সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রহস্যময় যত দ্বীপ

তানভীর আহমেদ

রহস্যময় যত দ্বীপ

কারা বানাল এমন ভাস্কর্য?

ইস্টার দ্বীপ। প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন নির্জন এ দ্বীপটিতে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ইস্টার দ্বীপটি আসলে তিনটি আগ্নেয়গিরি দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানে নেই কোনো বসতি। জনবিরল এই দ্বীপে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের অসংখ্য ভাস্কর্য। দ্বীপের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দানবাকৃতির মূর্তি। কে তৈরি করল মূর্তিগুলো, কেউ জানে না। ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলো সবই তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল পাথর কেটে। কিন্তু গবেষকদের প্রশ্ন- দ্বীপবাসী সেই কৌশল শিখল কী করে? আর পাথরগুলোই তারা বয়ে আনল কীভাবে এবং কোথা থেকে? এসবের উত্তর এখনো খুঁজছে বিশ্লেষকরা। দ্বীপের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো সাতটি বৃহদাকার ভাস্কর্য। যাদের আসলে ‘নেভল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলা হয়। দ্বীপটিতে সব মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক ভাস্কর্য রয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, এসব ভাস্কর্যকে বলা হয় মোয়াই। দ্বীপজুড়ে মোয়াই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। একেকটি মোয়াই ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এসব ভাস্কর্যের একেকটির ওজন গড়ে ২০ টনেরও বেশি। দ্বীপের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যটি ৩২ ফুট উঁচু। এর ওজন প্রায় ৯০ টন। এ ছাড়া আরও আছে পাথুরে তৈরি ৮০০টি মূর্তির মাথা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাথাটির উচ্চতা ৩২ ফুট এবং ওজন ৯০ টন। এ ছাড়া ইস্টার দ্বীপে আছে ‘আহু’ বলে পরিচিত পাথরের বিশাল বিশাল প্ল্যাটফর্ম। আছে পাথরের তৈরি বিস্ময়কর দেয়াল, পাথরের ঘর ও গুহাচিত্র। পরস্পর সংগতিহীন এসব সৃষ্টি বিস্ময়কে যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৭৭২ সালে কোনো এক ইস্টার সানডে উৎসবে অ্যাডমিরাল জ্যাকব রগেউইন দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। ডাচ এই অভিযাত্রীই দ্বীপটির নাম দেন ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থর হেয়ারডাল প্রচুর গবেষণা ও খননের পর তথ্য দিলেন- ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে পেরু থেকে কিছু মানুষ এসে এই দ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তারা তৈরি করেছিলেন রাস্তা, মন্দির, মানমন্দির ও সুড়ঙ্গ পথ। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে পেরু থেকেই অন্য লোকজন এসে দ্বীপটি দখল করেন। ধারণা করা হয়, তারাই মূর্তিগুলো গড়েন। মূর্তিগুলোর কান লম্বা। রেডিও কার্বন পরীক্ষার সাহায্যে থর হেয়ারডাল এসব তথ্য পৌঁছালেও বহু গবেষক এর বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, এক অতি প্রাচীন অথচ উন্নত সভ্যতার চিহ্ন এগুলো। হয়তো সেই সভ্যতা প্রকৃতির খেয়ালে কোনো কালে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে তলিয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন, দ্বীপটিতে বাইরের জগৎ থেকে অভিবাসীরা বাস করে গেছেন। অনেকে বলেন, দ্বীপের বাসিন্দারা ছিলেন প্রাচীন মিসরীয়। অনেকে আবার মোয়াইগুলোর সঙ্গে প্রাচীন পলিনেশীয় জাতির ধর্মীয় দেবতা ও পূর্বপুরুষদের অবয়বের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, দ্বীপে বসবাসরত সেই বাসিন্দাদের প্রতিটি পরিবারের সমাধিস্তম্ভ হিসেবে বানানো হতো একেকটি মোয়াই।

 

আজব পুতুল দ্বীপ

সচরাচর পুতুলকে খুব মিষ্টি এবং মায়াবী করে তৈরি করা হয়। শিশুদের খেলার উপকরণ হিসেবে পুতুল সেই আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এই পুতুলও কখনো কখনো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। দ্বীপটি সবার কাছে ভয়ংকর পুতুলের দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। একটা সাধারণ ঘটনা থেকেই এ দ্বীপের রহস্যময় অগ্রযাত্রার শুরু। আর এ ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছরেরও বেশি সময় আগের। তিন মেক্সিকান শিশু শীতল অন্ধকার দ্বীপটিতে খেলাচ্ছলে পুতুলের বিয়ে দিচ্ছিল। আর পুতুল বিয়ে খেলতে গিয়ে তিন শিশুর একজন নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দ্ব^ীপের পাশের একটি খালে শিশুটির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল। সে-ই শুরু। এরপর থেকে ভয়ে কেউ আর ওই পথ মাড়াত না। ভয়ংকর এই পুতুলের দ্বীপটি মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ মাইল দক্ষিণে জোকিমিলকো জেলায় অবস্থিত। এ দ্বীপে ঢুকলে অসীম সাহসী মানুষেরও বুক কেঁপে উঠবে। দ্বীপজুড়ে শুধু পুতুল আর পুতুল। ভয়ংকর এই দ্বীপকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে নানা কাহিনি। এত সব রহস্যের কারণেই ১৯৯০ সালে মেক্সিকান সরকার এই জোকিমিলকো জেলার এ দ্বীপটিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা করে। এ দ্বীপে একেক মৌসুমে খুব বেশি পর্যটক কখনই আসেননি।

