জীবন পুষ্পশয্যা নয়। সে জীবনে সফলতাও রাতারাতি ধরা দেয় না। সফলতা অর্জন করতে হয়। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে লেগে থাকতে হয়। চিরকালই পৃথিবীতে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে ভাঙা-গড়া, চড়াই-উৎরাইয়ের বিরাট ইতিহাস। ব্যর্থতার পাহাড় ডিঙিয়ে সাধারণ থেকে অসাধারণ হওয়া কজন মানুষের গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন-

বিল গেটস
প্রকল্পে ব্যর্থতার পরও মাইক্রোসফট করপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা
দিনের বেশির ভাগ সময়ই কলেজের কম্পিউটার ল্যাবে কাটাতেন। একদিন বন্ধু পল অ্যালেনকে নিয়ে ইন্টেল-৮০৮০ সিপিইউর উপযোগী এমআইটিএস-৪৪০০ তৈরি করেন
পুরো নাম উইলিয়াম হেনরি গেটস। ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর আমেরিকার ওয়াশিংটনের সিয়াটলে তাঁর জন্ম। বাবা উইলিয়াম হেনরি গেটস সিনিয়র ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী। মা ম্যাক্সওয়েল গেটস ছিলেন ইউনাইটেড ওয়ের পরিচালক। লেকসাইড স্কুলে তাঁর স্কুলজীবন শুরু। সেখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি ১৬০০ নম্বরের মধ্যে ১৫৯০ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৭৩ সালে হার্ভার্ড কলেজে পড়ার সুযোগ পান। তখন বিভিন্ন মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেন। স্টিভ বালমার তাঁদেরই একজন যিনি পরবর্তীতে মাইক্রোসফটের সিইও হন। হার্ভার্ডে পড়ার সময় গেটসের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। দিনের বেশির ভাগ সময় কলেজের কম্পিউটার ল্যাবে কাটাতেন। একদিন বন্ধু পল অ্যালেনকে নিয়ে ইন্টেল-৮০৮০ সিপিইউর উপযোগী এমআইটিএস-৪৪০০ তৈরি করেন। এ আবিষ্কারের পর গেটস সফটওয়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। ছাড়েন হার্ভার্ড। কিন্তু প্রথম প্রকল্পে ব্যর্থ হন। মাইক্রোসফটের কো-ফাউন্ডার ও বাল্যবন্ধু পল আর গেটস মিলে ‘ট্রাফ ও ডেটা’ নামে মেশিন তৈরি করেন। যা ট্রাফিক কাউন্টারগুলো থেকে ডেটা সংগ্রহ করে সরকারি ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারদের সরবরাহ করত। যন্ত্রটির ওপেনিংয়ে শিয়াটলের ট্রাফিক সুপারভাইজার আসেন। কিন্তু যন্ত্রটি চালু করার পর কোনোভাবেই কাজ করছিল না। এমন লজ্জা গেটসের জীবনে আর আসেনি। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেন। ধীরে ধীরে মাইক্রোসফটকে সফল করেন। এসব কাজ চলাকালে গেটসকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাফল্যের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮১ সালে মাইক্রোসফট কোম্পানি পূর্ণরূপে গঠিত হয়। কোম্পানির সিইও করা হয় তাঁকে। পরিচালনা পর্ষদকে চেয়ারম্যান করা হয়। ২০০০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি কোম্পানির সিইও হিসেবে নেতৃত্বে ছিলেন। তারপর সিইও পদ থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। সেই সঙ্গে ‘আর্কিটেক্ট সফটওয়্যার’ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবে যুক্ত হন। মাইক্রোসফট সর্বপ্রথম তাদের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ শুরু করে ১৯৮৫ সালের ২০ নভেম্বর। এ সময় তারা আইবিএমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে মাইক্রোসফট কোম্পানি আইবিএম থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করে। বিল গেটস ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন সন্তানের জনক বিল গেটস বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী। গেটস ও মেলিন্ডার দাম্পত্যজীবন বেশিদূর গড়ায়নি। ২০২১ সালে পারিবারিক কলহে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাঁর ৩২তম জন্মদিনের আগে ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রভাবশালীদের তালিকায় সেরা চারজনের একজন নির্বাচিত হন। তিনি প্রায় ৭২.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারের মালিক। এ অর্থের একটি বিশাল অঙ্ক প্রতি বছরই পৃথিবীর দুস্থ ও অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে জমা করেন।

ইলন মাস্ক
পরাজয়ের পথ পেরিয়ে টেসলার প্রতিষ্ঠাতা
মাস্ক টেসলার মাধ্যমে ২০১৬ সালে সোলারসিটিকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের স্টকের বিনিময়ে কিনে নেন। ২০২২ সালে টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেন ইলন মাস্ক
১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে তাঁর জন্ম। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা একজন সফল প্রকৌশলী ছিলেন। মা ছিলেন মডেল ও পুষ্টিবিদ। ইলন মাস্কের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। অনেক মেধাবী হলেও জীবনে তাঁকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়। বয়স যখন ২৪ বছর, তখন মাস্ক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে ক্যালিফোর্নিয়া যান। সেখানে বেশ আগ্রহ নিয়েই পিএইচডি শুরু করেছিলেন; কিন্তু দুই দিন পর সিলিকন ভ্যালিতে ইন্টারনেটের উত্থানের কারণে পিএইচডি ছাড়েন। উদ্যোক্তা হিসেবে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত আইডিয়ার বিকাশ করেন। মাস্ক বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী উদ্যোগ নেন, যেগুলো থেকে তিনি সফল হন। ১৯৯৫ সালে তিনি ও তাঁর ভাই জিপ-২ নামে একটি কোম্পানি শুরু করেন। জিপ-২ সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে লাইসেন্সযুক্ত সফটওয়্যার সরবরাহ করত। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাক কম্পিউটার করপোরেশনের কাছে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে জিপ-২ বিক্রি করে দেন। এ বিক্রি মাস্কের সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়। এরপর হ্যারিস ফ্রিকার, এড হো ও ক্রিস্টোফার পেইনের সঙ্গে এক্স ডটকম প্রতিষ্ঠা করেন। এটি অনলাইন ব্যাংক ছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক মডেল সে সময়ের জন্য নতুন উদ্ভাবন ছিল। এর মাধ্যমে পেপাল নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়। পেপাল অনলাইন পেমেন্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। পেপাল তাঁর সবচেয়ে সফল কোম্পানির একটি হতে যাচ্ছিল; কিন্তু কনফিনিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলসহ মাস্ক ও অংশীদাররা ২০০২ সালে এটি ১.৫ বিলিয়ন স্টক ডিলের জন্য ই-বেতে বিক্রি করেন। পেপালকে একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালের সবচেয়ে বাজে ব্যবসায়িক আইডিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২০০০ সালে হানিমুনে থাকাকালে মাস্ককে সিইও পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি ভবিষ্যতের বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে চোখ ফেরান। তিনি টেসলার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। ২০০৩ সালে কোম্পানিটি চালু করেন। ২০০৬ সালে মাস্কের চাচাতো ভাইয়েরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন সোলারসিটি। এ প্রতিষ্ঠানে মাস্ক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি ছিলেন তাদের প্রধান আর্থিক সহায়তাকারী। মাস্ক টেসলার মাধ্যমে ২০১৬ সালে সোলারসিটিকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের স্টকের বিনিময়ে কিনে নেন। ২০২২ সালে টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেন ইলন মাস্ক। এ ছাড়া ২০১৫ সালে অলাভজনক সংস্থা ওপেনএআই প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০১৬ সালে নিউরালিংক ও বোরিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠান করেন। এ মুহূর্তে পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন ইলন মাস্ক। তাঁর মোট সম্পদ ১৯৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, সফল উদ্ভাবকও। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, ইলন মাস্ক যে উদ্যোগই হাতে নেন, তা সফল হবেই। কিন্তু বাস্তবে তাঁর পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ।

