ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার যুদ্ধ বন্ধে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফার যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে বড় পরিবর্তন এনেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ ঘটনায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্ডান, কাতারসহ অন্য আরব দেশগুলো। সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর, রয়টার্স, আলজাজিরা। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর বৈঠকের আগের সপ্তাহে আট আরব ও মুসলিম দেশের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তাঁরা ২১ দফা নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর আরব নেতারা জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে এতে ধারণা করা হচ্ছে, গাজার যুদ্ধ বন্ধ হবে। তবে আরব ও ইসলামি নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্প যেসব দফা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, সেগুলোয় বড় পরিবর্তন এনেছেন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পের সঙ্গে সোমবারের বৈঠকের আগে শেষ মুহূর্তে এসব পরিবর্তন আনেন তিনি।
আরব আলোচকদের দুটি সূত্র জানিয়েছেন, হামাসকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের যে খসড়া দেওয়া হয়েছে, এটি আরব-মুসলিম নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি করা ট্রাম্পের খসড়ার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। তাঁরা বলেছেন, প্রথমে এটি ছিল একটি যৌথ প্রচেষ্টা। কিন্তু এখন এ বিষয়টিকে ইসরায়েল ‘শান্তি’র পরিবর্তে শুধু নিজেদের নিরাপত্তার টুল হিসেবে ব্যবহার করছে। সবচেয়ে যে পরিবর্তনটি নেতানিয়াহু এনেছেন, তা হলো ইসরায়েলি সেনাদের গাজা থেকে প্রত্যাহার সম্পর্কিত। এখানে সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে নেতানিয়াহু কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট সময়সীমাও উল্লেখ করা হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এখন যে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে সেখানে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি সম্পূর্ণ হামাসের নিরস্ত্রকরণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ হামাস নিজেদের নিরস্ত্র না করলে দখলদার ইসরায়েল তাদের সেনাদের গাজা থেকে প্রত্যাহার করবে না।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওসকে যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়ে হামাস কোনো পরিবর্তন চাইলে তা বিবেচনা করা হবে। কিন্তু প্রস্তাবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
গাজার ‘বিপজ্জনক অবস্থানে’ ত্রাণবাহী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা : গাজা অভিমুখী আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলের ঘোষিত ‘বিপৎসীমায়’ প্রবেশ করেছে। এ খবর পাওয়া পর্যন্ত নৌবহরটি গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার বা প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। বহরে অংশগ্রহণ করছেন পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হুমকির কারণে যে কোনো মুহূর্তে নৌবহর বাধার মুখে পড়তে পারে। কারণ ইসরায়েলি সেনারা তাদের নৌকমান্ডো ইউনিট ‘শায়েতেত ১৩’-কে প্রস্তুত অবস্থায় রেখেছেন এবং হুমকি দিয়ে বলেছেন, নৌবহর গাজার জলসীমায় প্রবেশ করা মাত্রই সামরিক অভিযান চালিয়ে জাহাজগুলো আটক করা হবে। এজন্য এ কমান্ডো ইউনিট এরই মধ্যে সমুদ্রে জাহাজ আটকানোর মহড়াও দিয়েছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নৌবহরের সব জাহাজে অংশগ্রহণকারীরা অবস্থান করছেন এবং যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। জাহাজগুলোয় মানবিক সহায়তা বহন করা হচ্ছে। এতে খাবার, চিকিৎসাসামগ্রী এবং অন্যান্য জরুরি সরঞ্জাম রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নৌবহরের একটি জাহাজে থাকা ক্রোয়েশিয়ার আইনজীবী মোরানা মিলজানোভিচ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক জলসীমা বা অন্য দেশের আঞ্চলিক জলসীমায় বেসামরিক জাহাজ আটকানোর কোনো অধিকার ইসরায়েলের নেই। তিনি বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক প্রচলিত আইনের বিষয়। কোনো রাষ্ট্রই সাধারণ আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে বেসামরিক নৌবহরকে চাইলেই আটকাতে পারে না।’ এদিকে ইসরায়েল এ ফ্লোটিলার গতি রোধ করতে বদ্ধপরিকর বলে আবারও বলা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর ভাষ্য, গাজায় অবরোধ আইনসিদ্ধ। ওই স্বেচ্ছাসেবীরা সেই আইনগত অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছেন।
গতকাল বাংলাদেশ সময় বেলা পৌনে ২টার দিকে ফ্লোটিলা অভিযানের অন্যতম আয়োজক ডেভিড অ্যাডলার সমাজমাধ্যম এক্সে লেখেন, ‘আশঙ্কা করছি, এটি আমার শেষ চিঠি। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে বলছি। এখন গাজার উপকূল থেকে প্রায় ১২০ নটিক্যাল মাইল দূরে আছি। গত রাতে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর কয়েকটি জাহাজ আমাদের হুমকি দেয়। আমাদের জাহাজে আক্রমণ করে, আমাদের ক্রুদের ভয় দেখায় ও আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’ সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ফ্লোটিলা যতই গাজার জলসীমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি : গাজা শান্তি পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য হামাসকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস তার প্রস্তাবিত গাজা শান্তিচুক্তি গ্রহণ না করলে তাদের কঠোর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে কয়েক দিনের মধ্যেই।’ ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকোতে মার্কিন জেনারেল ও অ্যাডমিরালদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের কেবল একটি স্বাক্ষর দরকার, আর যদি তারা স্বাক্ষর না করে তবে সেই স্বাক্ষরের মূল্য নরকে দিতে হবে। আমি আশা করি তারা নিজেদের মঙ্গলের জন্য স্বাক্ষর করবে এবং সত্যিই কিছু মহান সৃষ্টি করবে।’ এর আগে সাংবাদিকদের তিনি জানান, প্রস্তাবিত চুক্তির জবাব দিতে হামাসকে ‘তিন বা চার দিন’ সময় দিচ্ছেন তিনি।