সময়ের হিসাবে নির্বাচনের বাকি ৯০ থেকে ১০০ দিন। এর পরই অনুষ্ঠিত হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ঘোষণা অনুযায়ী একই দিন অনুষ্ঠিত হতে পারে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে গণভোটও। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গণভোটের আলোচিত চার প্রশ্ন নিয়ে। পাশাপাশি চার প্রশ্নের এক উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে চলছে বিতর্ক। এ নিয়ে সমাজমাধ্যমগুলোতে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় বইছে। তাদের সমালোচনা সরকারের দিকে। প্রশ্নগুলো গোঁজামিল বলে মনে করছেন তারা। সাধারণ মানুষের জন্য এ ধরনের প্রশ্ন দুর্ভেদ্য বলে আখ্যা দিচ্ছেন রাজনীতিবদরা। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সরব হয়েছে। তারাও প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন গণভোটের চার প্রশ্ন নিয়ে। নির্বাচনের যে সময় রয়েছে তার মধ্যে প্রশ্নগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন তারা। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে প্রশ্নমালা তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সরকারকে। বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সরকারকে আলোচনার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। তবে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গণভোটের চারটি প্রশ্নের কোনো একটির সঙ্গে দ্বিমত থাকলে, সেখানে ‘না’ বলার সুযোগটা কোথায়? গোঁজামিল দিয়ে কোনো কিছু করা হলে তা টেকসই হবে না। গণভোটের উদ্দেশ্য কী, ৯০ ভাগ লোক যদি তা বুঝতে না পারে, তাহলে মানুষ তিমিরেই থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে- সেই আলোকে গণভোটের প্রশ্নমালা করার পরামর্শ দেন তিনি। বিএনপির এই নেতা বলেন, একমত হতে না পারলে সেই মতামত কীভাবে দেবে জনগণ- তা উল্লেখ নেই গণভোটের প্রশ্নে। প্রায় একই সুরে গণভোট নিয়ে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, একপেশে সিদ্ধান্ত নয়, গণভোট নিয়ে সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা না করে একপক্ষীয়ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সরকার এখনই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিলে দেশে অচল অবস্থার তৈরি হতে পারে, আর এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে চলছে নানান বিতর্ক। আল মাহমুদ মানজুর নামের এক গণমাধ্যমকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ভোটাররা কি ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাবে, নাকি বিসিএস রিটেন দিতে যাবে? সেটা বুঝতে পারছি না। ‘দিস ইলেকশন টু হার্ড ফর ভোটারস’। আমার মনে হচ্ছে, ভোটাররা আগামাথা কিছু না বুঝে ‘হুদাই’ হ্যাঁ অথবা না ভোট মেরে চলে আসবে। বিশেষ করে হ্যাঁ ভোটটাই পড়বে। তিনি লিখেছেন- এবার আপনিই একটু ভাইবা বলেন, আসন্ন ভোট কেন্দ্রে মানুষ কোন দুঃখে যাবে? যারা যাবে, তারা কোন দুঃখে ‘প্রপারলি’ ভোট দেবে? যারা ‘প্রপারলি’ দেবে, তাদের কতক্ষণ (অন্তত প্রতি ভোটারের আধা ঘণ্টা সময় লাগবে) সময় লাগবে এই ভোটটা দিতে? আর যারা পড়াশোনা জানে না। যারা অন্ধ। যারা বৃদ্ধ। তাদের বিষয়ে না যাই।
যে চার প্রশ্নে গণভোটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া নোট অব ডিসেন্টসহ রয়েছে ঐকমত্য হওয়া ইস্যুগুলোও। ভোটে হ্যাঁ জিতলে আগামী সংসদের সদস্য নিয়ে গঠিতব্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ ১৮০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। আর না জিতলে বাতিল হয়ে যাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা দলগুলোর অঙ্গীকার। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো।
গণভোটের প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’ ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।