রেকর্ড বুকে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি
চেরাপুঞ্জির মূল নাম ছিল সোহরা। অনেকে বাংলায় চেরাপুঞ্জিকে বলে কমলা দ্বীপ। এই পাহাড়ি জনপদে কমলা ছাড়াও প্রচুর পান-সুপারির গাছ দেখতে পাওয়া যায়। খাসি উপজাতিপ্রধান এ অঞ্চলে প্রকৃতিগত অবস্থানের জন্য প্রচুর বৃষ্টি হয়। বর্ষায় টানা বৃষ্টি হলেও বছরের অন্য সময় এখানে খাবারের পানির সংকট দেখা যায়। সারা ভারতের চেয়ে চেরাপুঞ্জিতে সাক্ষরতার হার বেশি। চেরাপুঞ্জি বিশ্বের অন্যতম বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। হিসাব রাখা শুরু করার পর থেকে জুনের এক দিনে সেখানে এ পর্যন্ত ৯ বার ৮০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন। সেদিন ওই এলাকায় ১ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয় ১৯৫৬ সালের ৫ জুন। সেদিন বৃষ্টিপাত হয় ৯৭৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার। আর ২০২২ সালে ১৬ জুন সকাল থেকে ১৭ জুন সকাল পর্যন্ত ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়; যা ১২২ বছরের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
কেন এত বৃষ্টি হয়
প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে চেরাপুঞ্জি বিশ্বের অন্যতম প্রধান বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের কারণ হিসেবে বলা হয়, ভারত মহাসাগর থেকে ওঠা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু হিমালয় পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালগুলোতে এসে ধাক্কা খায়। তখন সেটি ওপরের দিকে উঠতে বাধ্য হয়। এই বায়ু প্রবল বৃষ্টির আকারে জলীয় বাষ্পগুলোকে ঢেলে দেয়। মেঘালয় মালভূমিতে দেখা দেয় প্রচুর বৃষ্টি। চেরাপুঞ্জিতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ অঞ্চলে গড়ে এক বছরে ১৮০ দিন বৃষ্টি হয়।
এত বৃষ্টি তবুও খাবার পানির সংকট
চেরাপুঞ্জির সম্পদ চুনাপাথর আর লোহা। প্রাকৃতিকভাবেই পার্বত্য অঞ্চলের পৃষ্ঠদেশ ঢালু। তাই সেখানকার মাটিতে পানি দাঁড়াতে পারে না স্বাভাবিকভাবেই। মাটিতেও কাঁকর ও পাথরের পরিমাণ বেশি। মাটি কম ছিদ্রযুক্ত, ফলে পানি ধরে রেখে ভূগর্ভে পৌঁছে দিতে পারে না। অধিক বৃষ্টি মাটির ক্ষয়ের অন্যতম কারণও বটে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বন্দোবস্ত ছিল না তখন। বর্তমান সময়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কিছু প্রয়াস যদিও বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে শীতকালে পানীয় জলের জন্য বহু দূর চলে যেতে হয় মানুষকে। ঝরনার পানি আশ্রয় করে বেঁচে থাকে কেউ কেউ। এত বৃষ্টি নিয়েও অন্যান্য অনেক পাহাড়ি অঞ্চলের মতো চেরাপুঞ্জিও পানীয় জলের সংকটে ভুগছে প্রবলভাবে।
মেঘের বাড়ি মৌসিনরাম
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং। সেখান থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরের শহর মৌসিনরাম। চেরাপুঞ্জিকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকার স্বীকৃতি এখন তার। মৌসিনরামকে মেঘের বাড়ি বলেই চেনেন স্থানীয়রা। পর্যটকরা এই মেঘের খেলা দেখতেই ছুটে যান এখানে। পাহাড়ের পর পাহাড়, তার বুকে ঢেউ খেলছে মেঘ, ঝরনা। সেখানে রাস্তার দুই ধারে বুনোফুল, অর্কিড ফুটে আছে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এমন জায়গা হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে মৌসিনরামের নাম লেখা হয়েছে। এ শহরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১২ হাজার মিলিমিটার। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ছিল ২৬ হাজার মিলিমিটার। লোকে বলে, বর্ষায় এ অঞ্চলে বৃষ্টি একবার শুরু হলে কবে থামবে বলা মুশকিল। কখনো কখনো সপ্তাহ পার হয়ে যায়, বৃষ্টি থামে না। বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা। দারুণ কষ্টে কাটে সে সময়টা। বছরজুড়েই এখানে কম-বেশি বৃষ্টি হয়। মৌসিনরাম খুব শান্ত, কোলাহল নেই বললেই চলে। লোকজনের চলাচল কম। খাসি উপজাতিপ্রধান অঞ্চল এটি। পাহাড়ের গায়েই তাদের বসবাস। সব মিলিয়ে হাজারখানেক মানুষ থাকেন এখানে। বর্ষায় যখন বৃষ্টি শুরু হয় তখন স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে যায়। টানা বৃষ্টি শুরু হলে পানি জমে যায় সবখানে। বন্ধ হয়ে যায় পথঘাট, স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। বর্ষাকাল পেরোলেই পাহাড়ের ওপরের এই শহরের চিত্র আবার অন্যরকম। তখন খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। রেকর্ড বৃষ্টিপাত হলেও এখানে মাটির নিচে পানির স্তর অনেক নিচে। পাহাড়ি জনপদের মানুষকে পানির জন্য পাহাড় থেকে নেমে আসতে হয় পানির খোঁজে। বর্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখেন স্থানীয়রা।
আরও যত বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা
সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে কলম্বিয়ার ললর। এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময় টানা ১১-১২ দিন ধরেও চলে বৃষ্টিপাত। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৩ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। হাওয়াইয়ের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান সবুজে ঘেরা মাউন্ট ওয়ালিয়ালো। শুধু বৃষ্টিভেজা সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর এখানে আসে কয়েক লাখ পর্যটক। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১ হাজার ৫০০ মিলিমিটার।