মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

তিনগুণ শব্দদূষণের শিকার ঢাকাবাসী

বেশি শব্দ ফার্মগেট, শাহজাহানপুর, রামপুরা, মহাখালী, ধোলাইরপাড় ও যাত্রাবাড়ীতে

জিন্নাতুন নূর

তিনগুণ শব্দদূষণের শিকার ঢাকাবাসী

ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে চলাচলকারী প্রায় সব ধরনের যানবাহন চালকরা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজান। এ ব্যাপারে তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা হর্ন বাজিয়ে যান। আবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাতদিন নির্মাণ কাজের জন্য সৃষ্ট বাড়তি শব্দে আশপাশের মানুষের সমস্যা হলেও স্থাপনাটির মালিক বিষয়টি গায়েই লাগান না। এর বাইরে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন- গায়ে হলুদ, জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মাইক ও বিশাল সাউন্ড সিস্টেমের উচ্চশব্দে মানুষের কাজে সমস্যা হলেও আয়োজকরা এ নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। আওয়াজ কমানোর অনুরোধ করলে উল্টো তেড়ে আসেন। মেগাসিটি ঢাকার অধিকাংশ এলাকারই এমন চিত্র হররোজ দেখতে পাওয়া যায়। পরিবেশবিদরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার পরিবেশগত অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে শব্দদূষণ। এর ভয়াবহতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শব্দদূষণের প্রভাবে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নগরবাসী। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে ছাত্রছাত্রী, শিশু, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী এবং গাড়ির চালকরা। পরিবেশ অধিদফতরের আটটি বিভাগীয় শহরের শব্দের মাত্রা পরিমাপ বিষয়ক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভুক্তভোগীদের অনেকেই শব্দদূষণের কারণে কানের অসুস্থতায় ভুগছেন। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। আর ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে বছরব্যাপী এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জরিপটি ৯০ জনের ওপর পরিচালিত হয়। এ জন্য ঢাকার নির্ধারিত স্থানসমূহে শব্দের উৎস পর্যবেক্ষণ ও হর্ন গণনা করা হয়। এতে বলা হয় শহরের শব্দদূষণের উৎস হিসেবে যানবাহন এবং হর্ন প্রধানত দায়ী। এ ছাড়া নির্মাণ কাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মাইকিং, জেনারেটর এবং কল-কারখানার উচ্চশব্দকে শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯ শতাংশই জরিপ পরিচালনার আগের ছয় মাসে কানের অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন বলে জানান। প্রায় ৫ শতাংশই উচ্চশব্দে টেলিভিশন দেখেন অথবা মোবাইলে কথা বলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা উচ্চশব্দে টেলিভিশন দেখেন অথবা মোবাইলে কথা বলে থাকেন বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। এর বাইরে শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক  ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং মানসিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি হতে পারে।

এই জরিপে পাওয়া তথ্যে কল-কারখানা, নির্মাণ কাজ, সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কারণে শব্দদূষণ সৃষ্টি হলেও ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ন ও যানবাহনের আধিক্য মনুষ্যসৃষ্ট শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। আর ঢাকার প্রতিটি স্থানেই শব্দের মাত্রা শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ নির্দেশিত মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানসমূহে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে সরকার শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করে। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকার জন্য পৃথকভাবে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের জেনারেল সেক্রেটারি ডা. আবদুল মতিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীতে শব্দদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঢাকা এখন উচ্চশব্দের নগরী। আর ওই শব্দ মানবদেহের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৫৫ এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল। কিন্তু রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোতে নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া গেছে। ঢাকার নির্বাচিত আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে ‘শাহজাহানপুর’-এ সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১২৮.৪ এবং সর্বনিম্ন ৫০.৭ ডেসিবল। বিধিমালা মোতাবেক মিশ্র এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৬০ এবং রাতে ৫০ ডেসিবল। আর ঢাকার মিশ্র এলাকার মধ্যে ‘ফার্মগেট’ শব্দদূষণের জন্য শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১৩০.২ এবং সর্বনিম্ন ৬৫.৭ ডেসিবল। বিধিমালায় বাণিজ্যিক এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৭০ এবং রাতে ৬০ ডেসিবল। আর বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে ‘রামপুরা’র উলন রোড শব্দদূষণের জন্য শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১২৯.৬ এবং সর্বনিম্ন ৫৪.৭ ডেসিবল। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ নীরব এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবল ঠিক করা হয়েছে। আর জরিপে নির্বাচিত নীরব এলাকাগুলোর মধ্যে ‘আইসিডিডিআর’বি-মহাখালী’ শব্দদূষণের জন্য শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১১০.৯ এবং সর্বনিম্ন ৫২.৮ ডেসিবল। এ ছাড়া শিল্প এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৭৫ এবং রাতে ৭০ ডেসিবল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার শিল্প এলাকার মধ্যে ধোলাইরপাড়-যাত্রাবাড়ীতে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। যেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১২৬.৮ এবং সর্বনিম্ন ৬৪.৫ ডেসিবল। অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে এসব এলাকায় দ্বিগুণের বেশি থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে। জরিপের পর্যবেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী আরও জানা যায়, পরিবহন ব্যবস্থায় প্রায় সব ধরনের যানবাহন থেকে শব্দদূষণ হচ্ছে। তবে জরিপের জন্য নির্ধারিত স্থানগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল শব্দদূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। জরিপের জন্য নির্ধারিত যে স্থানগুলোতে নির্মাণ কাজ চলছিল সেখানে ইট ভাঙার মেশিন ও থাই কাটার মেশিন শব্দদূষণের জন্য বেশি দায়ী। এ ছাড়া শিল্প এলাকায় (কল-কারখানা) শব্দদূষণের মূল কারণ হিসেবে জেনারেটরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর বাসাবাড়ি ও শপিংমলে জেনারেটর ও উচ্চশব্দে মিউজিক প্লেয়ার বাজানোয় শব্দদূষণ হচ্ছে। এমনকি সভা-সমাবেশ এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইক থেকেও শব্দদূষণ হচ্ছে। পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে হর্ন গণনার ফলাফল অনুযায়ী ‘শ্যামলী’ এলাকায় নির্ধারিত স্থানটি হর্ন ব্যবহারের দিক থেকে সবার শীর্ষে। সেখানে ১০ মিনিটে ৫৯৮টি হর্ন বাজানো রেকর্ড করা হয়। যার মধ্যে ১৫৮টি হাইড্রোলিক হর্ন এবং ৪৪০টি সাধারণ হর্ন বাজানো হয়।

সর্বশেষ খবর