আদালতের নিষেধাজ্ঞায় সিলেটের সবকটি কোয়ারি থেকে কয়েক বছর ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। ফলে গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ের পিয়াইন ও কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর উৎসমুখে (সাদাপাথর) বিপুল পরিমাণ পাথর মজুত হয়েছে। স্রোতের তোড়ে উজান থেকে আসা পাথর স্তরে স্তরে মজুত হয়েছে দুই নদীর উৎসমুখে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার সুযোগে দুই কোয়ারি থেকে লুট হয়েছে পাথর। তিন দিনে দুই কোয়ারি থেকে প্রভাবশালী রাজনীতিবীদদের ছত্রছায়ায় লুট হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর। পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পদ হারিয়েছেন জেলা বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা। এ ছাড়া বিএনপির দুই নেতাসহ ১৪৪ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি মামলা করেছে।
৫ আগস্টের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়লে থানা ও ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে যায় পুলিশ। স্তিমিত হয়ে আসে বিজিবির নজরদারি। এই সুযোগে জাফলংয়ের পিয়াইন ও কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর উৎসমুখ সাদাপাথর এলাকা থেকে শুরু হয় পাথর লুট। হাজার হাজার শ্রমিক লাগিয়ে প্রভাবশালীরা রাত-দিন পাথর উত্তোলন করেন। লুটের আগে দুই কোয়ারিতে লাখ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত থাকায় পর্যটনস্পট হিসেবে পরিচিত জাফলং ও সাদাপাথরের প্রতি পর্যটকদেরও আকর্ষণ বাড়ে। কিন্তু বর্তমানে লুটের ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয় দুই পর্যটন কেন্দ্র।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, জাফলং থেকে প্রায় ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। আর কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানার ভাষ্যমতে সাদাপাথর থেকে লুট হয়েছে ২০ কোটি টাকার পাথর। যদিও স্থানীয়দের দাবি, দুই কোয়ারি থেকে ১৪০ কোটি নয়, ২০০ কোটি টাকার ওপরে পাথর লুট হয়েছে। কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু লুটের ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় তিনটি ও কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের হলেও মুলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দুই কোয়ারিতে বালু ও পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের বেশির ভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জাফলংয়ের পিয়াইন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের প্রমাণ পেয়ে দলীয় পদ হারান জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম শাহপরান। এ ছাড়া পাথর লুটের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সদ্য অপসারিত চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্সের নাম জড়িয়েছে। জাফলংয়ে পাথর লুটের ঘটনায় বিএনপির এই তিন নেতাসহ ১১৪ জনের বিরুদ্ধে দুই মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট থানায় একটি ও পরিবেশ আদালতে অপর মামলা দায়ের করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার গেজেট প্রকাশের পর থেকে মাঝেমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মজুত পাথরের পরিসংখ্যান রাখা হতো। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ৫ আগস্ট পরবর্তী লুটপাট হওয়ার পর মজুতের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ঘনফুট কমেছে। যার বাজার মূল্য শত কোটি টাকার ওপরে। পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়।
১৩৬টি নৌকা জব্দ
সাদাপাথর চুরি ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীতে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গত রবিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে ১৩৬টি কাঠের তৈরি নৌকা ও ৫০০ ফুট পাথর জব্দ করা হয়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবিদা সুলতানার নেতৃত্বে অভিযানে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরাও অংশ নেন।
জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে ধলাই নদীর উৎসমুখ সাদাপাথর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অসাধু ব্যক্তিরা অবৈধভাবে পাথর লুটপাট করছিল। পুলিশ ও বিজিবি অভিযান করেও পাথর উত্তোলন ও লুটপাট বন্ধ করতে পারছিল না। এ অবস্থায় গত রবিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে সোমবার সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ধলাই নদীতে টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। এ সময় পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ১৩৬টি নৌকা ও ৫০০ ফুট পাথর জব্দ করা হয়।