লিওনেল মেসি
হরমোন ঘাটতির পরও বিশ্বসেরা
হাজার হাজার কাচের টুকরোয় লুকিয়ে ছিল মহামূল্যবান হীরা। তাকে খুঁজে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু রোজারিও সেন্তা ফের ছোট এক মাঠে ধুলোবালির মধ্যে খেলতে থাকা সেই হীরার টুকরোকে ঠিকই চিনে নিয়েছিলেন বার্সেলোনার এক স্কাউট। ধুলোমাখা পোশাকের ছোট্ট আদুরে চেহারার শিশুটির ফুটবল নিয়ে কাড়াকাড়ি মুগ্ধ করে দেয় তাঁকে। ভাগ্য খুলে যায় হোর্হে হোসারিওর; যিনি সেই শিশুর বাবা। ছেলে বল নিয়ে ড্রিবলিং-ডজের খেলায় মেতে ওঠে। বাবা তা দেখে মুগ্ধ হন। কেউ একজন তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিল রোজারিওর ক্লাব নিউয়েল ওল্ড বয়েজে। এরপরই হঠাৎ আসে সেই দুঃসংবাদ। ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম’ রোগে আক্রান্ত শিশুটি। সেই রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই গরিব বাবার। আচমকা এলোমেলো হলো সবকিছু। আদরের সন্তানটির গায়ের রং ফিকে হয়ে উঠল। চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা। এটাই লিওনেল মেসির শিশুবেলার গল্প। বয়স তখন ১৩। এ রোগ থেকে সেরে উঠতে তাঁর চিকিৎসায় প্রতি মাসে প্রয়োজন ৯০০ ডলার। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে বাবার। যাঁকে নিয়ে দারিদ্র্য কাটানোর স্বপ্ন দেখছিলেন, সেই অবলম্বনটিই কি না দিনে দিনে শেষ হতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই হোসারিওর কাছে স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসেন সেই ফুটবল স্কাউট। তাদের হাত ধরেই বার্সেলোনায় পা রাখে ১৩ বছরের শিশুটি। পুচকে ওই ফুটবলারের বল নিয়ে ক্যারিশমা দেখে তো মুগ্ধ সবাই। চটজলদি তাঁকে দলে নিতে টিস্যু পেপারেই চুক্তি হয়ে গেল। এরপর বার্সার একাডেমিতে হলো শিশুর পরিচর্যা। সঙ্গে চলল ব্যয়বহুল চিকিৎসা। কার্লোস রেক্সাস বার্সেলোনার তখনকার ক্রীড়া পরিচালক। ছোট্ট লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনায় জায়গা করে দেন তিনিই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন হোর্হে হোসারিও মেসি। যিনি ফ্যাক্টরিতে ছোটখাটো চাকরি করেন। তাঁর স্ত্রী পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ইতালি থেকে তারা পাড়ি জমিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায়। পরিবারের চতুর্থ ছেলের হাত ধরেই যে একদিন এই আর্জেন্টাইন দম্পতির জীবন পাল্টে যাবে, কে জানত? এর পরের গল্প তো সবার জানা। ন্যু ক্যাম্পের ক্লাবে প্রতিভার যত্নআত্তি হলো মেসির। সময়ের পথ ধরে তাঁর অর্জনগুলোও জানা হলো ভক্তদের। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মেসি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০ অ্যাথলিটের একজন। সাতবারের ফিফার বর্ষসেরাকে এ খ্যাতি আর অর্থ বদলে দেয়নি। এখনো সেই আগের মেসিই আছেন তিনি। পা মাটিতেই আছে ১৯৮৭ সালের ২৪ জুনে জন্ম নেওয়া এ খুদে ফুটবল জাদুকরের। সংসার পেতেছেন শৈশবের প্রেমিকা রোজারিওর মেয়ে আন্তেনেল্লা রোকুজ্জোর সঙ্গে। এরই মধ্যে তাদের সংসারে এসেছে তিন সন্তান। ২০০৩ সালের পোর্তোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে বার্সেলোনা সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক মেসির। তখন বয়স ১৬ বছর ১৪৫ দিন। তারপর দুই পায়ের ম্যাজিকে শুধুই লিখেছেন এগিয়ে যাওয়ার গল্প। খুদে জাদুকর থেকে কয়েকবারের বর্ষসেরা। ক্লাব ফুটবলে সব ট্রফিই মিলেছে। ১০টি লা লিগা, চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, তিনটি ফিফা ক্লাব কাপ ট্রফি। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয়, কোপা আমেরিকার শিরোপা জয়। সাফল্যে আকাশ ছুঁয়েছেন। ফুটবল জগতে তাঁর যেন পাওয়ার কিছু নেই!

