম্ভ ও মাথার তাজের ওপর উঠতে পারেন। স্ট্যাচু অব লিবার্টি ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে কাছাকাছি অবস্থিত এলিস দ্বীপের ফেডারেল অভিবাসন স্টেশন থেকে আগত ১ কোটি ২০ লাখেরও অধিক অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগতম জানায়। পুরনো অভিবাসন স্টেশনটি এখন একটি জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা ফেরি করে এলিস দ্বীপ ও স্ট্যাচু অব লিবার্টির স্থাপনাস্থল লিবার্টি দ্বীপে গমন করতে পারেন।

সর্বশেষ খবর