চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াতের কথায়- গান হচ্ছে ছবির অন্যতম অনুষঙ্গ। যেহেতু চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদন মাধ্যম তাই দর্শকদের বিনোদিত করতে মার্জিত ও মনকাড়া কথায় চমৎকার সুরে গান তৈরি করতে হবে। তাহলেই দর্শক ছবিতে মনের মতো গান পেয়ে বারবার ছবিটি দেখবে এবং ছবিও সফলতা পাবে...
উপমহাদেশের হিট সিনেমার দিকে তাকালে দেখা যায় সিনেমা সুপারহিট হয় গানের কল্যাণে। তাই কমপক্ষে ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত একটি সিনেমার সফলতার জন্য নির্মাতাদের দৃষ্টি থাকত গানের দিকে। শীর্ষ নায়ক-নায়িকাদের পাশাপাশি তারা খুঁজতে থাকেন সেরা কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গীতিকারকে। যে সিনেমার গান শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে সেই সিনেমাই দর্শকপ্রিয়তা পায়- এটি যেন একটা রীতি। ঢাকাই সিনেমার ক্ষেত্রেও বিষয়টি চিরন্তন সত্য। এ দেশের যেসব সিনেমা কালজয়ী হয়েছে এবং সুপার-ডুপার হিট হয়েছে, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে সেসব সিনেমার কোনো না কোনো গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
নব্বই দশকের শেষদিক থেকে সিনেমার গান কৌলীন্য হারাতে থাকে। আগের মতো মুখে মুখে ফিরত না সিনেমার গান। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে আবারও জৌলুস ফিরে পেতে শুরু করেছে ঢাকাই সিনেমার গান। এতে আবার দর্শকনন্দিত গানের সুবাদে সফল হচ্ছে সেই সিনেমা। যেমন ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশকটি সিনেমার গান শ্রোতাদের মাতোয়ারা করেছিল। এগুলো হলো- ‘সুরমা সুরমা’ : ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ সিনেমার গান এটি। গানটি লিখেছেন গীতিকবি জাহিদ আকবর। এ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ইমরান মাহমুদুল ও কোনাল। এর সুর ও সংগীত পরিচালক নাভেদ পারভেজ। গানটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এরপরই আসে ‘ও প্রিয়তমা’ গানটি। প্রিয়তমা সিনেমার গান এটি। ওই বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমার গান হচ্ছে ‘ও প্রিয়তমা’। এ গানটি প্রকাশ্যে আসার পর পরই আশি-নব্বই দশকের আবহ তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। অনেক বছর পর দেশের সর্বত্র সিনেমার এ গানটি বাজতে শোনা গেছে। গানটি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। ‘ও প্রিয়তমা’ গানটি রেডিও-টেলিভিশনেও শ্রোতাদের পছন্দের শীর্ষে ছিল। এ গানটির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বালাম গানে ফিরেছেন। গানটিতে দ্বৈতভাবে কণ্ঠ দিয়েছেন বালাম ও কোনাল। গানটির কথা লিখেছেন আসিফ ইকবাল। এর সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন কলকাতার সংগীত পরিচালক আকাশ সেন। এর পরই ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার ‘ঈশ্বর’ গানটির কথা উল্লেখ করতে হয়। এ গানটিও ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করেছে। গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। অসাধারণ কথার গানটি লিখেছেন গীতিকার সোমেশ্বর অলি। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী রিয়াদ। এর পরই বলতে হয় ‘মেঘের নৌকা’ শিরোনামের গানটির কথা চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার এ গানটি ২০২৩ সালের শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় ছিল। এ গানটির কথা লিখেছেন আসিফ। এটি কণ্ঠে ধারণ করছেন কোনাল ও ইমরান। ২০২৪ সালে রায়হান রাফি পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমার দুষ্টু কোকিল গানে কণ্ঠ দেন সংগীত পরিচালক এবং কণ্ঠশিল্পী আকাশ সেন ও দিলশাদ নাহার কণা। গানটি কথা, সুর ও সংগীত করেন আকাশ সেন। গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, এটি ইউটিউবে প্রকাশের পর পরই ট্রেন্ডিংয়ে চলে আসে। ট্রেন্ডিংয়ে শীর্ষ কনটেন্টের তালিকায় জায়গা করে নেয় এ গানটি। এটিও ইউটিউবে ৩৩ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। এ সিনেমার আরেকটি গান ‘লাগে উরাধুরা’র গীতিকার হলেন রাসেল মাহমুদ ও শরীফ উদ্দিন। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রীতম হাসান ও দেবশ্রী অন্তরা। গানটি ইউটিউবে প্রকাশের পর পরই বাংলাদেশে ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে শীর্ষ কনটেন্টের তালিকায় জায়গা করে নেয়। ইউটিউবে গানের বৈশ্বিক তালিকায় উঠে আসে। ২০২৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জ্বীন-থ্রি’ সিনেমার ‘কন্যারে’ গানটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায় এবং ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ের এক নম্বর অবস্থানে জায়গা করে নেয়। গানটির গীতিকার হলেন রবিউল ইসলাম জীবন। গেয়েছেন ইমরান ও কণা এবং সংগীতায়োজন করেন ইমরান। এ সিনেমার ‘ব্যবধান’ গানটিও দর্শক-শ্রোতার মন কাড়ে। এ বছরেই মুক্তি পাওয়া ‘টগর’-সিনেমার গান ‘১০০% দেশি’ দর্শক-শ্রোতার মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে। কামরুজ্জামান রাব্বি ও কর্ণিয়ার কণ্ঠে গাওয়া এ গানটিতে রয়েছে দেশীয় উৎসবের রং ও প্রাণ। গানটির সুর ও গায়কির সঙ্গে দারুণ মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে চিত্রায়ণ।
এদিকে এ বছর মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’ সিনেমার গান ‘দ্বিধা’, এটি লিখেছেন ইনামুল তাহসিন এবং সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন প্রীতম হাসান। দ্বিতীয় গান নিঃশ্বাসে কণ্ঠ দেন জি এম আশরাফ এবং সংগীত আয়োজন করেন আদিব কবির। তৃতীয় গান ‘চাঁদ মামা’ গানটির কথা, সুর ও কণ্ঠ প্রীতম হাসানের এবং এতে ডোলা রহমানও কণ্ঠ দেন। গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে শীর্ষস্থান করে নেয়। সব শেষে বলতে হয়, গানের ক্যারিশমা সিনেমার সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক বলে খোদ এহতেশামই বলেছিলেন। একসময় চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হতো- ‘আসিতেছে গানের ছবি, প্রাণের ছবি...’, মানে নির্মাতারা সিনেমা হিট করার জন্য গল্পের পাশাপাশি গানকে প্রাধান্য দিতেন আর সুফলও পেতেন। মানে গানের জোরেই ছবি হিট হয়ে যেত। এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াতের কথায়- গান হচ্ছে ছবির অন্যতম অনুষঙ্গ। যেহেতু চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদন মাধ্যম, তাই দর্শকদের বিনোদিত করতে মার্জিত ও মনকাড়া কথায় চমৎকার সুরে গান তৈরি করতে হবে। তাহলেই দর্শক ছবিতে মনের মতো গান পেয়ে বারবার ছবিটি দেখবে এবং ছবিটি সফলতা পাবে।
নব্বই দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত যেসব গান সাড়া জাগিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো- ‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন’ (বাবা কেন চাকর, ১৯৯৪), ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ (আনন্দ অশ্রু, ১৯৯৪), ‘এই দিন সেই দিন চিরদিন’ (স্বপ্নের ঠিকানা, ১৯৯৫), ‘আয়না তুমি মোর হৃদয়ের আয়না’ (হৃদয়ের আয়না, ১৯৯৫), ‘পড়ে না চোখের পলক’ (প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ১৯৯৬), ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর’ (সত্যের মৃত্যু নেই), ‘আম্মাজান আম্মাজান’ (আম্মাজান, ১৯৯৯), ‘মনের মাঝে তুমি’ (মনের মাঝে তুমি, ২০০৩), ‘যাও পাখি বল তারে’ (মনপুরা, ২০০৫), ‘ভালোবাসবো বাসবোরে’ (হৃদয়ের কথা, ২০০৫), ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ (শ্রাবণ মেঘের দিন, ১৯৯৯), ‘বরষার প্রথম দিনে’ (দুই দুয়ারী, ২০০৬), ‘ও আমার ওরাল পঙ্খীরে’ (চন্দ্রকথা, ২০০০), ‘আঁচল দিলাম বিছাইয়া’ (মোল্লাবাড়ির বউ, ২০০৫), ‘পৃথিবীর যত সুখ’ (আকাশছোঁয়া ভালোবাসা, ২০০৮), ‘তোমারে দেখিলো নয়নও ভরিয়া’ (চন্দ্রগ্রহণ, ২০০৮), ‘সোয়া উড়িলো উড়িলো’ (ঘেটুপুত্র কমলা, ২০১৪), ‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাব’ (পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, ২০১৩), ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ এবং ‘না জানি কোন অপরাধে’ (সত্তা, ২০১৪), ‘আমি তোমার মনের ভেতর’ (এই তো প্রেম, ২০১৪), ‘দিল দিল দিল’ (বসগিরি, ২০১৬), ‘সুতো কাটা ঘুড়ি’ (পোড়ামন-২, ২০১৪), ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ (ছুঁয়ে দিলে মন, ২০১৫) ইত্যাদি।