জলবায়ু অর্থায়নের নামে উচ্চ সুদের ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উপর। বছরের পর বছর ঋণের সুদ টানতে গিয়ে দেউলিয়াত্বের ঝুঁকিতে পড়ছে অনেক দেশ। এসব দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মাথাপিছু ঋণের বোঝা। সেই তালিকায় আছে বাংলাদেশের নামও।
জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা ৫৫টি দেশ ২০২৩ সালে ঋণদাতাদের পরিশোধ করেছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অথচ জলবায়ু অভিযোজন/প্রতিরোধে দেশগুলো পেয়েছিল মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার। এসব দেশে গড়ে প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু জলবায়ু-তকমাযুক্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩.১২ মার্কিন ডলার।
ক্লাইমেট ডেব্ট রিস্ক ইনডেক্স-সিডিআরআই ২০২৫ (জলবায়ু ঋণ ঝুঁকি সূচক)-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ও ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ওয়াইপিএসএ) যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। ব্রাজিলের বেলেমে ১৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। জলবায়ু সম্মেলন (কপ৩০) চলাকালে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনটির তথ্য বৈশ্বিক মঞ্চে ন্যায্য দাবি আদায়ে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সহযোগিতা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী, সিআইএফ পর্যবেক্ষক ও প্রতিবেদনের প্রধান লেখক মো. জাকির হোসেন খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে অনেক দেশ দুইবার মূল্য দিচ্ছে। একবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির জন্য, আরেকবার ঋণের জন্য। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যেখানে, সেখানেই অর্থ আসে দেরিতে এবং ঋণের আকারে। এতে আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল হয় এবং মানুষ ও প্রকৃতি রক্ষায় বিলম্ব ঘটে।
তিনি বলেন, বিশ্বে অর্থের সংকট নেই। সংকট রয়েছে নিয়ম ও প্রতিশ্রুতির। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জলবায়ু অর্থায়ন ঘাটতি অর্থনৈতিক অক্ষমতা নয়; এটি ক্ষমতার রাজনীতি ও স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন নীতির ফল। সামান্য বৈশ্বিক কার্বন কর ও অস্ত্র শুল্ক থেকে বছরে ছয় ট্রিলিয়ন ডলার তোলা সম্ভব। এর এক-তৃতীয়াংশ দুর্বল দেশ, ক্ষয়িষ্ণু বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দিলে সেটা দান নয়, এটি বৈধ ‘ঋণ পরিশোধ’।
প্রতিবেদনের ফলাফল তুলে ধরে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা বিশ্লেষক সাবরিন সুলতানা ও সামিরা বাশার বলেন, ঋণ-নির্ভর জলবায়ু অর্থায়ন, অর্থ ছাড়ে ধীরগতি এবং জলবায়ু দুর্যোগে উচ্চমাত্রার ঝুঁকি-এই তিনটি মিলে বহু স্বল্পোন্নত ও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে ঋণের ঝুঁকি দ্রুত বাড়িয়ে তুলছে। প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ৫৫ দেশের মধ্যে ৪৭টি ‘‘উচ্চ’’ বা ‘‘অত্যন্ত উচ্চ’’ ঝুঁকিতে রয়েছে। মাত্র ২টি দেশ রয়েছে “স্বল্প ঝুঁকিতে”। মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি ঋণের বোঝা দক্ষিণ এশিয়ায় ২৯.৮৭ ডলার, এরপর পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে ২৩.৫৮ ডলার ও সাব-সাহারান আফ্রিকায় ২১.৬১ ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অর্থনীতিতে ঋণ-ভিত্তিক জলবায়ু তহবিলের হার খুবই বেশি।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ঋণভিত্তিক অর্থায়ন অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সালে বাংলাদেশ, জিবুতি, লাইবেরিয়া ও উগান্ডা অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় চলে যাবে। এখনই অনুদান, রূপান্তর ও ঋণ-অদলবদল না করলে এটি কাঠামোগত জলবায়ু-ঋণ নির্ভরতা তৈরি করবে। এছাড়া অনেক দেশে প্রতিশ্রুতির তুলনায় অর্থ ছাড়ের হার নগণ্য হওয়ায় জরুরি প্রকল্পগুলো বিলম্বিত হচ্ছে, যা বহুমাত্রিক ক্ষতির পরিস্থিতি তৈরি করছে। এছাড়া মোট জলবায়ু অর্থের প্রায় ৩২% যাচ্ছে জ্বালানি খাতে-যা বড় ও ঋণ-নির্ভর প্রকল্প। অথচ কৃষি, পানি, বাস্তুতন্ত্রের মতো মানুষের জীবনরক্ষার খাতগুলো মারাত্মকভাবে অবহেলিত।
ওয়াইপিএসএ’র প্রধান নির্বাহী ড. আরিফুর রহমান বলেন, বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জমি হারানো বাড়তি বোঝা। তাই এখনই ন্যায়সঙ্গত অর্থায়ন জরুরি।
এলডিসি ইউনিভার্সিটিজ কনসোর্টিয়াম অন ক্লাইমেট চেঞ্জের টেকনিক্যাল লিড প্রফেসর মিজান আর. খান বলেন, আইএমএফ ও জি২০ ঋণ কাঠামো নিম্ন-আয়ের দেশগুলোকে বিপদে ফেলছে। আমাদের দরকার বৈশ্বিক ট্যাক্স কনভেনশন এবং উচ্চ নিঃসরণ খাত থেকে সংহতি শুল্ক। অভিযোজনের জন্য ঋণ দেওয়া এলডিসি ও এসআইডিএসের প্রতি অবিচার।
ওয়াইপিএসএ’র পরিচালক ও ক্যানসা বাংলাদেশের চেয়ার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, জলবায়ু ঋণ দুর্বল দেশগুলোতে জীবিকা হারানো, অভিবাসন বৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের অবনতি ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। তাই জরুরি বৈশ্বিক পদক্ষেপ ও ন্যায্য অর্থায়ন এখন অপরিহার্য।
বিডি প্রতিদিন/এমআই