সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

দুঃসাহসী তিন অভিযান

দুঃসাহসী তিন অভিযান

দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা মৃত্যুর ভয়কে পেছনে ফেলে ছুটে গেছেন পৃথিবীর দুর্গম  স্থানগুলো থেকে শুরু করে সুদূর মহাকাশে। অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রত্যয়ে গড়েছেন বিশ্বজয়ের ইতিহাস। মানব ইতিহাসের সেরা কিছু ঐতিহাসিক অভিযানের গল্প নিয়ে আজকের রকমারি। লিখেছেন - তানভীর আহমেদ

 

চন্দ্রবিজয়

১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পঞ্চম মহাকাশ অভিযাত্রায় অ্যাপোলো-১১ যাত্রা শুরু করে। এই অভিযানের শুরুতেই মহাকাশযানটি বিপদে পড়ে। অ্যাপোলোর নভোচারীরা চরম বিপর্যয়ে পড়ে যখন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে প্রবেশ করেছে, ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় এমন একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের হয়তো মহাকাশে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে হতো। সোলার রেডিয়েশন তাদের সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয়। স্পেসস্যুট বিকল হয়ে গেলে তারা আরও সমস্যায় পড়ে। বর্তমানের তুলনায় অ্যাপোলোর প্রযুক্তি অনেকটা সেকেলে ছিল। সেই মহাকাশযানের কম্পিউটারের মেমোরি ছিল ৭৪ কিলোবাইটের, যা এখনকার দিনের একটা এমপিথ্রি ফরমেটের গানের ফাইলের চেয়েও অনেক কম। এত অপ্রতুলতা ও বিপর্যয়ের পরও চাঁদের মাটিতে মানুষের পা পড়ে। প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশ অভিযান হিসেবে অ্যাপোলো-১১ চাঁদে অবতরণ করে। এই অভিযানে অংশ নেন দলপতি নিল আর্মস্ট্রং, কমান্ড মডিউল চালক মাইকেল কলিন্স এবং অবতরণযানের চালক এডউইন অলড্রিন জুনিয়র। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের ২৬ তারিখের গ্রিনউইচ মান সময় দুপুর ১২টা ৩৬-এ  প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং। তিনি বলেন, ‘এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ।  কিন্তু মানব জাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা।’ তার পরে চাঁদে অবতরণ করেন এডউইন অলড্রিন জুনিয়র। সেখানে তারা আড়াই ঘণ্টা কাটান।

 

আটলান্টিক পাড়ির ইতিহাস

ইউরোপ থেকে আমেরিকা। মাঝে ১০৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটারের উত্তাল আটলান্টিক মহাসমুুদ্র। এখন প্রতিদিন এ পথে উড়োজাহাজে আনাগোনা হলেও ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তো তা ছিল স্বপ্নের মতো। ১৯০৩ সালে ১৭ ডিসেম্বর অরভিল এবং উইলবার রাইট আবিষ্কার করলেন উড়োজাহাজ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হয়। এরপর ইউরোপ-আমেরিকাবাসীর স্বপ্ন দেখা শুরু হলো উড়োজাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার। এরই মধ্যে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয় ফ্রান্সের পাইলটদের মধ্যে। প্যারিস থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলেন দুই পাইলট চার্লস নানগিজার এবং ফ্রাঙ্কোইজ কোলি। কিন্তু নিউইয়র্ক পৌঁছা হয়নি তাদের। মাঝপথেই হারিয়ে যান তারা। সমুদ্রে কিংবা পথের পাহাড়ি বনাঞ্চলে খুঁজেও উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি এই দুই পাইলটরে মৃতদেহ। এসব দুর্ঘটনায় ভীত হননি চার্লস লিন্ডবার্গ (১৯০৭-১৯৭৪)। মার্কিন এই অ্যাভিয়েশন পাইওনিয়ার লিন্ডবার্গ প্লেন চালনা শেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দেন। প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তাদের অতিরিক্ত বিমানগুলো বেচে দেয়। তখন নিজের জন্য একটা প্লেন কিনেন লিন্ডবার্গ। সেই প্লেন দিয়ে তিনি চিঠিপত্র বহন করতেন আর প্রশিক্ষণ দিতেন। ১৯২৭ সালের ২০ এবং ২১ মে চার্লস লিন্ডবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি থেকে ফ্রান্সের প্যারিস পর্যন্ত ৫ হাজার ৮০৯ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার সময় কম ঝুঁকি নেননি। তার বিমানটির সর্বনিম্ন ওজন রাখার জন্য সেটাতে ছিল না ব্রেক, রেডিও এমনকি প্যারাশুট! অন্ধকার, কুয়াশা আর শিলাবৃষ্টির মধ্যে তাকে উড়তে হয়েছে সমুদ্রের ১০ ফুট ওপর দিয়ে। বাতাসে তার মুখ বিস্ফোরিত হচ্ছিল, হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল, ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল তার পরও লড়াকু লিন্ডবার্গ হার মানেননি।  সাড়ে ৩৩ ঘণ্টার বিরতিহীন বিমান যাত্রার পর যখন প্যারিসে অবতরণ করেন দেড় লাখ লোক তাকে উষ্ণ সম্ভাষণ জানাতে আসেন। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সফল প্রচেষ্টা পাল্টে দেয় লিন্ডবার্গের জীবন।

 

দুর্গম দক্ষিণ মেরু জয়

দক্ষিণ মেরু অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর দক্ষিণতম বিন্দু। অ্যান্টার্কটিকার এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ হাজার ৩০১ ফুট ওপরে ২ হাজার ৭০০ মিটার পুরু বরফে ঢাকা মালভূমি। তাই এই স্থানের ভূপৃষ্ঠ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০০ মিটারের মতো উঁচু। এই স্থান থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী সমুদ্র ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরে তিমি উপসাগর। যেহেতু দক্ষিণ মেরুতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত বছরে একবার হয় এবং পৃথিবীর সব দ্রাঘিমা রেখা এই বিন্দুতে এসে মিলিত হয়, সেহেতু দক্ষিণ মেরুকে কোনো নির্দিষ্ট সময় অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এই দিনে দুর্গম ও অগম্য স্থান দক্ষিণ মেরু হিসেবে পরিচিত পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের প্রান্তবিন্দুতে মানুষ হিসেবে প্রথম পা রাখেন নরওয়ের দুঃসাহসী অভিযাত্রী রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেন এবং তার দল। দক্ষিণ মেরু জয়ী হিসেবে আরেক বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী রবার্ট স্কটকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। রবার্ট স্কট এবং অ্যামুন্ডসেন প্রায় একই সময় সাউথ পোল অভিযানে বের হন। কিন্তু অ্যামুন্ডসেন রবার্ট স্কটের আগেই সাউথ পোলে পৌঁছান। অ্যামুন্ডসেনের সাউথ পোলে পৌঁছার অল্প কিছু দিন পর ১৯১২ সালের ১৭ জানুয়ারিতে তিনি এবং তার দল সাউথ পোলে পৌঁছান। স্কট ও তার দলও অনুরূপ কৃতিত্ব এবং শ্রদ্ধার দাবিদার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দক্ষিণ মেরু থেকে ফেরার অভিযানে স্কট তার চার সহযোগীসহ ভয়াবহ মেরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।  দক্ষিণ মেরু অভিযাত্রায় অ্যামুন্ডসেনের সহযোগী ছিলেন তার স্বদেশি অপর চার অভিযাত্রী ওলাভ জাল্যান্ড, হেলমার হ্যানসেন, সভেরে হ্যাসেল এবং অস্কার উইসটিং।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর