সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গোলের বিশ্বকাপ

জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। হাজার হাজার দর্শক খেলা উপভোগ করতে প্রতিদিন মাঠে উপস্থিত হচ্ছেন, গলা ফাটাচ্ছেন পছন্দের দলের জন্য। মাঠের বাইরেও টিভি সেটের সামনে, বড় পর্দায় চলে বিশ্বকাপের আনন্দ, উল্লাস এবং উদ্যাপন। এ যেন গোলের বিশ্বকাপ।

গোলের বিশ্বকাপ

কম সময়ের গোল

ফিফা বিশ্বকাপ, ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর। এই আসরকে ঘিরে যত উন্মাদনা। যত শত রেকর্ড। আর রেকর্ড নাকি গড়াই হয় ভাঙার জন্য। ফুটবলের মতো দলীয় খেলাগুলোর জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য এ কথা। বিশ্ব আসরের মঞ্চেও দেখা গেছে কম সময়ের গোলের রেকর্ড। অনেকে একে বলেন, দ্রুত সময়ের গোল কিংবা কুইক ফায়ার গোল। যা বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে একটি দলের জন্য প্রায় সবসময়ই সুবিধাজনক এবং তাদের খেলার গতি নির্ধারণে সহায়তা করে। গেল কয়েক বছর ধরেই ফুটবলপ্রেমীরা ফিফা বিশ্বকাপে এমন কয়েকটি গোলের দেখা পেয়েছেন। বিশ্বকাপে মাত্র ১১ সেকেন্ডে গোল করেছেন তুরস্কের খেলোয়াড় হাকান শুকুর। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে সবচেয়ে দ্রুত গোলের রেকর্ড গড়েন তিনি। ওই ম্যাচে তুরস্কের প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। সেই রেকর্ডটি আজও বিশ্বকাপের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে। এর পরের রেকর্ডটি রয়েছে চেক রিপাবলিকের ভকলভ মাসেকের দখলে। ১৯৬২ সালের চিলি ফিফা বিশ্বকাপে মেক্সিকোর বিপক্ষে মাত্র ১৬ সেকেন্ডে গোল করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর হয়েছিল ইতালিতে। সেবার কম সময়ের গোলের রেকর্ড করেন জার্মানির আর্নস্ট লেহনার। ১৯৩৪ সালের ওই আসরে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে মাত্র ২৪ সেকেন্ডে গোল করে রেকর্ড গড়েন এই জার্মান ফরওয়ার্ড।  তার পরের রেকর্ডটি রয়েছে ইংল্যান্ডের স্ট্রাইকার ব্রায়ান রবসনের ঝুলিতে। ১৯৮২ সালে স্পেনে আয়োজিত বিশ্বকাপে মাত্র ২৭ সেকেন্ডে ফ্রান্সের বিপক্ষে গোলটি করেন তিনি।

 

বিশ্বকাপ আসরের ইতিহাসে সর্বাধিক গোলদাতা জার্মানির ক্লোসা

বিশ্বকাপের রয়েছে ৯২ বছরের ইতিহাস। কত খেলা আর কত ঘটনার জন্ম দিয়েছে গত হওয়া বিশ্বকাপের আসর! ইতিহাস তেমনি সায় দিচ্ছে- ২১টি আসরের বিশ্বকাপে অসংখ্য রেকর্ডের সূচনা এবং রেকর্ড ভেঙেছে। এবার চলছে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। কেবল এবারের আসরই নয়, বিশ্বকাপের সব আসরে নজর থাকে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের দিকে। কে কত গোল করেছে? কোন ম্যাচে কত গোল করেছে? এমনকি বিশ্বকাপের মতো আসরে সবচেয়ে বেশি গোলদাতা কে? এসব নিয়েও থাকে নানা চর্চা।

বিশ্বকাপের আসরে সবার চোখ থাকে সর্বোচ্চ গোলদাতার দিকে। আর সেই গোলদাতা পুরস্কার হিসেবে পান গোল্ডেন বুট। এবারের কাতার বিশ্বকাপেও তেমনি সেরা খেলোয়াড়দের দিকে নজর রয়েছে বিশ্ববাসীর। ২০২২ আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়ে এগিয়ে আছে কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং লিওনেল মেসি। একই তালিকায় আছেন আরেক সেরা ফরাসি খেলোয়াড় কিলিয়ান এমবাপ্পে। নেদারল্যান্ডসের ফরোয়ার্ড কোডি গাকপোর এবং ব্রাজিলের রিচার্লিসনও আছেন আলোচনায়। চার বছর আগের রাশিয়া বিশ্বকাপে ছয় গোল করে গোল্ডেন বুট জিতে নেন ইংল্যান্ডের হ্যারি কেন। এবারেও গোল্ডেন বুট জেতার দাবিদারদের অন্যতম একজন হিসেবে পুনরাবৃত্তি করতে চাইবেন তিনি। কিন্তু ইতিহাস তার বিপক্ষে, আজ পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড় পর পর দুই বিশ্বকাপে সেরা গোলদাতার খেতাব পাননি।

অন্যদিকে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপের একটি টুর্নামেন্টে একজন খেলোয়াড়ের সর্বাধিক গোল করার রেকর্ডটি এখনো কিংবদন্তি ফরাসি ফরোয়ার্ড জাস্ট ফন্টেইনের দখলে রয়েছে। তিনি ১৯৫৮ সালে সুইডেনে মাত্র ছয়টি ম্যাচে অসাধারণভাবে ১৩টি গোল করতে সক্ষম হন। সে সময় ২৪ বছর বয়সী জাস্ট ফন্টেইন কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল এবং তারপর সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ৫-২ গোলে জয়ে একটি গোল করেন। ফরাসি ১৭ নম্বর জার্সিধারী জাস্ট ফন্টেইন তৃতীয় স্থানের ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির গোলরক্ষক হেইঞ্জ কুয়াটকোস্কির জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে আসেন। ওই ম্যাচে জাস্ট ফন্টেইন চার গোল করে ১৩টি গোল উদ্যাপন করেন।

অন্যদিকে, ফুটবলের স্ট্রাইকারের তালিকায় হয়তো শুরুর দিকে নাম থাকবে না মিরোস্লাভ ক্লোসার। ক্লাব ক্যারিয়ারটা খুব বেশি আহামরি নয় তার। জেতেননি ক্লাবের হয়ে খুব বেশি শিরোপা, কিংবা নামের পাশে নেই ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার ব্যালন ডি অর। তারপরও অনন্য এই জার্মান ফুটবলার। কারণ, চার বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট ১৬ গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড করেছেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। সেই রেকর্ড আজও অমলিন। ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে নজর কাড়েন ২৪ বছর বয়সী ক্লোসা। সে সময় পাঁচ গোল করে রিভালদোর সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে আরও পাঁচ গোল করেন ক্লোসা। এবার অবশ্য সিলভার বুট নয়, বরং সর্বোচ্চ গোলের জন্য গোল্ডেন বুটই লাভ করেন। ২০১০ বিশ্বকাপে আরও ৪ গোল করে স্বদেশি জার্ড মুলারের পাশে বসেন ক্লোসা। ২০১৪ বিশ্বকাপে ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে ব্রাজিলে যান ক্লোসা। আগের তিন বিশ্বকাপে ১৪ গোল করা ক্লোসার সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনালদোকে ছুঁতে দরকার ছিল মোটে এক গোল। ঘানার বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করা ম্যাচে দ্বিতীয় গোলটি করে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদোকে ছুঁয়ে ফেলেন। সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে দ্বিতীয় গোলটি করে ১৬ গোল নিয়ে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতায় পরিণত হন তিনি। জার্মান স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোসার পর ১৯ ম্যাচে ১৫ গোল করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো। আর ১৩ ম্যাচে ১৪ গোল করে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির গ্রেড মুলার তালিকায় রয়েছেন তৃতীয় অবস্থানে।

২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে মোট ১৬৯টি গোল করেছিল ৩২ দল মিলে, যা টুর্নামেন্টের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ গোলের হিসাবে যৌথভাবে প্রথমেই আছে ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপ ও ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। এই দুই টুর্নামেন্টেই সব দল মিলে ১৭১ গোল উপহার দিয়েছে দর্শকদের।

 

বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বাধিক গোলের ম্যাচ

বিশ্বকাপের আসর শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে। এরপর পার হয়ে গেছে ৯২ বছর। এখন চলছে কাতার বিশ্বকাপ-২০২২। এটি বিশ্বকাপের ২২তম আসর। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত পাঁচবার ১০ বা তার বেশি গোলের ম্যাচ দেখা গেছে। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে অনুষ্ঠিত হওয়া অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ডের ম্যাচটি এর মধ্যে অন্যতম। অবিস্মরণীয় এই ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২টি গোলের দেখা পেয়েছিল ফুটবল বিশ্বকাপ। ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রিয়া সুইজারল্যান্ডের লুসানে সুইজারল্যান্ডকে ৭-৫ গোলে পরাজিত করে। উত্তেজনার ওই ম্যাচে অল্পের জন্য বেঁচে যায় অস্ট্রিয়া। বিশ্বকাপের এক ম্যাচে এটিই সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এবং সর্বোচ্চ স্কোরিং ম্যাচ। ১৯৫৪ সালে একই বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি প্রতিপক্ষ জার্মানিকে ৮-৩ গোলে পরাজিত করে। এর ২৬ বছর পর ১৯৮২ সালে স্পেনে আয়োজিত ফিফা বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি এলসালভাদোরকে ১০-১ গোলে পরাজিত করে।

