চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম ঢাকাই চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর হাত ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর ছিল দারুণ অবদান। এ নির্মাতা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সিনেমা নির্মাণ করে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময়। তাঁর হাত ধরে রঙিন দুনিয়ায় পদার্পণ করেন পরবর্তী চলচ্চিত্র জগতের রথী-মহারথীরা। তাঁর ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা বলতে আদতে কোনো শব্দ ছিল না। ক্যাপ্টেন এহতেশাম নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। পুরো নাম আবু নূর মুহাম্মদ এহতেশামুল হক। ১৯২৭ সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার বংশালে তাঁর জন্ম। পড়াশোনার পর তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সামরিক বাহিনীর এক রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন পদাধিকার পান। জানা যায়, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সৈন্য হয়ে। পরে তিনি বদলি হয়ে চলে যান করাচিতে। করাচিতে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। সে সময় পাকিস্তানি পরিচালক আশিক মল্লিকের ‘বাঘী’ সিনেমার শুটিং চলছিল ধারে-কাছেই। এহতেশাম খানিকটা উৎসুক হয়েই শুটিং দেখতে যান।
শুটিং দেখেই বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ধাপে ধাপে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াটা তাঁর মনটাকে বেশ দোলা দেয়। চলচ্চিত্র নামক এই বিশাল আর বিস্তৃত শিল্প মাধ্যমের সমুদ্রে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান এহতেশাম। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই সামরিক জীবনের শৃঙ্খলিত যাপন তার দ্বারা আর সম্ভব নয়। পরিবর্তন চাই এবার। ১৯৪৬ সালে নাটোর, লালমনিরহাট এবং সান্তাহারে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে এসে বনে যান চলচ্চিত্রের পরিবেশক ও প্রদর্শক। উর্দু আর হিন্দি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র দেখানো শুরু করেন তিনি। ব্যবসায় নেমেই ব্যাপক সফলতার মুখ দেখেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইচ্ছে জাগে চলচ্চিত্র প্রযোজনার। নিজেকে যেন সত্যিকার অর্থেই চলচ্চিত্র জগতে খুঁজে পান এহতেশাম। পাকিস্তানি এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি একজন সিনেমা নির্মাতা হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্র জগতের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একজন পরিচালক হিসেবেও মান্য করা হয় তাঁকে। ১৯৫০ সালে এহতেশাম প্রথম চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন একজন চলচ্চিত্র পরিবেশক হিসেবে। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে তিনি ‘লিও ফিল্মস’ নামে একটি চলচ্চিত্র বিতরণ সংস্থা (ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) শুরু করেন। পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক হয় ‘এই দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্র দিয়ে; যা ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার হয়েছিল। এ ছবির মাধ্যমে এ দেশে রোমান্টিক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের দুয়ার খুলে দেন তিনি। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে সফল হওয়ার পর এহতেশাম দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় তাঁর ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রটি। ব্যবসায়িক সফলতার পাশাপাশি এহতেশামের খ্যাতি এনে দেয় এ চলচ্চিত্র। সিনেমাটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, একটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। এই কালজয়ী গানটি হলো সাংবাদিক কে জি মুস্তাফার লিখা ও তালাত মাহমুদের গাওয়া- ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে...।’ পূর্ব আর পশ্চিম, দুই পাকিস্তানে ব্যাপক দর্শকনন্দিত হয় তাঁর সিনেমা দুটি। এরপর ষাটের দশকের প্রাক্কাল থেকেই একের পর এক ব্যবসা সফল আর দর্শকনন্দিত সব চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকেন তিনি। সেই সময়কার পাকিস্তানি পত্রিকা ‘ডন’-এ এক সাংবাদিক লিখেছিলেন, সিনেমা বানানো শিখতে চাইলে যেতে হবে সিনেমার তীর্থস্থান ঢাকাতে। ‘হারানো দিন’ (১৯৬১), ‘চান্দা’ (১৯৬২- বাংলাদেশের প্রথম উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র), ‘নতুন সুর’ (১৯৬২), ‘তালাশ’ (১৯৬৩), ‘সাগর’ (১৯৬৪-১৯৬৫ সালে জহির রায়হানের সংগ্রাম চলচ্চিত্রের পর এটিই ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রঙিন চলচ্চিত্র), ‘চকোরী’ (১৯৬৭), ‘পীচঢালা পথ’ (১৯৬৮), ‘চাঁদ আর চাঁদনী’ (১৯৬৮), ‘পায়েল’ (১৯৬৮), ‘আনাড়ি’ (১৯৬৯), ‘দাগ’ (১৯৬৯), ‘দূরদেশ’ (১৯৮৩- বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান যৌথভাবে নির্মিত), ‘শক্তি’ (১৯৮৪), ‘চাঁদনী’ (১৯৯১), ‘চাঁদনী রাতে’ (১৯৯৩), ‘মৌমাছি’ (১৯৯৬) ইত্যাদি তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা। ১৯৮৩ সালে তাঁর মুভি ‘দূরদেশ’ একযোগে তিনটি ভাষায় মুক্তি পায়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনার এ সিনেমায় অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন শশী কাপুর, নাদিম বেগ, শর্মিলা ঠাকুর, ববিতা, রাজ বব্বর প্রমুখ। অনেক নামিদামি অভিনেতা-অভিনেত্রী আবিষ্কারের কৃতিত্ব রয়েছে তার ঝুলিতে। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। বরং নিজের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রতিভার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি জহির রায়হানের মতো পরিচালকও চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেছিল তাঁরই হাত ধরে। এ ছাড়া, প্রযোজক ও পরিচালক মুস্তাফিজুল হক, আজিজুর রহমান, আইআর খান, কামাল আহমেদ, শিবলী সাদিকদের উত্থান হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। শুধুই কি প্রযোজক আর পরিচালক? সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ এবং শাহনাজ রহমতুল্লাহর মতো গায়িকাকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর সিনেমাতেই প্রথম নারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন ফেরদৌসী রহমান। ‘শাব’ একটি উর্দু শব্দ। যার অর্থ রাতের আলো। রাতের অন্ধকারে আলো যে মায়াজাল তৈরি করে, সেটা বিশেষ পছন্দের ছিল এহতেশামের কাছে। আর তাই, তার হাত ধরে আসা সব নায়িকার নামটাও শুরু হয়েছিল এই শব্দ দিয়েই। আফরোজা সুলতানা রত্না থেকে শাবানা, ঝর্ণা বসাক থেকে শবনম, কাজী শারমিন নাহিদ নূপুর থেকে শাবনূর এবং সাবরীনা তানিয়া থেকে শাবনাজ। এ ছাড়া, গোলাম মুস্তাফা, আজিম, রহমান, নাদিম বেগ, চিত্রা জহির, নাইম, খান জয়নুল, রাণী সরকার, সাদেক বাচ্চু, সাব্বির, শামস, মুনমুন এবং আরও অনেকেই চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেছিলেন এহতেশামের কল্যাণেই। আর তাই হয়তো, ছোট থেকে বুড়ো- চলচ্চিত্র জগতের সবাই তাঁকে ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করতেন। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ নামক একটি সিনেমা নির্মাণ করার কথা ছিল তাঁর। পাণ্ডুলিপির কাজও গুছিয়ে এনেছিলেন। চলচ্চিত্র জগত অপেক্ষায় ছিল এই গ্র্যান্ডমাস্টারের নতুন চমকের আশায়। কিন্তু ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতের ঘুমকে পরিপূর্ণতা দান করে চিরদিনের জন্য ঘুমের দেশে পাড়ি জমান এহতেশাম। তাই বলা হয়, তাঁর শেষ ইচ্ছেটা আর পূরণ হলো না।