রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মনোনয়ন দৌড়ে শতাধিক ব্যবসায়ী

মানিক মুনতাসির ও রুহুল আমিন রাসেল

মনোনয়ন দৌড়ে শতাধিক ব্যবসায়ী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শতাধিক ব্যবসায়ী নেতা মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই পছন্দ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পিছিয়ে নেই বিএনপি সমর্থিতরাও। প্রধান দুই দলে ঠাঁই না পাওয়াদের পছন্দ বর্তমান সংসদের নামে মাত্র বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টি। আবার কেউ কেউ আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে। অনেকেই টাকা দিয়ে বড় দলগুলোর মনোনয়ন কেনার চিন্তাভাবনাও করছেন।

বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, অর্থাৎ দশম সংসদের মোট ১৭৭ এমপি কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। চলতি দশম সংসদে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ৩৭ নেতা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন চারজন। আগামী নির্বাচনে তারাও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। এফবিসিসিআইর সাবেক একাধিক সভাপতি, বিজিএমইএর সাবেক ও বর্তমান নেতা এমন কি জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে নিজ নিজ সমর্থিত দলের সঙ্গে জোর লবিং করছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা শিল্প ও বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। ঢাকা-১ আসন থেকে মনোয়ন পেতে তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। সেই সঙ্গে এলাকায়ও নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।  অন্যদিকে এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুও নির্বাচনী দৌড়ে পিছিয়ে নেই। আসন্ন নির্বাচনে ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে দিন-রাত ছুটে বেড়াচ্ছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপিপন্থি আরেক শীর্ষ ব্যবসায়ী বন্ধ হওয়া সিটিসেলের কর্ণধার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী  এম মোর্শেদ খান, একমির প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান সিনহা। অন্যদিকে বিজিএমএইএর সাবেক সভাপতি এক সময়ের তারকা ফুটবলার আব্দুস সালাম মুর্শেদী ইতিমধ্যে খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আসছে ভোটেও তিনি একই দল থেকে একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী।

জানা গেছে, এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী নেতা ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলটির সাবেক অর্থ ও বাণিজ্য সম্পাদকও ছিলেন। কিন্তু দুই দফা আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হন। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গেল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই কুমিল্লার একটি আসন থেকে এমপি হয়েছেন। কিছুদিন আগে অন্য স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের শীর্ষ পর্যায় থেকেই ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনকে স্বতন্ত্র নির্বাচনের সংকেত দেওয়া হয়েছিল। তবে এবার তিনি নৌকা প্রতীক নিয়েই ভোটযুদ্ধে নামার ইঙ্গিত পেয়েছেন।

জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকজন নারী উদ্যোক্তাও মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। তাদের মধ্যে আছেন- বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেলিমা আহমাদও নৌকায় চড়ে দাউদকান্দি থেকে জাতীয় সংসদে ঢুকতে চান। এফবিসিসিআইর আরেক নারী সদস্য শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সারও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী।

এদিকে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এস এম ফজলুল হক চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। বিজিএমইএ আরেক সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান এখন নারায়াণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সভাপতি। তিনিও নারায়াণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আরেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সী বর্তমানে সংসদ সদস্য। তিনি আবারও রংপুর থেকে নির্বাচন করতে চান।  তিনি আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক।

জানা গেছে, বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান খান বাবু এখন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন করতে চান চুয়াডাঙ্গা-২ (জীবননগর ও দামুড়ডাঙ্গা) আসন থেকে। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক। আর বিজিএমইএর আরেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির নৌকাতেই ভরসা রেখে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যাচ্ছেন নিয়মিত নিজ এলাকায়। বিজিএমইএর আরেক সহ-সভাপতি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস এম মান্নান কচি নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। 

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এফবিসিসিআই পরিচালক ড. কাজী এরতেজা হাসান। ভোরের পাতা গ্রুপের এই কর্ণধার ইরান-বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি। ঢাকার গুলশান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন- এফবিসিসিআইর পরিচালক হাবিব উল্লাহ ডন। গাড়ি, ব্যাংক, পর্যটনসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এই ব্যবসায়ী নেতা বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক। একই সঙ্গে তিনি বারভিডা ও সিআইএস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি। তবে এফবিসিসিআইর আরেক পরিচালক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু নাসের নৌকায় চড়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী থেকে এমপি হতে চান। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সাবেক এই পরিচালক একাধিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গত কয়েকবছর যাবৎ নিজের নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ করছেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন।  রাজধানী পুরান ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ঘনিষ্ট বন্ধু ব্যবসায়ী নেতা আবু মোতালেব ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে পোশাকশিল্প খাতের অন্যতম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে এম শাহিদ রেজা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফেনী-৩ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা ফেনী চেম্বারেরও সভাপতি।

এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চান কুমিল্লা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আফজাল খানের পুত্র ও এফবিসিসিআই পরিচালক মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। নেত্রকোনা-৩ (কেন্দ্র আতপাড়া) আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক নাগিবুল ইসলাম দিপু এবং সোনারগাঁও থেকে নির্বাচন করতে চান এফবিসিসিআই পরিচালক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, মানিকগঞ্জ থেকে নির্বাচন করতে চান তোবারাকুল তোসাদ্দেক হোসাইন টিটু। সংসদ সদস্য আলী আশরাফের ছেলে মুনতাকিম আশরাফ কুমিল্লা-৭ আসন ( চান্দিনা) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী।

চুয়াডাঙ্গা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করছেন এফবিসিসিআইর পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা। তিনি চুয়াডাঙ্গা চেম্বারের সভাপতি ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক। নরসিংদী-৪ (বেলাব ও মনোহরদী) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিকেএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি আসলাম সানি। জামালপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী এফবিসিসিআইর আরেক পরিচালক রেজাউল করিম রেজনু।

এ ছাড়া নির্বাচনী দৌড়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একমির প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান সিনহা। তিনি বিএনপির মুন্সীগঞ্জ জেলা সভাপতি। বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের মধ্যে আরও যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী তারা হলেন-ঢাকা থেকে শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মান্নান ও আবু আশফাক, নারায়ণগঞ্জ থেকে মাহাবুবুুর রহমান সুমন, নজুরুল ইসলাম আজাদ, দীপু ভুইয়া ও শাহ আলম। বাহ্মণবাড়িয়ার নাজমুল আনোয়ার, নাছিরউদ্দীন হাজারী, খালেদ মাহাবুব, কুমিল্লা থেকে আবুল কালাম চৈতী, হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াসিন, মোবাশ্বের আলম ভুইয়া, আলাউদ্দিন আহমেদ, জাকারিয়া তাহের সুমন, কর্নেল আনোয়ারুল আজিম, চাঁদপুর থেকে শেখ ফরিদউদ্দিন আহমেদ মানিক, লায়ন হারুনুর রশীদ, আব্দুল হান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মমিনুর রহমান, জি এম ফজলুল হক, ড. জালাল উদ্দিন, শরীয়তপুর থেকে জামাল কামাল ও কিরন আহমেদ, জয়পুরহাট থেকে ফয়সাল আলিম, দিনাজপুর থেকে হাফিজুর রহমান, নীলফামারী থেকে শামসুজ্জামান, বগুড়া থেকে শুকরানা আহমেদ, বগুড়ার জি এম সিরাজ, পাবনা থেকে সঞ্জু খান, টাঙ্গাইল থেকে স্বপন ফকির ও আব্দুল মতিন, জামালপুর থেকে রশিদুজ্জামান মিল্লাত, শেরপুরের হযরত আলী, ময়মনসিংহের জাকির হোসেন বাবলু, গাজীপুরের সাইয়্যেদুল আলম বাবুল, মানিকগঞ্জের আফরোজা খান রিতা ও মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রামের শামসুদ্দিন, আসলাম চৌধুরী ও এরশাদুল্লাহ, ফরিদপুরের নাসিরউদ্দিন, মাগুরায় কাজী সলিমুল হক কামাল, যশোরের টি এস আইয়ুব, মেহেরপুরের মিল্টন মোর্শেদ, খুলনায় অধ্যাপক মাজেদুর রহমান, শাহ শরীফ কামাল তাজ ও বাগেরহাটের ড. শেখ ফরিদুল আলম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

সর্বশেষ খবর