বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাসে যুগান্তকারী নাম প্রখ্যাত বাউল-ফোক শিল্পী, বংশীবাদক ও সুরসাধক বারী সিদ্দিকী। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর রেডিও খুললেই যে সুরটা ভেসে আসত, তার প্রথম শেখা হাহাকার ছিল বারী সিদ্দিকীর বাঁশি। যেন রাতের উপর বাতাসে অদৃশ্য কেউ ফুঁ দিয়েছে, আর নিঃশব্দে আমাদের ঘরকে ভরিয়ে দিয়েছে এক ধরনের প্রশান্ত দুঃখে। বারী সিদ্দিকী ছিলেন সেই মানুষ, যার গানে বেদনা কখনো সাজানো ফুলের মতো নয়, যেন মাটির ঘ্রাণে ভেজা সত্যিকার কান্না। তাঁর গান কেবল সুর ও বাণীর মেলবন্ধন নয় বরং মানুষের আত্মার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। বারী সিদ্দিকী ছিলেন আলাদা উচ্চতায়। তাঁর কণ্ঠে ‘শুয়া চান পাখি’ থেকে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’-সবই যেন জীবনের গভীরতম বেদনার প্রতিধ্বনি। আজও তাঁর প্রয়াণ দিবস এলে মন ভরে ওঠে অসংখ্য স্মৃতি, গান, গল্পে-যার বেশির ভাগই যেন বহমান লোকসংস্কৃতি আর হুমায়ূনীয় আবেগে আচ্ছন্ন।
লোকসংগীতের আধ্যাত্মিক যাত্রী
১৯৫৪ সালে নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের ফাইছকা গ্রামে জন্ম নেওয়া বারীর শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি ছিল সহজাত টান। বড় ভাইয়ের বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে শুরু হয় তাঁর পথচলা। পরে ওস্তাদ গোপাল দত্ত, আমিনুর রহমান, পান্নালাল ঘোষ প্রমুখের কাছে তালিম নিয়ে হয়ে ওঠেন ক্লাসিক্যাল-বাঁশির এক উজ্জ্বল প্রতিভা। দুই দশক বিশ্বমঞ্চে বাঁশি বাজিয়ে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করার পরেও তাঁর পরিচিতি আসে নব্বই দশকে, যখন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কণ্ঠের মাদকতা আবিষ্কার করেন।
হুমায়ূনের হাত ধরে গানের ময়দানে
১৯৯৩ সালে হুমায়ূনের জন্মদিনে তাঁর বাসায় বাঁশি বাজাতে গিয়ে বারীর গাওয়া বাউল গান শুনে আলোড়িত হন লেখক। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘শুয়া চান পাখি’-এসব গান হয়ে ওঠে সময়ের মাইলফলক। ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্ম হয়েছিল কবরের পাশে। হুমায়ূন স্যার তাই নাকি বারীকে বলেছিলেন, ‘গানটা গাও, কিন্তু কান্নাটা থামিয়ে রেখো না।’ হুমায়ূন আহমেদের নির্দেশ অনুযায়ী বারী সিদ্দিকী ‘শুয়া চান পাখি’ গেয়েছিলেন কাঁদো কাঁদো গলায়, কারণ গানটি রচিত হয়েছিল এক বাউলের মৃত স্ত্রীর মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকা মুহূর্তে। আজও গানটা শুনলে মনে হয়, গায়ক নিজেই যেন নিজের হৃদয়টাকে হাতে ধরে গান করছেন। সবার হয়তো মনে আছে, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ মুক্তির পর কোনো বিয়েবাড়ি ছিল না যেখানে কেউ ‘শুয়া চান পাখি’ গুনগুন করেনি। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘বারীর সুরে মধু ঝরে।’ আমরা তখন ভাবতাম, কে জানে শিল্পীর গলায় সত্যিই হয়তো আকাশের কোনো মধু জমে থাকে।
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ
১৯৯৯ সালে ফ্রান্সের ওয়ার্ল্ড ফ্লুট কনফারেন্সে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। অগণিত বিদেশি শ্রোতার সামনে তাঁর বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়েছিল বেদনার এক অনিন্দ্য সৌরভে।
চার দশকের সংগীত সাধনা
বিটিভির প্রযোজক থেকে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় প্লেব্যাক শিল্পী-সব জায়গায় তিনি রেখে গেছেন স্বতন্ত্র স্বাক্ষর। তাঁর অ্যালবামগুলো যেমন-‘মাটির দেহ’, ‘নিলুয়া বাতাস’, ‘সরলা’, ‘দুঃখ রইলো মনে’ আজও শ্রোতার হৃদয়ে চিরকালীন।
শেষ দৃশ্যকাব্য
মৃত্যুর আগে তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘আমার ভাঙা বাঁশি দিয়ে যেন আমার খাটিয়া বানানো হয়।’ এ যেন জীবনের প্রতি এক সাধকের শেষ আকুল সুর।
জন্মদিবসে আয়োজন
সাধক বারী সিদ্দিকীর জন্মদিন ছিল গতকাল। তবে বারী সিদ্দিকী স্মৃতি পরিষদ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ১৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা মিলনায়তনে। এই অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করবেন শিল্পী বাউল শফি মণ্ডল, শাহনাজ বেলী, আলম আরা মিনু, আশরাফ উদাস, মুজিব পরদেশী, ক্লোজ আপ-১ তারকা নোলক বাবু, সালমা, বিউটি, রাজীব, মনির বাউলা, রাজু মণ্ডল, পারভেজ, মুনিয়া মুন, গামছা পলাশ, শবনম মোস্তারী প্রিয়াঙ্কা, তামান্না, জু ও প্রিন্স আলমগীর।