 

দ্বীপে অদ্ভুত গুহা

স্কটল্যান্ডের অদূরে উত্তাল সমুদ্রে স্টাফা দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে ফিংগালস কেভ। কেউ বাস করে না সেই দ্বীপে। নাবিকরা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এ দ্বীপের খবর জানেন। এক সময় সমুদ্র নেকড়ে বলে কুখ্যাত ভাইকিংরা এই দ্বীপের নাম রেখেছিল ‘ফিংগাল’স কেভ’। প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালের কারণে ‘ফিংগাল’স কেভ’-এর ভিতরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য খিলান। এ ব্যাপারে ভূতত্ত্ববিদরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে লাভা থেকে এই গুহার সৃষ্টি। এর গলিত পাথর খড়িমাটির ওপর দিয়ে যাওয়ায় গুহাটি এই বিশেষ আকৃতি পায়। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের ‘জায়ান্ট’স কজওয়ে’ নামের অপর স্থানের সঙ্গেও এর আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে। যদিও ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এদের মধ্যে মিল একই রকম নয়। তবে তাদের ধারণা, এই দুই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। একই লাভাস্রোত থেকে এই দুই গুহার সৃষ্টি হয়। এমনকি দুটি গুহার সঙ্গে সংযোগ ছিল বলেও উপকথা রয়েছে। পরে নাকি সেই সেতু ধ্বংস হয়ে যায়।

 

যে দ্বীপে শুধু সাপ আর সাপ

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে ‘ইলহা দ্য কুয়েইমাডা গ্র্যান্ডে’ নামের একটি দ্বীপ আছে। ব্রাজিলের বৃহত্তম শহর সাও পাওলো থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপে কেউ পা রাখার সাহস দেখান না। সরকারও ওই দ্বীপে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। প্রচলিত যে, ওই দ্বীপে গেলে জীবিত কেউ ফিরে আসে না! লাইটহাউস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি পরিবার ওই দ্বীপে বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছে। ১৯০৯-২০ সাল পর্যন্ত ছিলেন তারা। শোনা যায়, ঘরে ঢুকে পুরো পরিবারকে মেরে ফেলে সাপের দল। এ নিয়েও কাহিনি আছে। শোনা যায়, জলদস্যুরা লুট করা সোনা এই দ্বীপে লুকিয়ে রাখতেন। কেউ যাতে সেগুলোয় হাত দিতে না পারে সেজন্য কয়েকটি বিষাক্ত সাপ দ্বীপে ছেড়ে দিয়েছিলেন তারাই। সেই সোনার লোভে বারেবারেই সেখানে গেছে মানুষ। কিন্তু শোনা যায়, তারা কেউই ফেরেননি। তারপর সেই সাপের বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। কয়েকটি সাপ থেকে কয়েক হাজার সাপে ভরে যায় গোটা দ্বীপ। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ওই সাপ গোল্ডেন ল্যান্সহেড। বিশ্বের অন্যতম বিষধর সাপ এটি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাপের সংখ্যা এত বেড়েছে যে, প্রতি এক বর্গমিটারে একটা করে সাপ পাওয়া যায়। সাপদের স্বর্গরাজ্য এই দ্বীপটিকে তাই ‘স্নেক আইল্যান্ড’ বলা হয়।

 

বৈচিত্র্যের বাল্ট্রা

বাল্ট্রা দ্বীপে কোনো মানুষ নেই। ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের একটি বিশেষ দ্বীপ এটি। দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরের নিকটবর্তী ১৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ। আর এই ১৩টি দ্বীপের একটি হচ্ছে বাল্ট্রা। বাল্ট্রা এখানকার অন্য ১২টি দ্বীপ থেকে একেবারেই অন্য রকম, অদ্ভুত এবং রহস্যময়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দ্বীপপুঞ্জ হওয়ায় প্রচুর বৃষ্টি হয় এ দ্বীপে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- এত বৃষ্টি চারপাশে কিন্তু বৃষ্টির এক ফোঁটাও পড়ে না বাল্ট্রা দ্বীপে। কোনো এক রহস্যজনক কারণে বাল্ট্রার অনেক ওপর দিয়ে গিয়ে অন্য পাশে পড়ে বৃষ্টি। আশপাশের দ্বীপে আছে সিল মাছ, গুয়ানা, দানবীয় কচ্ছপ, গিরগিটিসহ বিরল প্রজাতির পাখি। কিন্তু এসবের কিছুই নেই শুধু বাল্ট্রা দ্বীপে। বাল্ট্রা দ্বীপে নেই কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ বা কীটপতঙ্গ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর