আওয়ামী লীগ জমানাতে হঠাৎ করেই কীভাবে যেন আন্ডা অর্থাৎ ডিম হররোজ সংবাদ শিরোনাম হতে থাকল। জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে খানবাহাদুর রায়বাহাদুর ইত্যাদি রাজকীয় উপাধির মতো আন্ডা শব্দটি শোভা পেতে থাকল এবং আন্ডার দাপটে বালুমহাল থেকে গরুর বাজার, ফেনসিডিল থেকে টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা কিংবা কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে ঢাকা-দুবাই স্বর্ণ চোরাচালান রীতিমতো শিল্পে পরিণত হলো। আন্ডার এত্ত সব বিজয় এবং সফলতার মূলে ছিল বিরাট এক ডান্ডা অর্থাৎ লাঠি। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহিনী প্রধান যখন আন্ডা মিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-সাথি বা আশ্রয়দাতা এবং ব্যবসায়িক অংশীদার হলো তখন তাদের জন্য অর্থাৎ আন্ডার ডান্ডার জন্য একের পর এক খুলে যা হেম ছেমের মতো অর্থবিত্ত ভোগবিলাস, কামনাবাসনা, লোভলালসার পাহাড় রচিত হতে থাকল এবং আওয়ামী সরকারের পতনের রাস্তা প্রশস্ত হতে থাকল।
উল্লিখিত ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম মানুষের নৈতিক ভ্রষ্টতা, অর্থলোভ এবং রুচিহীনতার স্তর কতটা নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছলে একজন অসৎ ধড়িবাজ ফুটপাতের ডিম বিক্রেতার সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ বড়কর্তার সঙ্গম বা মিলন হতে পারে এবং আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল আন্ডা ডান্ডার মিলিত স্রোতে অকূলে হারিয়ে যেতে পারে! বাংলার ইতিহাসে আন্ডা ডান্ডার বন্ধনের মতো অতীতে চাকু মহিউদ্দিন, মুরগি মিলন, বাস্টার্ড সেলিম, টোকাই সাগর, কালা জাহাঙ্গীর, টুন্ডা বাবু ইত্যাদি লোকজনের সঙ্গে রাজনীতির হর্তাকর্তাদের দহরমমরহম যেমন মানুষের রুচি ও বিবেকে ঘা তৈরি করেছিল তা আওয়ামী লীগ জমানায় আন্ডা ডান্ডার বন্ধুত্বের মাধ্যমে দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পুঁজে পরিণত হয়ে যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল তা এখন কতটা মহামারি আকার ধারণ করেছে তা নিয়ে আলোচনা করব। একই সঙ্গে এত্ত সব মহামারির মধ্যে আমাদের দেশ-জাতির জন্য যেসব সর্বনাশ অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেসব বিষয়ের সাতটি লক্ষণ সংক্ষেপে বর্ণনা করব। তার আগে আন্ডা ডান্ডা নিয়ে আরও কিছু কথা বলা আবশ্যক!
আমার কর্মজীবনে দেশের অনেক বাহিনীপ্রধান, সচিবালয়ের বড়কর্তা এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, ধর্মীয় নেতা, কবি-দার্শনিকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। যারা সফল হয়েছেন এবং সুনামধারী ছিলেন তাদের রুচি আভিজাত্যবোধ এবং শিক্ষাদীক্ষা পদপদবির সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের একটি সামঞ্জস্য ছিল। কিন্তু যারা উঁচু পদে থেকে ফুটপাতের হকারদের প্রেমে পড়েছেন এবং নিজেদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য রাস্তার ভ্রাম্যমাণ পথবধূদের পায়ে প্রণতি দিয়েছেন তাদের নির্মম পরিণতি পক্ষাঘাতগ্রস্ত নেড়ি সারমেয়দের মতোই হয়েছে। কেবল অর্থলোভ এবং যৌনলিপ্সার জন্য যারা মনুষ্যবিষ্ঠার অতলান্তে ডুব দিতে দ্বিধা করেননি তাদের শেষ পরিণতি কতটা নির্মম-নিষ্ঠুর এবং অবমাননাকর হতে পারে তা যদি কেউ দেখতে চান তবে আলোচিত আন্ডা
মানব এবং ডান্ডা হুজুরের হালহকিকত দেখে আসতে পারেন।
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আকাশের রাজা ইগল, বনের রাজা বাঘ-সিংহ এবং মানুষের রাজা রাজনৈতিক নেতৃত্বের চূড়ান্ত যোগ্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্ত নরনারী। প্রকৃতির রাজা-রানিরা অতীতে কোনো দিন তাদের চরিত্র এবং আভিজাত্য মরে গেলেও পরিবর্তন করেননি আর কেয়ামত পর্যন্ত করবেন না। কিন্তু মানুষের রাজা-রানিরা ক্ষণে ক্ষণে যেভাবে পায়ের জুতোকে মাথার মুকুট বানিয়ে উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদার আরদালিদের বাধ্য করে জুতোর কাছে মাথা নত করে আত্মসমর্পণ করতে। তাতে করে কেয়ামতের মহাপ্রলয়ের আগেই রাজনৈতিক দল-মত-গোষ্ঠী, দেশ-জাতির ভাগ্যে যে দুর্ভোগ-দুর্দশা নেমে আসে তা মহাপ্রলয়ের চেয়ে কম নাকি বেশি তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির মহামারি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় সংক্রমিত হয় তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। অযোগ্যরা যোগ্যদের মাথার ওপর চেপে বসে এবং শর্তহীন আনুগত্য দাবি করে থাকে। কোনো অযোগ্য যদি বুঝতে পারে যে তার আশপাশে যোগ্য লোক রয়েছে, তবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যোগ্যকে অযোগ্য-অপদার্থ অকর্মণ্য বানানোর জন্য। শুরু করে তাপ-চাপ এবং শক্তিপ্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে অযোগ্যরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। রাজনীতির বিষবাষ্প যখন রাষ্ট্রশক্তিকে গ্রাস করে তখন দুর্নীতিবাজদের মধ্যে শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা। বস্তা বস্তা অর্থ মণকে মণ স্বর্ণ সংগ্রহ করে তার একটি ভাগ রাজনীতির পালের গোদাদের গোডাউনে জমা দেওয়ার জন্য যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয় তা থামানোর জন্য কখনো কখনো কোনো দেশকাল জাতিকে শত বছর অবধি অপেক্ষা করতে হয়।