চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। চসিকের উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা, সিন্ডিকেট কারসাজি, অর্থ তছরুপ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পদায়নের রয়েছে অভিযোগ। তার এসব দুর্নীতির অভিযোগ নজরে আসার পর প্রধান নির্বাহীকে অপসারণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন অভিযোগ করেন, ‘চসিকের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল দীর্ঘদিন নিজ দপ্তরে আটকিয়ে রাখতেন তৌহিদুল। ৫১ কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স ঘষামাজার ঘটনায় চরমভাবে দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে রবিবার বিকাল পর্যন্ত তাকে দপ্তরে পাওয়া যেত না। পরিবারকে সময় দিতে চলে যেতেন ঢাকায়। কিন্তু টিএ বিল নিতেন চসিক থেকে। তিনি অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। যতটুকু জেনেছি বিভিন্ন সংস্থা তার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে। নগরের উন্নয়নের স্বার্থে এক প্রকার বাধ্য হয়ে তার বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিধির বাইরে গিয়ে চসিকে কোনো অন্যায় কাজ করিনি। উন্নয়ন কাজে বাধা নয়, বরং চসিকের স্বার্থেই উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল পর্যালোচনা করতে সময় নিয়েছি। দায়িত্ব পালনকালে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়াইনি।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম উত্তর যুবলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত এস এম রাশেদুল আলমের হাত ধরেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চসিকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ পদ পেতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কোয়াস। চসিকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তৌহিদুল-রাশেদের যৌথ নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে চসিকের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এ সিন্ডিকেট প্রতিটা উন্নয়ন কাজের জন্য ৬ থেকে ৮ শতাংশ কমিশন গ্রহণ করত। এভাবে আড়াই বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে। অভিযোগ রয়েছে- চসিকের দুটি হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ ৫১ কোটি টাকা ঘষামাজা করে কর কমানোর বিষয়টি ২০২৩ সালে উদ্ঘাটিত হলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি প্রধান নির্বাহী। রিভিউ বোর্ড বাতিল করে পুনরায় রিভিউ বোর্ডের ব্যবস্থা করেননি। এ ছাড়া হোল্ডিং ট্যাক্স কারসাজির আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তৌহিদ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এ সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে শত কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সিটি করপোরেশন। চসিকের হোল্ডিং ট্যাক্স এবং ট্রেড লাইসেন্স অটোমেশন করার জন্য বিগত সরকার এটিএন অ্যান্ড আরকে সফটওয়্যার লিমিটেডকে ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কার্যাদেশ প্রদান করেন। এ প্রকল্প অসমাপ্ত থেকে গেলেও ওই কোম্পানিকে ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা পরিশোধ করেন প্রধান নির্বাহী। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ব্যক্তিগত ঢাকার সফরকে সরকারি হিসেবে দেখিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চসিকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিএ বিল করেন ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৭৭ টাকা। যার মধ্যে ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র আট মাসে টিএ বিল করেন ৮ লাখ ২২ হাজার ৮৯৫ টাকা! অভিযোগ রয়েছে- প্রতি বৃহস্পতিবারই দুপুরে পরিবারকে সময় দিতে চলে যেতেন ঢাকায়। অফিসে যোগদান করতেন পরের সপ্তাহে রবিবার বিকালে। এতে করে বিঘ্ন হতো চসিকের যাবতীয় কার্যক্রমে। অতীতের চসিকের প্রকৌশলীদের পর্যায়ক্রমে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানোর রেওয়াজ থাকলে তিনি প্রকৌশলীদের না পাঠিয়ে নিজেই চলে যেতেন প্রশিক্ষণের জন্য। তিনি নিজে প্রকৌশলী না হয়েও জাপান, ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কোরিয়া গিয়ে প্রকৌশলী হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাৎ দায়িত্বে আসার পর নগরবাসীর ভোগান্তি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী দুই শতাধিক প্রকল্পের প্রাক্কলন কোনো কারণ ব্যতীত নিজ ডেস্কে ছয় মাসের অধিক সময় আটকে রাখেন। কার্যক্রমের দরপত্র বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া প্রায় ৮০ কোটি টাকার ১০টি টেন্ডার মূল্যায়ন চার মাস ধরে আটকে রেখে রিটেন্ডার করেন। অভিযোগ রয়েছে তিনি সব বিভাগের ফাইল ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখলেও পরিচ্ছন্ন বিভাগের সব ফাইল নিজ উদ্যোগে ফাইল পাস ও বিল প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রকৌশলী শাহীনুল ইসলামকে চসিকে কর্মরত না থাকা অবস্থায় পদোন্নতি দেন। তাকে পুনরায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বদলি করে আনার জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তাকে অস্থায়ী থাকা অবস্থায় তাকে পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস প্রকল্পে বিশেষ সুবিধা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতীত পিডি হিসেবে নিয়োগ দেন। দেড় বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলী মাহমুদ সাফকাতকে চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই বানিয়ে দেন নির্বাহী প্রকৌশলী। তার স্ত্রী উপসচিব নুরে মাহবুবা জয়া বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখার ২, ৩, ৪ এবং সুরক্ষা বিভাগের বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। শ্বশুর রাজশাহী আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এ দুই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বিগত সরকারের আমলে চসিকে ধরাকে সরাজ্ঞান করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।