জ্যাক মা
আর্থিক টানাপোড়েন জয় করে আলিবাবার কর্ণধার
অর্থ বা যোগাযোগ ছাড়া তাঁর এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষা। হাইস্কুল শেষ করে তাই কলেজে ভর্তির আবেদন করেন। কিন্তু দুবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। এরপর প্রচুর পড়াশোনা করে তৃতীয়বারের চেষ্টায় উত্তীর্ণ হন
১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর চীনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের হাংঝুতে তাঁর জন্ম। সে সময় কমিউনিস্ট চীন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। তাঁর পরিবারের কাছে তখন খুব বেশি সম্পদ ছিল না। অন্যান্য শিশুদের মতো তারও কিছু শখ ছিল।
১৯৭২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন হাংঝু সফরের পর শহরটি পর্যটনস্থলে পরিণত হয়। কিশোর বয়সে জ্যাক মা ইংরেজি শেখার বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ট্যুর গাইড হিসেবে শহরের প্রধান প্রধান হোটেলে ঘুরতেন। একজন পর্যটকের সঙ্গে তখন দারুণ বন্ধুত্ব হয়। তিনিই তাঁকে ‘জ্যাক’ নাম দিয়েছিলেন। জ্যাক মা জানতেন, অর্থ বা যোগাযোগ ছাড়া তাঁর এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষা। হাইস্কুল শেষ করে তাই কলেজে ভর্তির আবেদন করেন। কিন্তু দুইবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। এরপর প্রচুর পড়াশোনা করে তৃতীয়বারের চেষ্টায় উত্তীর্ণ হন।
হাংঝু টিচার্স ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৮ সালে স্নাতক শেষ করেন। শুরু হয় চাকরির লড়াই। যত বেশি সম্ভব চাকরির জন্য আবেদন করেন। ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের আগে কেএফসিসহ এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। কম্পিউটার বা কোডিং নিয়ে জ্যাক মার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। তখন অনুবাদ ব্যবসা শুরু করেন। একটি চীনা কোম্পানির অর্থ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে ওই ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম অনলাইনে সার্চ করা শব্দ ছিল ‘বিয়ার’।
কিন্তু তিনি দেখেছিলেন, ফলাফলে কোনো চীনা বিয়ার আসেনি; যা তাঁকে রীতিমতো অবাক করে। তখন তিনি চীনের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাঁর প্রথম দুটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। চার বছর পর তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ১৭ জন বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান। তাদের ‘আলিবাবা’ অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জন্য বিনিয়োগ করতে রাজি করান। সাইটটিতে রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য পোস্ট করেন। গ্রাহকরা সেখান থেকে সরাসরি কিনেন। খুব দ্রুত সাইটটি সারা বিশ্বের মানুষকে আকৃষ্ট করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের মধ্যে কোম্পানিটি গোল্ডম্যান স্যাকস থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার ও সফটব্যাংক থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পায়। ২০০৫ সালে ইয়াহু আলিবাবার প্রায় ৪০ শতাংশ শেয়ারের বিনিময়ে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। আলিবাবার হাত ধরেই জ্যাক মা চীনের ধনকুবের পরিণত হন। কিন্তু খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। স্নাতক শেষ হওয়ার পরে ঝাং ইং নামের এক শিক্ষককে বিয়ে করেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘আমি তাঁর প্রেমে পড়ার কারণ তিনি ব্যর্থতাকে কখনো ভয় পাননি।’

কর্নেল স্যান্ডার্স
পরাজয়ের পাহাড় ডিঙিয়ে কেএফসির মালিক
জীবনের পুরোটা সময় ধরে অত্যন্ত কষ্ট করে চলা স্যান্ডার্সের জীবনে অবশেষে ধরা দেয় সাফল্য। ১৯৬৩ সাল নাগাদ স্যান্ডার্স ৬০০টিরও বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেন
১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ইন্ডিয়ানার হেনরিভিলেতে তাঁর জন্ম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবা উইলবার মারা যান। বাধ্য হয়ে তাঁর মা টম্যাটো ক্যানজাতের ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন। আশপাশের পরিবারের জন্য সেলাইয়ের কাজও করতেন তিনি। অভাবের তাড়নায় ১০ বছর বয়সে স্থানীয় খামারে চাকরি নেন স্যান্ডার্স। গ্রিনউড, ইন্ডিয়ানার বিভিন্ন স্থানে খামারের টুকটাক কাজ করে মাসে ১০ থেকে ১৫ ডলার আয় করতেন। এর মাঝে পড়াশোনারও চেষ্টা করতেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। এর পরবর্তী ২৮ বছরে নানানরকম ছোটখাটো চাকরি ও কাজের মাধ্যমে অতিকষ্টে জীবন চালান। তাঁর চাকরি ও ক্যারিয়ার জীবন ছিল অত্যন্ত অস্থিতিশীল। কিছুদিনের জন্য আমেরিকান আর্মিতেও কাজ করেন। রেইল রোডের ফায়ারম্যান, স্ট্রিটকার কন্ডাক্টর, ইন্স্যুরেন্স সেলসম্যান, সেক্রেটারি, টায়ার বিক্রেতা, ফেরিচালক- এমনকি ধাত্রী হিসেবেও কাজ করেন তিনি। স্যান্ডার্সের পারিবারিক দিকেও নানানরকম দুঃখজনক ঘটনা ছিল। ১৯০৮ সালে তিনি বিয়ে করেন জোসেফাইন কিংকে। জোসেফাইন তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে ছেড়ে গেল। অনেকবার জীবনের পথে হেরে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। অবশেষে ১৯৪৯ সালে ক্লডিয়া লেডিংটন নামের একজন নারীকে বিয়ে করেন। যার সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন। এরপর কেন্টাকির কর্বিন শহরে একটি গ্যাসস্টেশন চালানো শুরু করেন। এ সময় ক্ষুধার্ত ড্রাইভার ও যাত্রীদের জন্য তিনি খাবার রান্না ও বিক্রি শুরু করেন। তাঁর রান্না করা খাবারগুলো মূলত ছিল প্যানে ভাজা মুরগি, হ্যাম, ঢ্যাঁড়শ, শিম ভাজা ও গরম বিস্কুট। এ খাবারগুলো তাঁর রান্নার দক্ষতার জন্য কেন্টাকি অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক বছর পর গ্যাসস্টেশন তুলে রেস্টুরেন্ট দেন তিনি। এ সময় তাঁর রেস্তোরাঁটি বেশ জনপ্রিয় হয়। বহু কষ্টের পর পাওয়া এ সাফল্যের ওপর আবারও দুর্ভাগ্য আঘাত হানে। হাইওয়ে জংশনটি সরিয়ে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়। ব্যস্ত ট্রাফিক, লোকজন, গাড়ি ও যাত্রীদের আনাগোনা কমে যায়। রেস্তোরাঁর বিক্রিও হয় না। ১৯৫৬ সালে তিনি অল্পদামে রেস্তোরাঁটি বিক্রি করেন। রান্নায় নিবেদিতপ্রাণ স্যান্ডার্স এবার তাঁর মুরগির রেসিপি বিক্রি করবেন- এমন ফ্র্যাঞ্চাইজি রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকেন। জীবনের পুরোটা সময় ধরে অত্যন্ত কষ্ট করে চলা স্যান্ডার্সের জীবনে অবশেষে ধরা দেয় সাফল্য। ১৯৬৩ সাল নাগাদ স্যান্ডার্স ৬০০টিরও বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ২ মিলিয়ন ডলারে ব্যবসাটি বিনিয়োগকারীদের হাতে দেন। যারা বছর দুয়েক পর ব্যবসাটিকে পাকাপোক্তভাবে প্রকাশ করে। নির্দিষ্টভাবে তৈরি হয় ‘কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’; সংক্ষেপে ‘কেএফসি’। ১৯৭০ সাল নাগাদ ‘কেএফসি’র ৪৮টি দেশে প্রায় ৩ হাজারের মতো রেস্তোরাঁ ছিল। বর্তমানে কেএফসির ১১৮টি দেশে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি আউটলেট রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮ লাখ ২০ হাজার কর্মী কাজ করে।