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি শুরু হয়েছিল এরশাদ জমানায়। দুর্নীতির সঙ্গে সুরা সাকি খুনখারাবি দখলবাণিজ্য, জেলজুলুম ইত্যাদি উপসর্গ যুক্ত হয়ে রাজনীতির যে কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল তা পরবর্তীকালে থেমে থাকেনি। বরং প্রতিটি জমানায় অভিনব কৌশল যেভাবে আমজনতার ওপর রাষ্ট্রশক্তির দুর্নীতিপরায়ণ এবং দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোকজনের সিন্ডিকেট জুলুম অত্যাচার চালিয়েছে তা হালআমলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক মূল্যবোধ, জাতীয় সত্তা এবং নীতিনৈতিকতার স্তরগুলোকে চুরমার করে দিয়েছে।
আজকের সমাজে ডিসি নিয়োগ বিশ কোটি, সচিব নিয়োগ ওপেন টেন্ডার, বিভিন্ন লোভনীয় পদপদবিতে নিয়োগের জন্য শত শত কোটি টাকার খবর যেভাবে চাউর হচ্ছে তাতে করে সাবেক জমানার দুর্নীতিবাজরা নিজেদের ইদানীং ফেরেশতা ভাবতে শুরু করেছেন এবং দেশ-জাতিকে নব্য দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে উদ্ধারের জন্য রীতিমতো জিহাদ শুরু করে দিয়েছেন। আমাদের দেশের শত বছরের ইতিহাসে কেন অতীতের ভালো কর্ম বর্তমানে অনুসরণ করা হয় না এবং কেন অতীতের কুকর্ম জ্যামিতিক হারে বেড়ে আমাদের সর্বনাশের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, তার সাতটি কারণ বর্ণনা করে আজকের নিবন্ধ শেষ করব-
এক. আমাদের দেশের আমজনতা কর্মী হওয়ার চেয়ে দর্শক হতে পছন্দ করে। কাজ করার চেয়ে অলসতা তাদের পছন্দ। পরিশ্রম করে অর্জন করার পরিবর্তে ছলে বলে কৌশলে উত্তরাধিকারসূত্রে, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে অথবা হঠাৎ কোনো অলৌকিক সুযোগে সম্পদ লাভের আশায় ইতিউতি করে।
দুই. আমাদের দেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। সহজে ভুলে যায়- সহজে উত্তেজিত হয়, সহজে ভয় পেয়ে যায় এবং মাঝপথে উল্টো দৌড় দেয়।
তিন. আমরা কোনো কাজে ধারাবাহিকতা রাখতে পারি না। আমাদের ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। চিন্তা ও পরিশ্রম করার চেষ্টা আমাদের দেশে কঠিনতর বিষয়। জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা অর্জন এবং আনুগত্য প্রদর্শন আমাদের ধাতে সয় না।
চার. আমাদের রয়েছে ভয়াবহ আবেগ, আবেগজনিত কারণে আমরা হররোজ একের পর এক সর্বনাশ ঘটিয়ে যাচ্ছি। আমরা দিনের চেয়ে রাত- আলোর চেয়ে অন্ধকার, জ্ঞানের চেয়ে নির্বুদ্ধিতা পছন্দ করি। কাজের পরিবর্তে অকাজ এবং সফল মানুষদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা গল্পগুজব পছন্দ করি। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র-অলস এবং কর্মবিমুখ মানুষটিও দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষটিকে উদ্দেশ করে বলবে- শালা! এত টাকা কীভাবে কামাল।
পাঁচ. আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম প্রকৃতির হওয়ায় আমাদের গড় সাহস শক্তি অপমানজনকভাবে কম। আমাদের মেরুদণ্ড খুবই দুর্বল এবং আমাদের পাকস্থলী-রেচনতন্ত্র-ফুসফুস হৃৎপিণ্ড জন্ম থেকেই নড়বড়ে। ফলে বদহজম, হাঁপিয়ে ওঠা এবং ভয় পাওয়া আমাদের জাতীয় রোগে পরিণত হয়েছে।
ছয়. আমরা প্রচণ্ড অদৃষ্টবাদী। নিজেদের সব ব্যর্থতা ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা কপাল চাপড়াতে থাকি। অকৃতজ্ঞতা-দাম্ভিকতা আমাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অবাধ্য হওয়া এবং পালিয়ে যাওয়া আমাদের কাছে গর্বের বিষয়।
সাত. আমরা অসম্ভব স্বপ্নবিলাসী- ভোগবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী। শত্রুকে মিত্র মনে করা এবং মিত্রকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দূরদূর তাড়িয়ে দেওয়া আমাদের সাধারণ অভ্যাস। কোনো মূল্যবোধ-নীতিনৈতিকতা বা ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারকবাহক হওয়াকে আমরা দাসত্ব মনে করি। আমরা সর্বদা আকাশকুসুম কল্পনা করি এবং অন্য মানুষের সর্বনাশের চিন্তায় বিভোর হয়ে নিজেদের স্বপ্নবাসর তৈরি করি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক