রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উসকানি থামছে না মিয়ানমারের

সীমান্তের ওপারে চলছে গোলাগুলি, স্থানীয়রা আতঙ্কে, ৭০ পরিবার সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সতর্ক বিজিবি, রাষ্ট্রদূতকে তলব, রাখাইনে জাতিসংঘের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জান্তা সরকারের

কক্সবাজার প্রতিনিধি

সীমান্তে মিয়ানমারের উসকানি যেন থামছেই না। গতকালও কক্সবাজারের উখিয়ার পার্শ¦বর্তী ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। সারা রাত ভয়ে ঘুমাতে পারেনি সীমান্ত এলাকার মানুষ। আতঙ্কগ্রস্ত অনেকেই গত রাতে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল সবচেয়ে বেশি গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। সীমান্ত এলাকার ৭০ পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পরিস্থিতি সামলাতে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে আজ তলব করেছে। অন্যদিকে, শনিবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন ইউএনও সালমা ফেরদৌস। গত শুক্রবার রাতে মর্টার শেলের আঘাতে নিহত রোহিঙ্গা ইকবালের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেছেন বলে উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আবারও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। প্রায় তিন দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকার পর আবার গোলাগুলি শুরু হয়েছে। মর্টার শেলের গোলার বিকট শব্দে কাঁপছে এপারের ভূখণ্ড। এতে এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের ২০ গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের আচারতলী, ঘুমধুুম ইউনিয়নের জলপাইতলী, তুমব্রু, বাইশপাড়ি, মগপাড়া, রেজু গর্জনবুনিয়া, বরইতলী, ফাত্তারঝিরি, উত্তরপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও হিন্দুপাড়া গ্রামের মানুষের দিনরাত কাটছে ভয়ের মধ্যে। এরই মধ্যেই সীমান্তের কাছাকাছি এসব এলাকার মর্টার শেল বিস্ফোরণের পর থেকে আতঙ্কে থাকা ৩৫টি পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেতবুনিয়া হেডম্যানপাড়া এলাকার নূর হোসেনের স্ত্রী খুরশীদ বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সীমান্তে গুলির শব্দে রাতে একদম ঘুমাতে পারিনি। ছোট ছেলেমেয়েরা কান্না করছে। ফকিরাঘোনা এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, ওপারে কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।

তুমব্রুর বাসিন্দা বোরহান আজিজ বলেন, কয়েক দিন ধরে চলা গোলাগুলি দুপুরের আগে থেমে যেত, কিন্তু গতকাল দুপুরেও বন্ধ হয়নি। গোলাগুলি শুরু হওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্রয় শিবিরের কাছাকাছি গোলাগুলি হওয়ায় আতঙ্ক বেশি। তবে আকাশে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টারের ওড়াওড়ি দেখা যায়নি।

এ ব্যাপারে ঘুমধুম ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দীল মোহাম্মদ  ভুট্টু বলেন, তিন দিন ধরে সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ ছিল। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টা থেকে মিয়ানমারে গোলাগুলি হচ্ছে। গুলির বিকট শব্দ এপারে ভেসে আসছে।

ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু এলাকার কৃষক নূরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী কোন সময় গুলি ছোড়ে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তারা গুলি ছোড়লে জবাবদিহি করতে হয় না। সীমান্তে মাইন আতঙ্কে ভুগছেন চাষিরা।

তুমব্রু কোনারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গারা আতঙ্কে রয়েছে। সন্ধ্যার পর ভয় বেশি। তুমব্রু কোনারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দীল মোহাম্মদ এ সমস্যা দ্রুত নিরসন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, গতকাল মর্টার শেল ও ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে হতাহতের পর স্থানীয়রা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ভয়ে সীমান্ত লাগোয়া জুম খেতে ফসল আনতে যেতে পারছেন না তারা। এর মধ্যে সকাল থেকে আবারও সীমান্তের ওপারে কয়েকবার গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।

শুক্রবার রাত ৯টার টার দিকে তুমব্রু নো ম্যানস ল্যান্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন- সেলিম উল্লাহর মেয়ে সাদিয়া জান্নাত (১০), তার স্ত্রী সাবেকুর নাহার (৩০), ছৈয়দ করিমের ছেলে নবী হোসেন (২২), করিমের ছেলে ভুলু (৪৪) ও রহিম উল্লাহর ছেলে আনাছ (১২)। তারা সবাই তুমব্রু নো ম্যানস ল্যান্ডের বাসিন্দা। শুক্রবার দুপুরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু মিয়ানমার সীমান্তে ‘ল্যান্ড মাইন’ বিস্ফোরণে অন্য থাইন চাকমা (২২) নামে এক যুবকের পা উড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত রোহিঙ্গা ইকবালের বড়ভাই মাহাবুব বলেন, ‘হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনতে পায়। ঘর থেকে বাইর হয়ে দেখি ভাই মাটিতে লুটে পড়েন। পরে উদ্ধার করে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।’

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ব?লেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযো?গের কারণে ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা যাতে আতঙ্কিত না হয়, সে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসক জানান, আতঙ্কের কারণে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাদের মানসিক কথা চিন্তা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে একটি গোষ্ঠীর সংঘাত চলছে। সেই সংঘাতের গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ছে। আমরা সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছি। সীমান্তে টহল এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আমরা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। প্রতিনিধি পর্যায়েও প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১৩ আগস্ট থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধ চলছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ২৭১ কিলোমিটার স্থল ও জলসীমানায় তৎপরতা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার। তিন দিন ধরে সেন্ট মার্টিনের বিপরীতে (পূর্ব দিকে) মিয়ানমার জলসীমানায় দেশটির তিনটি নৌবাহিনীর জাহাজ তৎপরতা শুরু করে। তবে সেন্টমার্টিন জলসীমানাতেও তৎপর আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।

স্থানীয় প্রশাসনের উখিয়ার সীমান্ত পরিদর্শন : শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) বিভূতি ভুষণ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব, রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম ও পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী। জানা যায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৩০০ থেকে ৫০০ গজের মধ্যে থাকা প্রায় ৭০টি পরিবার রয়েছে। সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এ ব্যাপারে উখিয়ার সীমান্তবর্তী পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সতর্ক রয়েছে।

সর্বোচ্চ সংযম দেখাচ্ছি মিয়ানমারের ব্যাপারে

বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মিয়ানমারকে অস্ত্র বিক্রি নয় : জাতিসংঘ

 

সর্বশেষ খবর