 

বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলদাতা খেলোয়াড়

মহাতারকাদের মহামঞ্চে দেখা মেলে অসংখ্য গোলের। তবে এমন আসরেও সেরা তারকা খেলোয়াড়দের পেছনে ফেলে চমক দেখানিয়া খেলোয়াড়দের সংখ্যাও কম নয়। তেমনি একটি রেকর্ড রচিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালের আসরে। সেবার বিশ্বকাপের এক ম্যাচে একক খেলোয়াড় হিসেবে সর্বাধিক গোল করার রেকর্ড গড়েছেন রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কো। ১৯৯৪ সালে গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচে ক্যামেরুনকে ৬-১ গোলে হারায় রাশিয়া। যার পাঁচটি গোল করেন ওলেগ সালেঙ্কো। সে সময় ২৫  বছর বয়সী সালেঙ্কো ম্যাচের ১৫ মিনিটের মাথায় গোল করা শুরু করেন। খেলার ৪১ মিনিটে দ্বিতীয় গোল এবং ৪৪ মিনিটে হ্যাটট্রিক করেন। হাফ টাইমের পর সালেঙ্কো ৭২তম মিনিটে করেন চতুর্থ গোল এবং ৭৫ মিনিটে পঞ্চম গোলটি দিয়ে বিশ্বকাপ আসরের এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড করেন। একই ম্যাচে ক্যামেরুনের রজার মিলা এক গোল করে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড়ের খেতাব অর্জন করেন।

 

বিশ্বকাপের ফাইনালে সর্বাধিক গোল

বিশ্বকাপের মহামঞ্চে রচিত হয়েছে অসংখ্য ইতিহাস। তেমন একটি আয়োজন ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ। সেবার আয়োজক দেশ ছিল সুইডেন। এটি ছিল বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসর। এটি ছিল নর্ডিক দেশে আয়োজিত প্রথম ফিফা বিশ্বকাপ। আর আয়োজক দেশ সুইডেন অর্জন করে রানার্সআপের খেতাব। এই আসরে প্রথমবারের মতো ব্রাজিল বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তোলে। ভাভা, পেলে এবং মারিও জাগালোর ব্রাজিল সেবার খেলেছিল বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ স্কোরিং ফাইনাল। যা আজও অপ্রতিরোধ্য। এই ম্যাচেই ব্রাজিল সুইডেনের বিপক্ষে ৫-২ গোলে জয়লাভ করে। মজার বিষয় হলো, এ ম্যাচটি একই সঙ্গে দুটি রেকর্ড করে। প্রথমটি বিশ্বকাপ ফাইনালে সবচেয়ে কম বয়সী এবং দ্বিতীয়টি সবচেয়ে বয়স্ক গোলদাতার রেকর্ড। যেখানে ব্রাজিলের পেলে ১৭ বছর ২৪৯ দিনে সবচেয়ে কম বয়সী গোলদাতা হয়েছেন এবং সুইডেনের নিলস লিডহোম ৩৫ বছর ২৬৩ দিনে সবচেয়ে  বয়স্ক গোলদাতার রেকর্ড করেছেন।

 

বিশ্বকাপের মহামঞ্চে কোন দলের কত গোল

ফিফার মহামঞ্চ বিশ্বকাপ। যেখানে দেখা মেলে নতুন নতুন রেকর্ডের। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, সেরা দলগুলো সর্বদাই সেরা ছিল। পারফরমেন্সে খানিকটা পরিবর্তন হলেও বারবারই রেকর্ড গড়েছে সেরা দলগুলো। কাতার বিশ্বকাপ-২০২২-এ অংশ নেওয়া সবচেয়ে বেশি গোলের দেখা পাওয়া দল জার্মানি, তারপর আছে ব্রাজিলের অবস্থান। কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগ পর্যন্ত তাদের গোল সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২৯ এবং ২২৬টি। মাত্র তিন গোলের ব্যবধানে এগিয়ে জার্মানি। তবে এবারের আসরে তালিকার শীর্ষ স্থানটি দখল করতে যাচ্ছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। কাতার বিশ্বকাপে আসরে জার্মানদের যাত্রা ইতোমধ্যে থেমে গেছে। সেই সুযোগে ব্রাজিল তালিকায় শীর্ষে আসবে সেটাই বলাই যায়। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আর্জেন্টিনা। তারা জার্মানি এবং ব্রাজিলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।  বিশ্বকাপে তাদের গোল সংখ্যা ১৩৭টি। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ইতালি এবং ফ্রান্স।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর