চিকিৎসাসেবার জন্য বৃহত্তর সিলেটের কোটি মানুষের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই হাসপাতালে গত কয়েক বছরে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। বেড়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের সুযোগ-সুবিধা। সেবায় সাফল্যের বিভিন্ন স্বীকৃতিও পেয়েছে হাসপাতালটি। কিন্তু এসব সাফল্য আর স্বীকৃতি ম্লান হচ্ছে হাসপাতালটির নিরাপত্তারক্ষীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল কয়েক বছরে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। হাসপাতালে ১০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ বিভাগ চালু, আউটডোর সেবা সম্প্রসারণের লক্ষে ১০ তলা ভবন নির্মাণ, নতুন ক্যাজুয়ালিটি বিভাগ চালু, জরুরি বিভাগকে নতুন রূপে সম্প্রসারণ, হাসপাতালে নতুন একটি ওয়ার্ড চালু, ক্যান্সার চিকিৎসায় অত্যাধুনিক কোবাল্ট-৬০ মেশিন স্থাপন, এইচআইভি ও এইডস রোগের চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা, শিশু ও নবজাতকের চিকিৎসাসেবায় নতুন এনআইসিইউ বিভাগ চালু, অটিজম সেল চালু, বিরল রোগ প্রজেরিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ, টিবি রোগীদের জন্য এক্সপার্ট মেশিন স্থাপন, এআরটি সেন্টার চালু, নতুন এন্ডোক্রাইনোলজি ওয়ার্ড চালু, হাসপাতালকে সিসিটিভির আওতায় আনা, ক্লাবফুট সেন্টার চালু, বার্ন ইউনিট স্থাপন, টেলিমেডিসিন সেন্টার চালুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবার মান বৃদ্ধি করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধাও।
২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুরস্কার, জরুরি প্রসূতি সেবায় ২০১৭ সালে ইএমওসি পুরস্কার লাভ করে ওসমানী হাসপাতাল। গেল বছর বিচ্ছিন্ন অঙ্গ পুনঃস্থাপনে সাফল্য অর্জন করে হাসপাতালটি।
সাধারণ মানুষের আস্থার এই হাসপাতালটির এতোসব সাফল্য নিরাপত্তারক্ষীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি আর দালালচক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে ম্লান হচ্ছে। জানা যায়, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তারক্ষীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। দরপত্র আহবানের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানি নামমাত্র বেতনে এসব নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করে। চার লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দুই বছরের জন্য একেকজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ পায় বলেও অভিযোগ আছে। বেতন কম হওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তারক্ষীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে তারা।
সেবা নিতে আসা মানুষদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক রোগীর সাথে অন্তত একজন করে স্বজন থাকেন। বিভিন্ন প্রয়োজনে রোগীর স্বজনকে হাসপাতালের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু পুনরায় হাসপাতালে প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষীকে দিতে হয় টাকা। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রবেশপথে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা ২০ থেকে ৫০ টাকা করে প্রত্যেকের কাছ থেকে আদায় করে। টাকা না দিলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। এছাড়া হাসপাতালে রোগীকে দেখতে আসা তার স্বজনরাও নিরাপত্তারক্ষীদের টাকা দেয়া ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। অনেক সময় টাকা না দিলে রোগীর স্বজনদের সাথে নিরাপত্তারক্ষীরা দুর্ব্যবহার করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সেবা নিতে আসা সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার জাকির হোসেন, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খবির উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, আমরা রোগীর সাথে আছি। আমরা যখন প্রয়োজনে বাইরে যাই, এরপর ফের হাসপাতালে ঢুকতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীদের টাকা দিতে হয়। না হয় তারা ঢুকতে দেয় না।
এদিকে হাসপাতালে দালালচক্রের কারণেও হয়রানির শিকার হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের। শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের দালাল, এমনকি কতিপয় বেসরকারি ক্লিনিকের দালালরাও ওসমানী হাসপাতালে ঘুর ঘুর করে। নিজেদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর পরীক্ষা করাতে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে টানাটানি শুরু করে এসব দালালচক্র। ক্লিনিকের দালালচক্র ওসমানীতে ভর্তি হওয়ার রোগীদের আরো উন্নত সেবার লোভ দেখিয়ে বাগিয়ে নিতে তৎপর।
সামগ্রিক বিষয়ে ওসমানী হাসপাতালের উপপরিচালক দেবব্রত রায় বলেন, হাসপাতালে নিরাপত্তারক্ষীদের চাঁদাবাজি ও হয়রানির বিষয়টি মিথ্যা নয়। এরা টাকা ছাড়া রোগীর স্বজনদের ঢুকতে দেয় না অভিযোগ আসে প্রায়ই। আমরা অভিযুক্তদের বরখাস্তও করি। তবে নিরাপত্তারক্ষীরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় কাউকে বরখাস্ত করলে তার জায়গায় যে আসে, সেও একই কাজ করে। এদের কারণে শুধু রোগী ও তাদের স্বজনরাই নয়, চিকিৎসকরাও অনেক সময় হয়রানির শিকার হন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা