আদি মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া বেহেশতবাসী হওয়া সত্ত্বেও বেহেশতে তাঁদের উভয়ের নির্ঝঞ্ঝাটে থাকার জন্য আল্লাহ কিছু নিয়মরীতি স্থির করে দিয়েছিলেন। প্রথমেই তিনি আদমের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার বিবি বেহেশতে বসবাস কর এবং বেহেশতের সবকিছু তোমরা স্বচ্ছন্দে আহার কর। তবে এই গাছের কাছে যেও না, তাহলে তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা বাকারা ২:৩৫)। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা আল্লাহর বেঁধে দেওয়া সীমা লঙ্ঘন করে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
পৃথিবীতে ঝামেলাহীনভাবে চলার জন্য মানুষের রচিত বহু আইনকানুন, বিধিবিধান ও রীতিনীতি আছে এবং এসব ভঙ্গ বা লঙ্ঘন করলে শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু মানুষের মন অপরাধপ্রবণ এবং তারা কারণে-অকারণে আইন ভঙ্গ করে। তাদের ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গের শাস্তি আদম-হাওয়ার মতো বেহেশত থেকে পতনের শাস্তির মতো নয় বলে আইন ভঙ্গ করা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বিচলিত করার ব্যাপার হলো, যারা মানুষের ওপর প্রয়োগযোগ্য আইন ও বিধিবিধান তৈরি করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন ও আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করেন, তারা সবার আগে আইন ভঙ্গের কাজগুলো করেন।
কারা সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে ৫৫ বছর বয়সি স্বাধীন বাংলাদেশে আইন ভঙ্গ করে দেশের বারোটা বাজানোর কাজ সবচেয়ে বেশি করেছেন রাজনীতিবিদরা এবং বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে এবং সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে যে কোনো আইন পাস করে তা ভঙ্গ করার জন্য। কিন্তু কে তাদের শাস্তি প্রদান করবে? আদম-হাওয়ার সামান্য ভুলের জন্য তাদের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগকারী আল্লাহ তাদের সুখের বেহেশত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসিত করেছিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের অপরাধের শাস্তি কে তাদের ওপর প্রয়োগ করবে। শাস্তি প্রদানের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে। সংবিধান বলে দেয় যে বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং সরকার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কী করেছিলেন? বিচার বিভাগের খোলনলচেই পাল্টে দিয়েছিলেন। মানুষ পুরোনো প্রবাদে বিশ্বাস করত : ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।’ শেখ হাসিনার শাসনে তার অঙ্গুলি হেলনে হাকিমের গদি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল বলে হাকিমের হুকুমও সরকার নির্দেশিত হতো। তার নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে যে ন্যক্কারজনক ভাষায় বিষোদগার করা হয়েছে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের কেশাগ্র স্পর্শ করার আগে বিচারপতিদের অন্তত ১০ বার চিন্তা করার প্রয়োজন না পড়েই পারে না। ফলে যারা অপরাধ করে তারা আদম-হাওয়ার মতো ‘বেহেশত হারান না’। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া তারা বহাল তবিয়তে থাকেন। যেমন রয়েছেন দেড় সহস্রাধিক মানুষ হত্যার নির্দেশ দানকারী ইতিহাসের জঘন্যতম স্বেচ্ছাচারী শাসক শেখ হাসিনা ও তার দোসররা।
গন্ধম খাওয়ার কারণে যদি আদম-হাওয়াকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হওয়ার মতো শাস্তি ভোগ করতে হয়, তাহলে অসংখ্য মানুষ হত্যার কারণে শেখ হাসিনা ও তার অপরাধের সহকর্মীদের কী শাস্তি হওয়া উচিত? আদম এবং হাওয়া নিজেদের কৃত ভুলের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন : ‘হে আমাদের রব, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সুরা আরাফ : ২৩) তবু আল্লাহ তাঁদের তাৎক্ষণিক ক্ষমা করেননি। একপর্যায়ে আল্লাহ তাঁদের তওবার কিছু শব্দ শিখিয়ে দেন এবং আদমের তওবা কবুল করেন।’
কিন্তু শেখ হাসিনা তওবার আশপাশে নেই। তিনি বারবার বলেছেন এবং এখনো বলছেন, ‘আমার কী দোষ?’ অথবা ‘আমি কী করলাম?’ তার অনুসারীরাও তার সুরই নকল করে বলে একই কথা বলছেন। সামান্যতম অনুশোচনা নেই কারও কণ্ঠে, আচরণে। বরং শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের আওয়ামী ভাববাদীরা দাবি করে চলেছেন, শেখ হাসিনাই এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী, ইত্যাদি।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যাধির প্রলাপ হলো : ‘আমি’ ও ‘আমরা’। যে কোনো প্রলাপ যখন উন্মত্ততার পর্যায়ে পৌঁছে তখন যে দাওয়াই প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল, তা গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং দেশ আওয়ামী ব্যাধিমুক্ত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এ ব্যাধি যাতে কোনো ব্যক্তি বা দলের মাঝে সংক্রমিত না হয়, সেজন্য শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) তার ও তার দ্বারা কৃত অপরাধের সহযোগীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার শাসনামলে কেবল জেদের বশবর্তী হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার লক্ষ্যে বিশেষভাবে গঠিত আদালতের মাধ্যমে ৪০ বছর আগের কল্পিত অপরাধকে ইস্যু বানিয়ে বিচারে দেশের বেশ কিছুসংখ্যক শীর্ষ রাজনীতিবিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘প্রহসনের বিচার,’ ‘ক্যাঙারু কোর্টে বিচার,’ এমনকি ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলে বর্ণনা করা সত্ত্বেও তারা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এখন স্বয়ং শেখ হাসিনাই আইসিটিকে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ এবং তার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের মামলাকে ‘প্রহসনের বিচার’ বলে বর্ণনা করছেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশে যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সেই গণহত্যার প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করবে আগামীকাল ১৭ নভেম্বর সোমবার। এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও জড়িত। রাজসাক্ষী আছেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আইসিটি-১-এর বিচারপতি হিসেবে আছেন মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এ মামলায় পাঁচটি অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। যেদিন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয়, সেদিন থেকেই ঢাকা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কোনো প্রদর্শন মোকাবিলা করতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরাও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। অতএব সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিশ্চিত বলা যেতে পারে যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলার সম্ভাব্য রায়কে কেন্দ্র করে তেমন গোলযোগের আশঙ্কা নেই।
কারণ আওয়ামী লীগ ১৩ নভেম্বর যে লকডাউন ঘোষণা করেছিল, তা মাঠে মারা গেছে। আওয়ামী মহলে হতাশার কথা জানা গেছে। ১৫ মাস ধরে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগের এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। দেশবাসী এবং প্রতিটি রাজনৈাতিক দল এখন নির্বাচনমুখী। সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু গণভোট ও সংসদ নির্বাচন। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দ্বারা নাশকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা তাদের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক